Tuesday, July 23, 2013

বাবা-মা এবং মামা বিশ্বজয়ী বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা নিলেন বিপ্লবী নিবেদিতা নাগ এবং নেপাল নাগের পুত্র সুজয় নাগ


চট্টগ্রাম: ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কলকাতার বাড়িটি ছিল ট্রানজিট ক্যাম্প। বাংলাদেশ থেকে দলে দলে লোকজন আসতেন। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া ক্লান্তশ্রান্ত মানুষগুলোকে চিকিৎসা-শুশ্রূষা আর গন্তব্য ঠিক করে দিতেন বাবা-মা। বাবা বলতেন, যুদ্ধে যতটা বন্দুকের দরকার ততটা চিকিৎসাসেবা-ওষুধ দরকার।’
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ কমরেড নেপাল নাগ ও নিবেদিতা নাগের ছেলে এবং বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের ভাগিনা প্রকৌশলী সুজয় নাগ বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘তখন আমি জামশেদপুর থাকতাম। শনিবারে বাড়ি আসতাম। প্রতি সপ্তাহে এসে দেখতাম নতুন নতুন লোকজন। বাবা-মা বলতেন আগের সপ্তাহের লোকজন চলে যাওয়ার পর আরও দু-একটি দল ইতিমধ্যে চলে গেছে। খুব কাছে থেকে সেবামূলক কাজ দেখার, করার সুযোগ পেয়েছিলাম।’
শনিবার বাংলাদেশ সরকারের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বাবা-মা ও মামার পক্ষে সম্মাননা স্মারক নিতে এসেছিলেন ছেলেসহ সুজয় নাগ। এরপর মায়ের স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে আসেন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা, পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেনের আমন্ত্রণে। তার কথায় উঠে আসে কিংবদন্তিতুল্য বাবা-মা’র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক জীবন, শৈশবের নানা অনিশ্চয়তা, যুদ্ধকালীন নানা ঘটনা, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি। শোনা যাক তার মুখেই-
শৈশবে আমার নাম ছিল সুজাউদ্দিন!
কমরেড নেপাল নাগ ও নিবেদিতা নাগের ছেলে হওয়ার কারণে আমাকেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে হয়েছে। ঢাকার অনেক বন্ধু তখনও জানত না সুজাউদ্দিন নামে পরিচিত আমার আসল নাম সুজয় নাগ। তারা জানত আমি রহমান ভাই (নেপাল নাগ) ও রিজিয়া ভাবির (নিবেদিতা নাগ) ছেলে। বাবার বন্ধুরা আমাকে ডাকতেন ‘টিটো’।
‍বাবা ডাকতেন ‘মন্টু’।
অবশ্য বাবাও বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন পার্টির কমরেড ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। কখনো শৈলেশ নাগ, কখনো পরেশদা।
বাবা-মা’র কারণে শৈশব কেটেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে
১৯৪৫ সালে আমার জন্ম। কয়েকবছর পরই দেশ ভাগ হলো। বাবা-মা পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করার দায়িত্ব নেন। ১৯৪৮ সালে সরকার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে। দমবন্ধ অবস্থা। কখনো দাদুর বাড়ি কলকাতায়, কখনো মাদারীপুরে বা ফরিদপুরে মা’র ছোট কাকার বাড়িতে। বেশিরভাগ সময় কেটেছে ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনে কিংবা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের তাঁতির বাড়িতে। একটি বিষয় বলতে দ্বিধা নেই, আমার মা একমাত্র জীবিত ভারতীয় ভাষাসৈনিক। তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে দুবার অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। একবার ৩৮ দিন, আরেকবার ৪০ দিন।
আমি ছিলাম সেক্রিফাইসের ভিকটিম
বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার-প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাবা। তাকে অহর্নিশ প্রেরণা ও সাহস জুগিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছেন মা। কখনো বোরকা পরে মুসলিম সেজে মা পালিয়ে বেঁচেছেন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে। সঙ্গে আমিও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাবা-মা’র অকৃত্রিম সহযোগিতাসহ সব ক্ষেত্রে আমি ছিলাম সেক্রিফাইসের ভিকটিম। একাত্তর কিন্তু একাত্তরে জন্মায়নি। একাত্তরের ভিত্তি বাহান্নে।
৭ দিন পরই বিদ্রোহ করেছিলাম
একপর্যায়ে ডেমরাতে এক তাঁতির বাড়িতে রাখা হয়েছিল আমাকে। তখন আমার বয়স ছিল ৪ বছর। যাতে হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বাবা নদী পেরিয়ে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতে পারেন। ১৯৪৯ সালে মা ছিলেন তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ। আমি কিন্তু ৭ দিন পরই বিদ্রোহ ঘোষণা করি, খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট। ওই তাঁতির বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আরেকবার আমি বাবার সঙ্গে মস্কো গেলাম, হোটেল থেকে বেরোতেই দিল না, রাজনীতিবিদের ছেলে বলেই।
কলমি শাক দেখে হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন মা
মা ছিলেন ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদিকা। এর আগে চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ও চট্টগ্রাম নারী সমিতির (পরে আত্মরক্ষা সমিতি) সম্পাদিকা ছিলেন। চট্টগ্রামে মা থাকতেন তার দাদা জ্ঞানেন্দ্র লাল দত্তের কাছে। কিছু দিন পর ঢাকা শহরের মুসলিম গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হন। ১৯৪১ সালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মা, ছিলেন তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ। ইলিয়ট, শেকসপিয়র মুখস্থ বলতে পারতেন। সে যাই হোক একদিন গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে ছিলেন মা। পথে কলমি শাক দেখে গাড়ি থামালাম। কয়েক আঁটি নিলাম। অমনি মা হাউহাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর শান্ত হলে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে পড়েছিল। উনি (বাবা) ছিলেন পার্টির বিপ্লবী সদস্য। তখন সকালে ছোলা ভিজানো, দুপুরে কলমি শাক আর ভাত এবং রাতে ভাতের ফ্যান ও নুন খেতে হতো আমাদের। এভাবে চলত দিনের পর দিন। তোমার মনে পড়ে সেই‍ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাঁতির বাড়ি থেকে ফিরে আসার কথা।’
বাবা চেয়েছিলেন রাজনীতি করি
আমৃত্যু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির স্বপ্ন দেখা বাবুজি (বাবা) চেয়েছিলেন আমি রাজনীতিতে যুক্ত হই। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আগেই বলেছি আমি বড় হয়েছিলাম আন্ডারগ্রাউন্ডে। ১৯৪৭ সালে থাকতাম কলকাতার বড়বাজারে এক পার্টি কমিউনে। মাড়োয়ারিদের মধ্যে মিশতাম বলে আমিও বাবুজি, মাইজি ডাকতে শিখেছিলাম বাবা-মাকে। অবশ্য আমার বোন মুন্নি ঢাকার পার্টি কমিউনে বড় হয়েছিল, সে বাবা-মাকে ডাকত আব্বা আম্মা।
যাই হোক, উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর একদিন বাবুজি বললেন, ‘তুমি কি রাজনীতি করতে চাও না আর কিছু ভাবছ?’ আমি বললাম, ‘রাজনীতি করব না।’ কারণ রাজনীতির জন্য বাবা-মা’কে দেখেছি অমানবিক কষ্ট, লাঞ্ছনা আর দুর্ভোগ পোহাতে। আমি শ্রদ্ধা করতাম, বাবার জন্য গর্ব হতো। কিন্তু ওই বন্ধুর পথ মাড়াতে চাইছিলাম না। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা ঠিক ‘আমার সিদ্ধান্তে বাবা আপত্তি করেননি, পরে বুঝেছিলাম দুঃখ পেয়েছিলেন অথচ মুখে কিছুই বলেননি।
বাবার উপদেশ ছিল ‘সাহায্য করো, চিল হতে চেষ্টা করো’
বাবা আমাকে বলতেন, ‘যে সাহায্য চাইবে তাকে সাহায্য করবে। সাহায্য করতে ইচ্ছেশক্তি লাগে, পয়সা লাগে না। কখনো মনে করো না যে, যাকে সাহায্য করবে সে তোমায় মনে রাখবে। তাহলে কষ্ট পাবে।’
টাটা কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য ট্রেন ধরব। হাওড়া স্টেশনে গেলাম। ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তে বাবা বললেন, ‘নতুন চাকরিতে যাচ্ছ। মনে রেখ কাকও পাখি আবার চিলও পাখি। কাক নিচে ওড়ে খাবার দেখলে সবাই মিলে ঠোকরায়। কোনোটা পায় কোনোটা পায় না। চিল অনেক উপরে ওড়ে। কিন্তু খাবার দেখলে নিচে এসে খাবার নিয়ে আবার উপরে চলে যায়। চাকরি জীবনে চিল হওয়ার চেষ্টা করো।’
মামা আইনস্টাইনের মতো না শিখেই অদ্ভুত ভায়োলিন বাজাতেন
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মামা সত্যেন্দ্রনাথ বোস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টি করেছিলেন। বিশেষ করে বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এসব আলোচনা থাক। অন্য প্রসঙ্গে যাই। আমার মামার কতগুলো অদ্ভুত গুণ ছিল। তিনি কোনোদিন ভায়োলিন বাজাতে শেখেননি, কিন্তু রোজ সকালে অসাধারণ বাজাতেন। আইনস্টাইনও ভায়োলিন বাজাতে শেখেননি, কিন্তু অনবদ্য বাজাতে পারতেন। এ দিক দিয়ে ‍দুজনের মিল ছিল। বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করত।
শওকত ওসমান’র ‘দরগা রোডের দরগা’
বাংলাভাষার লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাশিল্পী শওকত ওসমান আমার বাবা সম্পর্কে তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘নেপাল নাগ। শ্রমিক নেতা নেপাল নাগ। একদা নারায়ণগঞ্জের মুসলমান শ্রমিকদের মধ্যে রহমান ভাই নামে পরিচিত ছিলেন। বিধ্বস্ত শরীরে কলকাতায় আশ্রিত। রহমান ভাইয়ের দরগা রোডের দরগায় গিয়েছিলুম। মানত শুধতে নয়, বুকে অনেক তাগদ ফিরে পাওয়া গেল।’ শওকত ওসমানের ভাষায়, ‘বর্তমান বাংলাদেশে বহু মুক্তিমানব নেপালদার সৃষ্টি বলা চলে।’
চাকরিসূত্রে বাংলাদেশে ছিলাম ৯ বছর
১৯৭০ সাল থেকে ৪০ বছর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হাউসে (টাটা) কাজ করেছি। ৯ বছর ছিলাম চাকরিসূত্রে বাংলাদেশে। ২০০৮ সালে ফেরত গিয়েছিলাম। লক্ষ করেছি স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া দরকার তা হলো যানজট নিরসনের ব্যবস্থা। হয় গাড়ি কমাতে হবে নয়তো রাস্তা বড় করতে হবে, উন্নত পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আশাকরি, দেশপ্রেমী, যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা বিদেশি বন্ধুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার চতুর্থ পর্ব। এতে ৯টি দেশের ৬০ ব্যক্তি ও দুটি সংগঠনকে সম্মাননা জানানো হয়। এসব ব্যক্তি ও তাদের প্রতিনিধির হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলানিউজ
19 Dec 2012 12:32:51 PM Wednesday BdST

No comments:

Post a Comment