Thursday, June 26, 2014

হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের সময় নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা

 সোমবার ঢাকা ৮ এপ্রিল ২০১৩, ২৫ চৈত্র ১৪১৯, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৩৪

হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের সংবাদ সংগ্রহের সময় একুশে টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার নাদিয়া শারমীনসহ নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন মহল। গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে নারী সাংবাদিক কেন্দ্র, জাতীয় কন্যা শিশু অ্যাডভোকেসি ফোরাম, কর্মজীবী নারীসহ বিকশিত নারী নেটওয়ার্ক সমাবেশ করে এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। আরো প্রতিবাদ জানিয়েছে জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, বামমোর্চা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। এদিকে নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আগামী ৯ এপ্রিল প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সমাবেশ করা হবে। নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) ভাইস চেয়ারম্যান মনজুরুল আহসান বুলবুল, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা আবদুল জলিল ভূঁইয়া, নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু, সহ-সভাপতি দিল মনোয়ারা মনু, সাধারণ সম্পাদক পারভীন সুলতানা ঝুমা, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নারীবিষয়ক সম্পাদক আইরিন নিয়াজী মান্না, নাদিয়ার বড় বোন অ্যাডভোকেট সাদিয়া আফরিনসহ আরো অনেকে। এতে সংহতি জানিয়েছে, গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার ও বেসরকারি সংস্থা ব্লাস্টসহ আরো অনেকেই। ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, তারা যে আচরণ করেছে এতে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানে তালেবানরা নারীদের যেমন পশ্চাৎপদ করে ফেলেছিল, বাংলাদেশেও তেমন পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, হেফাজতে ইসলামের দেয়া ১৩ দফা দাবি কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। নাসিমুন আরা হক মিনু বলেন, তারা যে ১৩টি দাবি করেছে তার কোনোটিই বাংলাদেশের পক্ষে নয়। দেশের গার্মেন্টস শিল্পের ৯০ শতাংশ শ্রমিক নারী। এসব নারী যদি কাজ বন্ধ করে ঘরে চলে যায়, দেশের অর্থনীতির কি হবে? 
গত শনিবার হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার নাদিয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, শনিবার বেলা ১২টার দিকে লম্বা পাঞ্জাবি পরা কয়েকজন এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে আপনি মহিলা মানুষ, আপনার এখানে কি? আপনি এখান থেকে চলে যান। উত্তরে আমি বলি, আমি মহিলা না, একজন সাংবাদিক। সংবাদ সংগ্রহ করতে এখানে এসেছি। একথা শেষ হওয়া মাত্র হেফাজতের ৫০-৬০ জনকর্মী আমার দিকে তেড়ে আসে, আমাকে আচমকা চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে। আমি সেখান থেকে দ্রুত চলে আসার চেষ্টা করি, এরপরও তারা আমাকে পেছন থেকে পানির বোতল ইট ছুড়ে মারতে থাকে।
তিনি বলেন, ওরা আমাকে পরিকল্পিতভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল। সহকর্মীরা এগিয়ে না এলে ওরা আমাকে মেরে ফেলত। পল্টন মোড় থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত ওরা আমাকে মারতে মারতে ৬ থেকে ৭ বার ধাক্কা দিয়ে রাস্তায় ফেলে এলোপাতাড়ি লাথি মারে। উঠে দৌড়ানো শুরু করলে পেছন থেকে আবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়, মাথায় লাথি মারে। বারবার তারা আমার কাপড় টেনে-হিঁচড়ে কিল ঘুষি মারে। 
নাদিয়া বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। তাকে হাসপাতালে দেখতে গেছেন গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার, কর্মজীবী নারীর শিরিন আখতার, নাট্যকর্মী রোকেয়া প্রাচীসহ আরো অনেকে। হাসপাতালে দেখতে গিয়ে ইমরান এইচ সরকার বলেন, যারা একজন নারীকে হেফাজত করতে পারেন না তারা কিভাবে ইসলামের হেফাজত করবেন?
এছাড়া শনিবার ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সাংবাদিক আরাফাত আরা পল্টন মোড়ে তার অফিসে যাওয়ার পথে হয়রানির শিকার হন। তিনি হেঁটে অফিস যাওয়ার পথে তার পথরোধ করে তাকে মাথায় কাপড় দিয়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বলে। একই ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন, বাংলানিউজের চিফ ল করেসপনডেন্ট জাকিয়া আহমেদ। তিনি জানান, কর্ণফুলী গার্ডেন সিটির কাছে দায়িত্বপালনকালে একজন মিছিল থেকে ওই মাইয়্যা মাথায় কাপড় নাই ক্যান বলে চিৎকার করে ওঠে। একথা শুনে জাকিয়া ভয় পেয়ে যান। মিছিলের অন্যরা এ সময় নারী সাংবাদিকদের নিয়ে বাজে মন্তব্য করতে থাকে। শুধু ঢাকায় নয় চট্টগ্রামে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে হামলার শিকার হন সাংবাদিক সুমি খান। 
নারীবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার ঘোষণা নারী সমাজের : হেফাজতে ইসলাম কর্তৃক নারী সাংবাদিক নির্যাতন, পথচারী নারীদের নাজেহাল করা এবং নারীর প্রতি অবমাননামূলক বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে নারীবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে নারী সমাজ। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নারীদের অংশগ্রহণে এক মানববন্ধন থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। সমাবেশ থেকে এ ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকায় নারী মহাসমাবেশের ডাক দেয়া হয়েছে। তবে সমাবেশের তারিখ এখনো নির্ধারণ করা হয়নি।  
ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানমের সভাপতিত্বে সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা জলি তালুকদারের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জাসদের শিরিন আক্তার, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো সদস্য হাজেরা সুলতানা, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, সমাজতান্ত্রিক মহিলা ফোরামের শম্পা বসু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েন, জোবেদা নাসরিন কণা, রোকেয়া প্রাচী, অ্যাডভোকেট সালমা আলী, গণজাগরণ মঞ্চের নেত্রী লাকী আক্তার, গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী নাসিমা আক্তার প্রমুখ। 
সমাবেশে শিরিন আক্তার বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তিনি বলেন, ধর্মের নামে নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। মেয়েরা কাজ করতে পারবে না এমন কথা ইসলামে নেই। কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীদের অগ্রগতি যখন সারাবিশ্বে আলোচিত, তখন নারীদের ওপর হামলা এবং তাদের অগ্রযাত্রার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। 
হাজেরা সুলতানা বলেন, ইসলাম রক্ষার নামে নারী নির্যাতন বন্ধ করে নারীবিদ্বেষী এই দলকে প্রতিহত করতে হবে। এসব মৌলবাদীদের হাত ভেঙে দিতে হবে। তাদের ডাকা হরতাল প্রতিহত করার ঘোষণা দেন তিনি। 
সমাবেশে সংহতি জানান, সাংস্কৃতিকব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, সংগীত শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, স্টেপস টুওয়ার্ডস ডেভেলপমেন্ট, নারী প্রগতি, কর্মজীবী নারী, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাবি রোকেয়া হল শাখা, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, বাঁচতে শিখ নারী, ইয়ুথ অ্যান্ড হাঙ্গার, হাজারীবাগ ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, জাতীয় শ্রমিক জোট, স্বাধীন বাংলা গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ মুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম, বিপ্লবী নারী ফোরাম, জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদ : দায়িত্বপালনকালে নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ পরিবার এ সমাবেশ করে। নাদিয়া এ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন বিভাগের চেয়ারম্যান গীতি আরা নাসরিন,  সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদুল হক, অধ্যাপক শেখ আব্দুস সালাম, য. আবুল মনসুর আহমদ, টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজীব মীরসহ অন্যরা। গীতি আরা নাসরিন বলেন, এই হামলা কেবল একজন নারী সাংবাদিকের ওপর নয়, দেশের সব নারীর ওপর হামলা, দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা। তিনি হামলাকারী এবং তাদের সহযোগীদের শাস্তি দাবি করেন। ফাহমিদুল হক বলেন, এই হামলায় নারী সমাজকে হেয় করা হয়েছে এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত আনা হয়েছে। 
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর নিন্দা : এদিকে একুশে টেলিভিশনের রিপোর্টার নাদিয়া শারমিনের ওপর বর্বোরচিত হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। গতকাল বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন একুশে টেলিভিশনের রিপোর্টার নাদিয়া শারমিনের শারীরিক অবস্থার খোঁজ-খবর নেয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রতিমন্ত্রী বলেন, একজন গণমাধ্যম প্রতিনিধির ওপর হামলা অত্যন্ত নিন্দনীয়। নারী সাংবাদিকের ওপর হামলায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।
- See more at: http://manobkantha.com/2013/04/08/115720.html#sthash.PHf30PbE.dpuf

No comments:

Post a Comment