Thursday, July 18, 2013

মর্মান্তিক ত্যাগের ইতিহাস আর অবমূল্যায়নের চিরাচরিত কাহিনী! -মাহবুবুল হক শাকিল


গৌরিপুর জংশনঃ ১৯৭১

১৯৭১ সাল। এপ্রিলের শেষেই মুক্ত গৌরিপুরের পতন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দখলে সবকিছু। গৌরিপুরের মুক্তিযোদ্ধারা প্রাঁয় সবাই যোগ দিয়েছেন ১১ নম্বর সেক্টরে, পার্শ্ববর্তী পূর্বধলা থানার কাজলা গ্রামের মেজর তাহেরের সেক্টরে।

তেমনি এক তরুণ মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিম। কাজলা গ্রাম থেকে মেজর তাহেরের মা এবং বোনদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে পৌছে দেয় ভারতে। হাসিমের তখন দুই মেয়ে, দুই ছেলে। নাবালক দুই ছেলে তার সাথে ভারতে পাড়ি দিলো, দুই কন্যা নানাবাড়ির নিরাপদ আশ্রয়ে, নেত্রকোনার সুসং-দুর্গাপুরে।

হাসিমের বাড়ী গৌরিপুরের শালিহরে। সেখানেই বসবাস ধনী গৃহস্থ মধূসূদন করের। তারও চার ছেলেমেয়ে। বড়ো মেয়ে সুপ্রিয়া ধর, তারপর সুপ্রিয় ধর, সুব্রত শংকর ধর, সাড়ে তিন বছরের সুপ্রীতি ধর।

ময়মনসিংহ শহর থেকে পালিয়ে আসা ধনবান হিন্দুরা তার বাড়ীতে আশ্রিত। ৫০ থেকে ৬০ জন। সঙ্গে কন্যারা, তরুণী।

১৬ মে। দুপুর বেলা। হঠাৎ করেই পাকি হানাদারদের আগমন। মনোরঞ্জন ধরের বাড়ীতে। পাকিরা খবর পেয়েছে বাঙালি রাজাকারের কাছ থেকেই। মনোরঞ্জন বাবু ভারতের দালাল।

পাকি জারজরা আসার খবর মনোরঞ্জন বাবু পেলেন তার দীর্ঘদিনের বাৎসরিক কর্মচারী পাঞ্জর আলীর কাছ থেকে। পাকি জারজেরা শর্ত দিলো, মনোরঞ্জন যদি আত্মসমর্পণ করেন তবে কাউকে আর কিছু করা হবেনা।

অসীম-সাহসী মনোরঞ্জন পরিবার এবং আশ্রিতদের বাঁচানোর জন্য পাকিস্তানী হায়েনাদের কাছে এলেন। বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে তাদের সাথে কথা বললেন। ওরা তাকে নিয়ে গেলো আরো কথা বলার জন্য। সঙ্গে গেলো বিশ্বস্ত কর্মচারী ষাটোর্ধ্ব পাঞ্জর আলী।

গৌরিপুর জংশন। মনোরঞ্জন কাকাবাবুর শেষ কথা ছিল পাঞ্জর আলীর সাথে- "ভাই, আমাকে এক কাপ চা খাওয়াতে পারবি?" পাজ্ঞর আলী পারেনি।

আমাদের মনোরঞ্জন আর ফিরে আসেননি।

২১ আগষ্ট, ১৯৭১ সাল। আবারো পাকবাহিনীর আক্রমন। লক্ষ্যস্থল আবারো শালিহর। এবারের টার্গেট-মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিমের বাড়ী। ষ্টেশনমাষ্টার অবাঙালি, বিহারি সলিমুদ্দিন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়।

আবুল হাসিমের বাবা গ্রামীণ ব্যবসায়ী সাবেদ হোসেন ব্যাপারী এবং ১৩ জন নিম্নবর্গীয় হিন্দুসহ ১৭ জনকে সেদিন তুলে নেয়া হলো। গৌরিপুর জংশন থেকে গুডস ট্রেন রওনা দিলো অজানা গন্তব্যের দিকে। স্বাধীন দেশে এই মানুষগুলোকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

পাদটিকাঃ
১.বর্ণিত মুক্তিযোদ্ধা আবুল হাসিম আমার কন্যার নানা।
২. ১৯৭৩ এর নির্বাচনে আবুল হাসিম বা ১১ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার তার চাচাতো ভাই তোফাজ্জল হোসেন চুন্নু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। পেয়েছিলেন এবং এমপি হয়েছিলেন এডভোকেট নাজিমুদ্দিন আহমেদ তিনি ১৯৮৮ সালে জামাতে ইসলামীতে যোগ দিয়েছিলেন।
৩. আবুল হাসিম সাহেব ২০১২ সালের ১৫ আগষ্ট মৃত্যুবরণ করেন ( কি অদ্ভূত যোগাযোগ!)

No comments:

Post a Comment