Friday, October 24, 2014

যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে ৯০ বছরের কারাদণ্ড -সাব্বির রহমান

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রায়ে যুদ্ধাপরাধী এবং জামায়াত ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকে (৯২) ৯০ বছরের  কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। জাতি তার ফাঁসির দাবি করলেও আদালত তার বার্ধক্যজনিত কারনে বিশেষ অনুকম্পা দেখিয়ে ফাঁসি না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। আজ তা কার্যকর হলো। মানুষের জন্ম যখন হয়, তখন মৃত্যুটা একটা অবধারিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু হতে হয় দৃষ্টান্তমূলক, যা গোলাম আযমের বেলায় হলো না। এজন্য আমরা দুঃখিত।

    শান্তি কমিটি নামে হলেও একাত্তরের নয় মাস এরা জাহান্নামের হেন অত্যাচার নাই যা বাঙালিদের ওপরে করেনি। শুধু শান্তি কমিটিই নয়, বাঙালিদের হত্যা করতে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোক্তা এবং প্রস্তাবক ছিলেন গোলাম আযম।

একাত্তরে ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার ১০ দিনের মধ্যে অন্যান্য ডানপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে এক হয়ে গোলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার দুইদিন পরে গোলাম আযম আলাদাভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে দেখা করে ফিরে আসার কয়েকদিনের মধ্যে শান্তিবাহিনী গঠন করেছিলেন।

শান্তি কমিটি নামে হলেও একাত্তরের নয় মাস হেন অত্যাচার নাই যা বাঙালিদের ওপরে এরা করেনি। সে বছর ৯ এপ্রিল প্রথমে ঢাকায় খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের নাগরিক শান্তি কমিটি গঠন করা হয়েছিল, যেখানে গোলাম আযম ছিলেন অন্যতম। পরে এই কমিটির নতুন নাম দেওয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি।

    আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু। তারা সবসময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে।‘ শুধু শান্তি কমিটিই নয়, বাঙালিদের হত্যা করতে সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠনের উদ্যোক্তা এবং প্রস্তাবক ছিলেন গোলাম আযম।

একাত্তরে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন দলিলে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ৪ আগস্ট খুলনা জেলা জামায়াতের এক সভায় গোলাম আযম তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। অনুরূপ অন্য এক গোপন দলিলে দেখা গেছে যে, আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে কুষ্টিয়া জেলা জামায়াতের সম্মেলনে গোলাম আযম বলেছিলেন, ‘হিন্দুরা মুসলমানদের শত্রু। তারা সবসময় পাকিস্তানকে ধ্বংসের চেষ্টা করছে।‘

ওই সম্মেলনে গোলাম আযম প্রতি গ্রামে শান্তি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা নামের দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করতে। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় জুড়েই গোলাম আযম ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সরলমনা মুসলমানদের খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেন হিন্দু সম্প্রদায় ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে।

একটি ঘটনা বলি, ২৩ নভেম্বর ছিল ঈদ। পরদিন কামালের ফেরার কথা। ফেরে না কামাল। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় তিতাসের পাড়ে ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে মারা হয় সিরু মিয়া ও তার ছেলে কামালকে। ঈদের পরদিন ফজলু কুমিল্লা জেলখানায় কামালকে আনতে যান। সেখানে সিরু মিয়া ও কামালের জামা কাপড় তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। গোলাম আযম তার লেখা চিঠিতে এমন করারই নির্দেশনাই দিয়েছিলেন।

    ইতিপূর্বে কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণার পরেও বিভিন্ন আঁতাতের অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। সরকারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। আর তখন থেকেই ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রধান ষড়যন্ত্রকারী, উসকানিদাতা এবং রাজাকার, আলবদর, আলশামসের মতো প্যারামিলিটারি গড়ার মূল কারিগর গোলাম আযমের বিরুদ্ধে পাঁচ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। রায়ে বলা হয়েছে, গোলাম আযমকে ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল যে, “ন্যায়বিচারের স্বার্থে এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতি বিবেচনায় গোলাম আযমের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য। কিন্তু তার বয়স ৯১ বছর ও শারীরিকভাবে তিনি অসুস্থ।” গোলাম আযমের বিরুদ্ধে এ রায় ঘোষণার পর সারা জাতি ক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় বয়ে যায় দেশজুড়ে। মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক, বিশিষ্টজনসহ অনেক সাধারণ মানুষও সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রতিবাদে, ক্ষোভে আর অন্তর জ্বালায়।

ইতিপূর্বে কাদের মোল্লার বিচারের রায় ঘোষণার পরেও বিভিন্ন আঁতাতের অভিযোগ উঠেছিল বিভিন্ন মহল থেকে। সরকারের ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। আর তখন থেকেই ফুঁসে উঠেছিল সারা দেশ। গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। যদিও সেই মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের নানা দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাচ্ছিল।

     গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু বয়সের কথা বলে এমন জঘন্য অপরাধীর সাজা কমানো কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না বলে মত প্রকাশ করেছিলেন একাধিক আইনবিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ।

দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর আপিলের রায়েও সারা জাতি হয়েছিল ক্ষুব্ধ। ট্রাইব্যুনালের দুর্বলতা এবং আঁতাতের চিত্রগুলো যেন আরও অনেক বেশি পরিস্কার হয়েছিল জাতির কাছে। সেই থেকে ট্রাইবুনালকে ঘিরে এক ধরনের স্থবিরতা চলছিল। আইনমন্ত্রীর অসংলগ্ন কথাবার্তা এবং কাজ জাতিকে বর্তমানে বিরক্তির শেষ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে বলা যায়।

 গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু বয়সের কথা বলে এমন জঘন্য অপরাধীর সাজা কমানো কোনওভাবেই গ্রহণযোগ্য ছিল না বলে মত প্রকাশ করেছিলেন একাধিক আইনবিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ।

স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রের প্রথম বিচার বিষয়ক মন্ত্রী আন্দ্রিইয়া আরতুকভিচকেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল ১৯৮৬ সালে, যখন তার বয়স ছিল ৮৭ বছর। শুধু তাই নয়, আরতুকভিচের স্বাস্থ্য তখন এতটাই খারাপ ছিল যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলেও, তা কার্যকর করা সম্ভব হচ্ছিল না। যেই অনুকম্পার ক্ষমতা শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতিকে দেয়া হয়েছে সাংবিধানিক ভাবে, সেই অনুকম্পা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কীভাবে, কোন আইনের বলে ব্যবহার করতে পারে, তাও ছিল জনমনে এক বিশাল প্রশ্ন।

মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি আন্দ্রিইয়া কারা হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে গোলাম আযম শুধুই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলেন, যদিও আদালতে তার বিরুদ্ধে দেওয়া সব অভিযোগই প্রমাণ হয়েছিল।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এবং যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা কারাগারে শাহী হালে আছেন। গোলাম আযম তো গ্রেফতারের পর থেকেই দেশের সেরা হাসপাতালে সেরা ব্যবস্থাপনায় সাততারা হোটেলের আদর যত্নে ছিলেন মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। এমন কি তার ক্লিনিক্যাল মৃত্যু হলেও, নল-পাইপ লাগিয়ে তাকে নাকি বাঁচিয়ে রেখেছিল কিছু সময় পর্যন্ত। কারাবিধি লঙ্ঘন করে গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের বিশেষ কক্ষে রাখা হয়েছিল। বাড়ি থেকে নিয়মবহির্ভূত ভাবে তিন বেলার খাবারও তিনি উপভোগ করে গিয়েছিলেন। ১৬টি দৈনিক পত্রিকাও বরাদ্দ ছিল এই যুদ্ধাপরাধীর জন্য। সৌদি বাদশা ও আইএসআইয়ের কল্যানে জামায়াত নেতাদের বিলাস জীবনের কোনও কমতি বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে রাখা হয়নি। বরং তা ক্ষেত্র বিশেষে মাত্রাও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

    মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়ে অবশেষে ১৯৮৮ সালের ১৬ জানুয়ারি আন্দ্রিইয়া কারা হাসপাতালে মারা গিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে গোলাম আযম শুধুই বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেলেন, যদিও আদালতে তার বিরুদ্ধে দেওয়া সব অভিযোগই প্রমাণ হয়েছিল।

নিজ বাড়িতে থেকে একাত্তরের এই নরপশু যে ভোগবিলাসের স্বপ্নও দেখতে পারতেন না, কারাবাসের কল্যাণে তা পূরণ করে বহাল তবিয়তেই পরপারে গমন করলেন। কি ভাগ্য মানুষের! কিন্তু জাতি আজীবন লুকানো দীর্ঘশ্বাস চিরে জানতে চাইবে, কার বা কাদের নির্দেশে ’৭১ এর এই শীর্ষ গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীর জন্য এতো আয়োজনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল? পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা রাস্তা-ঘাটে না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। এ সবই কি বিধাতার রহমত? না-কি এই অভাগা জাতির দুর্ভাগ্য?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক
ইমেইল:sabbir.rahman@gmail.com

No comments:

Post a Comment