Tuesday, November 11, 2014

বিমানবালার পোশাক- আনোয়ারা সৈয়দ হক


ডিসেম্বর ১৩, ২০১০
ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
ছবি. মুস্তাফিজ মামুন
আমাদের দেশে এখন আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বেশ ক’টি চালু হয়েছে। সম্প্রতি নতুন একটি  আভ্যন্তরীণ বিমানের ফ্লাইট চালু হবার জন্যে অন্যান্য বিমানগুলো প্যাসেঞ্জারের পকেট কাটার ব্যবসা থেকে নিজেদের একটু সামলে নেবার চেষ্টা করছে! আগে যেখানে বিমানে যশোর যাতায়াত করতে লাগত আট হাজার টাকা, এখন সেখানে যাতায়াত করতে লাগছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। এক রাতের ভেতরেই তিনহাজার টাকা কম হয়ে গেছে। আমরা নিরীহ প্যাসেঞ্জাররা বুঝতে পারি সুযোগ পেলে সব কোম্পানিই জনগণের পকেট কাটতে তৎপর।
তবে এসব দুঃখের কথা থাক। কারণ এসব দুঃখের কোন ফয়সালা নেই। আগেও কোনদিন ছিল না, এখনও নেই। বর্তমানে বিমান ভাড়া একটু কমলেও পরে দুই কোম্পানির যখন গোপন আঁতাত হয়ে যাবে তখন আবারও বিমানে আভ্যন্তরীণ যাতায়াতের ভাড়া বেড়ে যাবে। সে সময়ের জন্যেও আমরা মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছি!
আজ আমরা বিশেষ একটি ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে এই লেখাটি লিখছি, সেটা হল নতুন এই বিমান কোম্পানিটির এয়ার হোস্টেসদের পোশাক। তারা দুই ধরনের পোশাক চালু করেছে বিমানবালাদের জন্যে। একটা হল গ্রাউন্ড হোস্টেসদের পোশাক, আরেকটা আকাশে উড্ডীয়মান এয়ার হোস্টেসদের পোশাক।
গ্রাউন্ডহোস্টেসদের পোশাকের ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই। কারণ সত্যিকার অর্থে সেই পোশাকটি দেখতে খুবই সুন্দর এবং রুচিশীল। পোশাকটি হল শাড়ি। শাড়ি আমাদের দেশের মেয়েদের জাতীয় পোশাক। ফলে সব বিমান কোম্পানি, কী আভ্যন্তরীণ বা কী আন্তর্জাতিক, সকলেই তাদের বিমানবালাদের পোশাক রেখেছে শাড়ি। কিন্তু  বর্তমানে এই নতুন আভ্যন্তরীণ বিমানটি তাদের বিমানবালাদের আকাশে উড্ডীয়মান পোশাক দিয়েছে প্যান্টশার্ট এবং কোট, যেটা সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশের আভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সাথে একেবারে বেমানান। এমনকি বিদেশে উড্ডীয়মান বাংলাদেশী বিমানবালার জন্যেও বেমানান।  কারণ এই পোশাক আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করে না।

তবে চাকরির জন্যে মানুষ করতে পারে না কি। সুতরাং এসব বিমানবালাদের হয়ত বলার কিছু নেই। কিংবা হয়ত বলার ইচ্ছাও নেই। আজকাল দেশের মেয়েরা বিদেশী পোশাক যেমন পাকিস্তানি পোশাক সালোয়ার কামিজে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। এমনইভাবে অভ্যস্ত হয়েছে যে এই সালোয়ার কামিজই আমাদের জাতীয় পোশাকের স্থান অধিকার করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। দশ বছর পরে শুনব যে সালোয়ার কামিজই আমাদের জাতীয় পোশাক। পাকিস্তানি মনোভাবের বাংলাদেশী সরকারগুলো তাদের শাসনকালের সময় আমাদের দেশের নার্সদের শরীর থেকেও খুলে নিয়েছে শাড়ি, তার বদলে পরিয়েছে তাদের সালোয়ার কামিজ, যে কামিজের অন্তরালে মৃত্যু হয়েছে মমতাময়ী নার্সের।  সেই সালোয়ার কামিজের ওপর তারা চাপিয়ে দিয়েছে ডাক্তারদের এ্যাপ্রন, ফলে কে যে নার্স আর কে যে ডাক্তার মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। নার্সকে ভুল করে ডাক্তার বললে হয়ত সে খুশিই হয়, কিন্তু ডাক্তারকে ভুল করে নার্স বললে তখন ঝামেলা বাঁধে। তাই নার্সদের আবার শাড়ি পরাতে গেলে ’সংবিধান’ সংশোধন করতে হবে।
ওদিকে আবার ভারতের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনও আমাদের মেয়েদের ভেতরে সালোয়ার কামিজবোধ জাগিয়ে তুলেছে, কারণ তারাও চায় না যে আমরা শাড়ি পরে বাঙালি থেকে যাই। মোটকথা আমাদের ভেতর থেকে বাঙালিবোধ যত দ্রুত শেষ হবে ততই তারা অর্থাৎ ভারত এবং পাকিস্তান খুশি হবে। কারণ বাঙালি অর্থই হল ‘‘ঝামেলাকারী’’। আমাদের হয়ত ধারণাও নেই পাকিস্তান এবং ভারতের ভেতরে আপাত দৃষ্টিতে বৈরীতা থাকলেও ভেতরে ভেতরে তাদের কত মিল, কারণ তারা মোটামুটি একই ভাষায় কথা বলে। একজন হিন্দিঅলা আর একজন উর্দুঅলার ভেতরে প্রাণের সখ্য। এটা দেখা যায় যখন ভারতে বিভিন্ন দেশের মানুষেরা সম্মেলন করতে যান। ভাষা এমন একটি জিনিস যা ভাইরাসের চেওে দ্রুতগতিতে মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। যেসব বাঙালি কোনদিন বিদেশে থেকেছেন তারাই আমাদের কথা অনুধাবন করতে পারবেন।
এতসব কথা বলার পর এটাও ঠিক কথা যে আমাদের পুলিশ বাহিনীতে মেয়েদের পোষাক সময়োপযুক্ত। তাদের কাজের ধরন তাদের পোশাক নির্ধারণ করেছে।  বিশেষ করে আমাদের মত অস্থির একটি দেশের জন্যে মেয়ে পুলিশের পোশাক যতদূর সম্ভব আঁটসাট হওয়া প্রয়োজন। কারণ রাস্তাঘাটে বা বাইরের অভিযানের জন্যে তাদের সর্বদাই প্রস্তুত থাতে হয়।  এটা তাদের কর্মক্ষেত্রের উপযুক্ত পোশাক। কিন্তু বিমানবালাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা গ্রাউন্ডেই থাকুন আর আকাশেই উড়ুন, শাড়ি হচ্ছে তাদের উপযুক্ত পোশাক। কারণ দেশের এক ধরনের প্রতিভূ হয়ে যাচ্ছেন তারা। একথা হয়ত আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে যে কোন দেশের সংস্কৃতি কিন্তু মেয়েরাই ধরে রাখেন। বাংলাদেশী হিসাবে আমাদের নিজেদের কিছু সংস্কৃতি আছে, ষেখানে শাড়ি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
চারপাশে আমাদের সমাজে মা দাদিরা যতই সালোয়ার কামিজ পরে ঘোরেন না কেন, আমরা আমাদের দেশনেত্রীদের সালোয়ার কামিজে চোখে দেখতে চাই না।  কারণ সালোয়ার কামিজ আমাদের দেশের সংস্কৃতি নয়। আমাদের কৃষ্টি এবং ঐতিহ্যের ভেতরে সালোয়ার কামিজ মিসফিট। এজন্যে দেখবেন রবীন্দ্রসঙ্গীত কেউ বাইরে গাইতে গেলে তারা শাড়ি পরেই গানটি গান, সালোয়ার কামিজ পরে গান না। অন্তত এখন পর্যন্ত গাননি।  সমাজ এবং পরিবেশের সাথে সমতা রেখেই আমরা চলতে চাই। এমন কোন কিছু ঠিক সেই পরিবেশের সাথে খাপ খায় না আমরা করতে চাই না। আমরা দেখতে চাই না যে সংসদ নেতা সাজেদা চৌধুরী, বা মতিয়া চৌধুরী বা বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া বা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাল্লু দেয়া সালোয়ার কামিজ পরে সংসদে আসছেন। তারা বাড়িতে যা ইচ্ছা পরুন, কিন্তু বাইরে যখন দেশনেতা হয়ে যাবেন অবশ্যই আমরা তাদের আমাদের দেশীয় পোশাক শাড়িতেই দেখতে চাইবো, খোট্টাদের পোশাকে নয়, অবশ্যই নয়।
এই নতুন বিমানটির এয়ার হোস্টেসদের পোশাক প্যান্টশার্ট করার পেছনে বিমান কোম্পনির খুব সূক্ষ্ম একটি গোপন বাসনা কাজ করছে বলে আমাদের সন্দেহ হয়। আর সেটি হল নারীর শরীরকে ভিন্নভাবে প্রদর্শন করা এবং ভিন্ন একটি প্রেক্ষিতে পুরুষ প্যাসেঞ্জারদের সমুখে তাদের তুলে ধরা। যার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বাড়ানো দ্রুত হারে। এবং অন্য বিমান কোম্পনিদের বুড়ো আঙুল দেখানো। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে করা যে কোন কাজই সমালোচনার সুযোগ তৈরি করে। সেইদিন তো আর নেই, যখন এয়ার হোস্টেসদের আদেশ দেয়া হত প্যাসেঞ্জারদের মনোরঞ্জনের জন্যে।  ‘‘টি, কফি অর মি.. ’’ এই ছিল তখনকার বিমান কোম্পানিগুলোর বিমানবালাদের দিয়ে কাস্টমার বা প্যাসেঞ্জার আকৃষ্ট করার স্লোগান। নারীকে তখন চা ও কফির সাথে সমগোত্রের বলে স্লোগান দেয়া হত। নারীকে পণ্য হিসাবে গণ্য করে সেটাই ছিল বোধহয় নির্লজ্জ একটি স্লোগান। এয়ার হোস্টেসরা সেসব দিনে বেয়াদব প্যাসেঞ্জারদের দৌরাত্ম অনেক সহ্য করেছেন।
অনেক এয়ার হোস্টেস প্যাসেঞ্জারদের অসভ্য ব্যবহার সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে এয়ারহোস্টেসদের জন্যে সেসব বিভীষিকাময় দিনগুলো গত হয়েছে। নারীর দেহ এবং চেহারা দেখিয়ে প্যাসেঞ্জার মনোরঞ্জন করা বন্ধ হয়েছে। এমনকি আমি কিছুদিন আগে একজন গর্ভবতী এয়ার হোস্টেসকেও বিদেশী ফ্লাইটে কাজ করতে দেখেছি খুব গাম্ভীর্যের সাথে। এবং খুব মর্যাদার সাথে। তারা এখন বিবাহিত জীবন যাপন করতে পারেন। আগের মত নিজের বিয়ে এবং সংসার করাটাকে আর অবৈধ মনে হয় না!  বিমান কোম্পানির নজর এড়িয়ে স্বামী সন্তানের সাথে সম্পর্ক রাখতে হয় না।
পুরুষ প্যাসেঞ্জারদের ব্যবহারও সেই অনুপাতে এখন অনেক শালীন। এমনকি কোন ফাজিল পুরুষ বিমানে উঠে মদ খেয়ে এয়ার হোস্টেসকে উত্যক্ত করলে সঙ্গে সঙ্গে কো পাইলট বা পার্সার এসে হাজির হন এবং প্যাসেঞ্জারকে সংযত হতে উপদেশ দেন। কখনও বা প্যাসেঞ্জারদের ধমক দিতেও দেখেছি। সুতরাং দিনকাল অবশ্যই পাল্টে গেছে। মানুষের মন মানসিকতা পাল্টে গেছে।  মেয়েদের ভেতরে আত্মসম্মানবোধ বেড়েছে। তারা এখন সমাজের পুরুষের অশালীন ব্যবহারের প্রতিবাদ করতে শিখেছে। সুতরাং নারীদেহ প্রদর্শনী করে এখন আর কেউ পুরুষের মনোরঞ্জনে আগ্রহী নয়। বিমানবালাদের পুরুষের পোশাক পরিয়ে ভিন্ন প্রেক্ষিতের যৌন সুড়সুড়ি দেবার প্রবণতা আমরা মেয়েরা খুব খারাপ চোখে দেখছি। জানিনে পুরুষেরা কীভাবে এটাকে দেখছেন। প্রতিটা দেশের নিজস্ব একটি ইমেজ আছে। সেই ইমেজের সাথে বিমানবালাদের প্যান্ট শার্ট পরানোটা কতখানি যৌক্তিক সেটা বিমান কোম্পানিকে ভেবে দেখতে বলব। ডিউটি শেষে বিমানবালারা প্যান্ট শার্ট কেন, ইচ্ছে হলে লুঙি গেঞ্জি পরে বাড়ি ফিরে যান বা রাস্তায় ঘোরেন, সেটা আমরা না দেখার ভান করবো। এবং সেটা তাদের নিজস্ব রুচি এবং ইচ্ছে।  কিন্তু ফর্মাল ডিউটি করার সময় তাদের আমরা আবহমান কালের বাংলার শাড়িতেই দেখতে পছন্দ করি। আশা করি বিমান কোম্পানি এটা ভেবে দেখবেন।

No comments:

Post a Comment