Friday, June 27, 2014

ডালিম হোটেলে নির্যাতন ‘শুধু মীর কাসেম নন, সব নির্যাতকের বিচার চাই’

‘শুধু মীর কাসেম নন, সব নির্যাতকের বিচার চাই’ ডালিম হোটেলে নির্যাতন
ছবি: সোহেল সারোয়ার/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
একাত্তর সালে ‘আলবদরের কসাইখানা’ হিসেবে পরিচিত ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে নির্যাতিত ও তাদের স্বজনরা শুধু মীর কাসেম আলী নন, নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে বিচারের মুখোমুখি দেখতে চান।

ডালিম হোটেলে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তখনকার চট্টগ্রাম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের মেধাবী ছাত্র (বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং বেসরকারি ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য) ইরশাদ কামাল খান।

মঙ্গলবার বিকেলে ইন্ডিপেন্ডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যালয়ে বসে আলাপকালে ইরশাদ কামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘শুধু মীর কাসেম আলী নন, যারা আমাদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করেছিলেন, তদন্ত করে সবার পরিচয় বের করে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক। আমরা নির্যাতনের বিচার চাই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা সবাই আলবদর। ডালিম হোটেলও ছিল আলবদরদের নিয়ন্ত্রণে। আর আলবদর বাহিনী যারা গঠন করেছিলেন তারা সবাই তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতাকর্মী।’

অন্যদিকে একাত্তরে ডালিম হোটেলে ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তৎকালীন চট্টগ্রামে জেলা ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন খান। জীবনভর নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়িয়ে ২০০৭ সালের ২৮ জুন তিনি মারা যান।

মঙ্গলবার দুপুরে বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা লিরো’র কার্যালয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে সাইফুদ্দিন খানের স্ত্রী নূরজাহান খান বলেন, ‘লোহার রড দিয়ে মাথায় আঘাত করে আমার স্বামীর স্মৃতিশক্তি নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। তিনি স্বাভাবিকতা হারিয়েছিলেন। ডালিম হোটেলে যাদের কাছে আমার স্বামী নির্যাতিত হয়েছিলেন, আমি তাদের সবার শাস্তি চাই।’

মীর কাসেম আলী ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি ছিলেন। সে-হিসেবে তিনি আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার ছিলেন।

১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর ভোরে চট্টগ্রাম শহরের পশ্চিম মাদারবাড়ি এলাকায় আজিজ কলোনিতে সাইফুদ্দিন খানের বাসা থেকে তাকে ও ইরশাদ কামাল খান, পটিয়া মহকুমা ন্যাপের সভাপতি অ্যাডভোকেট নূরনবীসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে ডালিম হোটেলে নিয়ে যাওয়া হয়। ইরশাদ কামাল খান ছিলেন সাইফুদ্দিন খানের বড় ভাই ডা. কামাল এ খানের সন্তান।

ইরশাদ কামাল জানান, দু’হাত পেছনে নিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে তাদের ট্রাকে তোলা হয়েছিল। বাধ্য করা হয়েছিল, পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলতে। আলবদররা সবাই খাকি পোশাক পরা ছিল, তাদের সবার মুখে রুমাল বাঁধা ছিল। ডালিম হোটেলে নেয়ার পর তারা সবসময় নিরস্ত্র বাঙালিদের হাত রশি দিয়ে এবং চোখ কালো কাপড়ে বেঁধে রাখত। আমাদের খুব দুর্গন্ধময়, অন্ধকার, স্যাতস্যাতে একটি কক্ষে রাখা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘আলবদররা সুযোগ পেলেই এসে এলোপাতাড়ি মারধর শুরু করত, অকথ্যভাবে নির্যাতন করত। পুরো কক্ষে শোনা যেত শুধু গোঙানির শব্দ। কেউ কাতরাচ্ছেন, কেউ পানি, পানি বলে চীৎকার করছেন। দু’হাত, চোখ বাঁধা অবস্থায় অনেকেই কক্ষের ভেতরেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেন।’

তিনি বলেন, ‘একদিন আমি শুনতে পেলাম, একজন খুব ক্ষীণ কণ্ঠে মা, মা বলে চীৎকার করছেন। পরে বুঝতে পারলাম, তিনি ছিলেন আমার চাচা সাইফুদ্দিন খান। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিনি এভাবে চীৎকার করছেন। অবিশ্বাস্য রকমের নির্যাতন করত তারা। জীবিত ফিরতে পারব একথা কখনও কল্পনাও করিনি।’

অন্যদিকে নূরজাহান খান বলেন, ‘মুক্ত হওয়ার পর সাইফুদ্দিন খান বলেছিলেন, তাদের লাথি মারত, লোহার রড দিয়ে পেটাত। পানি চাইলে মুখের উপর প্রস্রাব করে দিত। মরে গেলে লাথি মেরে ডালিম হোটেলের পাশে টিনের ছাদের ওপর ফেলে দিত। মুখের উপর মাছি ভনভন করতে দেখলে অন্যরা বুঝতে পারত আর বেঁচে নেই। আমার স্বামীকে ফিরে পাব, এটা আমি কখনোই ভাবিনি।’

ইরশাদ কামাল খান বলেন, ‘আলবদররা কেউ এলে আর্মি স্টাইলে স্যালুট দিতেন। তবে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতেন। কারও নাম বলত না। এ কারণে সেসময় তাদের পরিচয় জানা সম্ভব ছিল না। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড সংস্কৃতির অনুসারী। তবে তারা যে ইসলামী ছাত্রসংঘের সঙ্গে জড়িত সেটা জানতাম।’
ইরশাদ কামাল খান জানান, তাকে ডালিম হোটেলে চারদিন রাখা হয়েছিল। পরে একটি কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই কাগজে লেখা ছিল, আওয়ামী লীগ ও ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত। আমি না বুঝে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। আমি এজন্য অনুতপ্ত।’
তিনি জানান, চারদিনে তাকে দু’একবার তাকে পান্তা ভাত আর মাছের কাঁটা খেতে দেয়া হয়েছিল। ক্ষুধার কারণে এ খাবারই তিনি তৃপ্তি নিয়ে খেতেন।
নূরজাহান খান জানান, তার স্বামীকে ২০ নভেম্বর জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৭ ডিসেম্বর তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান।
নূরজাহান খান বলেন, ‘মীর কাসেম আলীসহ যুদ্ধাপরাধীদের অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে, বিচার শুরু হয়েছে। আমরা তাদের শাস্তি দেখতে চাই। একসিঙ্গে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হোক। যেন তাদের অর্থের উৎস ধ্বংস হয়ে যায়। তারা যেন দুর্বল হয়ে যায়, যাতে তারা এ বিচার বন্ধের ষড়যন্ত্র করতে না পারে।’
ইরশাদ কামাল খান বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি নির্যাতনকারীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। কারা এ নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত তা জানার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তখন সবাই পালিয়ে গিয়েছিল। এরপর আমি বিদেশে চলে যাই। তারপর তো ১৯৭৫-এ দেশের পরিস্থিতিই পাল্টে যায়। উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করে দেশ। যা হোক, এখন ৪০ বছর পর যখন বিচার শুরু হয়েছে তখন আমি এ বিচারের শেষ দেখতে চাই।’
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আদেশে গত রোববার বিকেলে রাজধানীর মতিঝিল থেকে জামায়াতের মজলিশে শূরার সদস্য মীর কাসেম আলীকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে কারাগারে পাঠানো হয়।
- রমেন দাশগুপ্ত
http://www.ebanglanews24.com/Bangla/detailsnews.php?nssl=dd991b5b954e8bd574dd0e770ea07988&nttl=20062012120639

No comments:

Post a Comment