Monday, July 22, 2013

আসুন, বীরাঙ্গনা হীরামনির পাশে দাঁড়াই- কেয়া চৌধুরী


মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গনারীর অংশগ্রহণ, তার ত্যাগ ও বলিদানের ইতিহাস আজও এক অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়। এ ইতিহাস সবার জানা, কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে বিষয়টি আলোচিত না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্জগতেই বন্দী অবস্থায় রয়েছে বীরাঙ্গনার ত্যাগের ইতিহাস। তাই বীরাঙ্গনারা চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন এখনও। বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন সমাজে দেখা যায় না। অনেকে বলেন, বীরাঙ্গনারা নাকি ঘরের বাইরে আসতে চান না। পরিচয় গোপন করেন। কথাটা ঠিক নয়। বরং তারা বের হতে পারেন না। সমাজ-রাষ্ট্র তাদের বের হতে দেয় না। চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জের সাংগঠনিক কাজের সুবাদে আমি এ বিষয়ে কাজ করছি ৮ বছর। চেতনায় ’৭১ এ পর্যন্ত সন্ধান পেয়েছে মোট ১০ জন বীরাঙ্গনার। তাঁরা কেউই আমাদের কাছে ছুটে আসেননি। বরং আমরা ছুটে গেছি তাঁদের দুয়ারে। মোটা দাগে বলা যায়, তাদের প্রত্যেকের জীবনে একটি বিষয় সত্য, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরও বীরাঙ্গনারা ভাল নেই। সেটা কেবল আর্থিক দিক দিয়ে নয়, শারীরিক, মানসিক এমন কি পারিবারিক পরিম-লেও তাঁরা ভাল নেই। আত্মসম্মান নিয়ে জীবন চালানো তাঁদের জন্য বড় দায়। নিজ পরিবারের সদস্য দ্বারা তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত। কর্কশ বাক্য-সন্ত্রাসে তারা আহত, জর্জরিত।
’৭১-এর দুঃসহ স্মৃতি তাঁদের এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা এখনও অতঙ্কগ্রস্ত এ কথা ভেবে যে, পাছে না আবার এ নিয়ে কষ্ট পেতে হয়। খুব কাছ থেকে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এটুকু বলতে পারি: আমার, আপনার একটুখানি সম্মান একটু খানি নির্ভরতা তাদের জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে পারে। তাতে নিজের প্রতি ফিরে আসতে পারে তাদের আত্মবিশ্বাস।
বীরাঙ্গনারা যখন কথা বলেন, তখন লজ্জায় নত হই। সেই ৭১ থেকে আজ পর্যন্ত কত যে অসহায়, বঞ্চিত বীরঙ্গনা! অথচ আমরা ইতিহাস হতে জানতে পাই, ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবনার এক জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পাকসেনা দ্বারা নির্যাতিত বঙ্গনারীদের বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করে বলেছিলেন, “বীরাঙ্গনারা দেশের জন্য ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ ওপরে। তাই জাতিকে তাদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে বীরাঙ্গনাদের।” কিন্তুু আজকে দুঃখ নিয়ে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নে তৎপর, শহীদ, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হলেও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে নেই কোন তালিকা। তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোন উদ্যোগ। আমরা বিদেশী বন্ধুর ত্যাগের কথা স্মরণ করি, কিন্তুু বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানাই না !
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২০০৯ সাল হতে হবিগঞ্জের ৮ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করা হয়, কিন্তুু বাস্তবতা হলো,আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই!
মনে হচ্ছে, সময় আর হাতে নেই। বীরাঙ্গনারা জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। এবার সবাইকে জানাতে হবে তাঁদের দূরবস্থার কথা। বীরাঙ্গনাদের কষ্টের কথা জেনে যদি আমরা অন্তত ভাবি নিজেদের দায়িত্বহীনতার কথা । যদি মনে তাগিদ জাগে এদের জন্য কিছু করার। তবে শেষমেশ কিছু একটা হয়ত হবে।
আজ এক বীরাঙ্গনার কথা বলতে চাই। নাম তাঁর হীরামনি সাঁওতাল। বয়স প্রায় ৬৭। তিনি থাকেন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার চানপুর চা-বাগানের লোহারপুল বস্তিতে। স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল আর নেই। দুটি কন্যা সন্তান তাঁর। কিন্তু রোজগেরে নয়। আছে দৈন্য। অভাব-অনটন। দীর্ঘ মেয়াদে অনাহার, শ্বাসকষ্ট তাঁকে আর মানুষ রাখেনি, করেছে জীবন্ত কংকাল।
চানপুর চা-বাগানের বস্তিতে হীরামনি এখন কেবলই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। হীরামনি জীবনবোধের জটিল হিসাব না বুঝলেও জটিল এক বাস্তবতা তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে তার মনের অজান্তেই। অথচ তাঁর জীবনে চাওয়া- পাওয়া বলতে কখনই তেমন কিছু ছিল না। দুবেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত, বছরে দুটি মোটা কাপড় নিয়মিত চা-শ্রমিক হিসেবে চা-বাগানের একটা চাকরি, কোম্পানির দেয়া কিছু রেশন । এই তো! কিন্তুু ভাগ্যের কি পরিহাস, তার কোনটিই জোঠেনি। অভাবে, শরীরের উপর দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম-অনাহার আর যেন সইছে না। সকালে খালি পেটে এক গ্লাস জল তার সঙ্গে এক মুঠো শুকনা চালের গুঁড়া এ দিয়ে দিন পার। দিনের সময় যত বাড়ে মুখের তেতো ভাব তত যেন বাড়তে থাকে। পাখির মতো ছটফট করতে থাকে হীরামনির বুকের ভিতরটা। শ্বাসকষ্ট বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। প্রাণটা যেন যায়-আসে করে। বেলা যত গড়ায়, সূর্যটা আকাশে যত চমকায়, জানালাহীন অন্ধ কুঁড়েঘরটা তত যেন গুমট হয়ে যায়। মনে হয় কোন গুহার বাসিন্দা হীরামনি। মাথার পাশে মাটির চুলা। নেই রান্না-বান্নার সামান্যতম আয়োজন। কালিযুক্ত দু’চারটি হাঁড়ি দেখলে বোঝা যায় কত দৈন্য এখানটায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার বাতাসহীন ঘরে এভাবেই কাটছে বীরাঙ্গনা হীরামনির কষ্টের জীবন।
জানুয়ারিতে হীরামনির কিছু চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। পরীক্ষায় ধরা পড়ল নানা রোগ। ডাক্তার বলেন, হীরামনির শরীর খুব দুর্বল। তার উপর শ্বাসকষ্ট। সিভিল সার্জন নিজে তদারকি করে বিনামূল্যে কিছু ওষুধ দিলেন হাসপাতাল থেকে। ওষুধগুলো কাপড়ের পুটলায় ভরে বাসে চড়ে, চা-বাগানের আঁকাবাঁকা পথে বাড়ি ফিরলেন হীরামনি। ওষুধ খাওয়া শুরু হলো। একটু শ্বাসকষ্ট কমলেও রক্ষা হলো না। ওষুধের সঙ্গে খাবারটা ঠিকঠাক মতো চাই। কিন্তু হীরামনির সে সঙ্গতি কি আছে? ব্যক্তিগতভাবে কারও ৫০০/১০০০ টাকার সাহায্যে কি হয়! ক’দিনই চলে?
হীরামনির স্বামী মারা গেছে অনেক দিন হলো। দুটি মেয়ে, সহরমনি ও সজনি। সহরমনি ও সজনীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও চা-শ্রমিক। তবে স্থায়ী চাকরি নেই তাদের। সন্তানাদি নিয়ে তারাও কষ্টে আছে। বৃদ্ধ চা-শ্রমিক হয়েও হীরামনি বাগান থেকে বাড়তি কোন রেশন পান না! ঠিক কত দিন আগে হীরামনি দু’বেলা পেট পুরে ভাত খেয়েছে তা যেন স্মৃৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসে । বিচিত্র এ জগত সংসারে এ মানুষটি এমন অসহনীয় জীবন যেন আর বইতে পারছেন না। স্থির দুটি চোখ অনেক কষ্টে কেবলই চেয়ে থাকে। দুর্বলতায় সবই ঝাপসা দেখায়। হীরামনির মুখের শব্দ বেশ ভারি। কথা জড়িয়ে যায়, ঠিক বোঝা যায়না।
ভ্যাপসা গরমে মুখভর্তি ঘাম। তাতেও যেন চেতনা নেই তার। গত শনিবার লোহারপুল বস্তিতে সকালে গিয়েছিলাম, পাশে বসেছিলাম দুপুর পর্যন্ত। সাড়া নেই তাঁর। মাঝে, মাঝে একটু মাথা তোলেন, তারপর আবারও টান করা পায়ের ওপর শরীরটা হেলিয়ে দেয়া।
হীরামনি আমাকে দেখেছেন, তবুও কথা নেই। অনেকক্ষণ পর ঠোঁটের কোন হতে বের হয়ে এলো দুর্বলকণ্ঠে একবাক্য: ‘হামার অনেক কষ্ট, কথা কইতে ভ্যালা লাগে না।’ আমি নির্বাক।
হীরামনির মাথায় ময়লা। এলোমেলো চুলগুলোতে অনেক উকুন, তাতে বিরামহীন চুলকানি। মনে হয় চুলকানি দিতে, দিতে হীরামনি ক্ষণে, ক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। পরক্ষণে দু’পায়ের উপরে শরীরটা তুলে ধরলেন; বোধ করছি আবার ঘুমাচ্ছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হীরামনির জীবনকে কেবল তছনছ করে দেয়নি, তাঁকে সবকিছু থেকে বিছিন্ন করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানীরা যখন চানপুর চা-বাগানের অফিস ঘরে ক্যাম্প করল তার দুদিনের মাথায় হীরামনি নিজ ঘরে সম্ভ্রম হারালেন পাষ- পাক সেনাদের হাতে। হীরামনি আজও জানেন না কি দোষ ছিল তার? সেদিন ৭/৮ জনের পালাক্রমে ধর্ষণে চেতন হারিয়ে ফেলেছিলেন হীরামনি। যখন চেতন ফিরল যন্ত্রণায় শরীর যেন নড়াতে পারছিলেন না। হীরামনির দুঃসময়ে তখন তার পাশে ছিলেন স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল। দরিদ্র লক্ষণ সাঁওতালের মনটা ছিল উদার। তিনি চা-শ্রমিক হয়েও তাঁর স্ত্রীকে সবচেয়ে ভাল চিকিৎসার দেবার চেষ্টা করেছেন । মনেপ্রাণে মৃতপ্রায় হীরামনিকে তিনি সারিয়ে তুলেছিলেন পরম ভালবাসায়। হীরামনির জীবনে একাত্তরের বিভীষিকাময় অধ্যায় স্বামী হিসেবে মুছে ফেলতে সাহায্য করেছিলেন লক্ষণ; কিন্তুু পারেননি। সেদিনের পাশবিক নির্যাতন হীরামনিকে চিরতরে অসুস্থ করে দিয়েছে।
স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল না ফেরার দেশে চলে গেছেন তা তো অনেক দিনের কথা। তারপর হতে হীরামনি নিঃসঙ্গ। নিরুত্তাপ জীবন তাঁকে এলোমেলো করে দিলেও সেইদিনের দুঃসহ স্মৃতি চোখের পানিতে এতটুকু ঝাপসা হতে দেয়নি বীরাঙ্গনা হীরামনিকে। আজ-কাল প্রায়ই অভিমান গ্রাস করে হীরামনিকে। পছন্দ না হলে কথা বলতে চান না কারও সঙ্গে।
একাত্তরের জ্যৈষ্ঠ মাসের সেই নির্যাতনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত হীরামনির জীবনে আর শান্তি আসেনি। দীর্ঘ ৬৭ বছর জীবনের শেষটা হীরামনির বড় কষ্টÑ খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন চরম এক মানবেতর জীবন। হীরামনি বার বার কেবলই মৃত্যুকে কামনা করেন। মাথাটা পায়ের ওপর রেখে ভগবানকে কী তিনি এ কথাই জানান ? কে জানে !
বর্তমানে হীরামনি অসুস্থ। চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জের ডাকে হীরামনির পাশে এগিয়ে এসেছেন ডাক্তার ফৌজিয়া, বারডেম হাসপাতালের ডিজি প্রফেসর নাজমুন নাহার, ডক্টর সারোয়ার আলী। চাইলে আপনিও আমাদের সহযোগী হতে পারেন।
দুদিন হলো রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ১৩৬০ নম্বর ওয়ার্ডে হীরামনির চিকিৎসা চলছে। কে জানে তিনি সুস্থ হবেন কবে?
বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, বাজেটের আকার বছরে বছরে বাড়ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত কত গবেষণা, হচ্ছে, প্রকল্প হচ্ছে, তালিকা হচ্ছে, বরাদ্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবয় ক্ষতিগ্রস্ত হীরামনির মতো বীরাঙ্গনাদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন হচ্ছে না! এর কারণ রহস্যজনক।
বীরাঙ্গনারা অযতœ আর অবহেলায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন আমাদের চোখের সামনেই। আমরা কি পারি না হীরামনির জীবনের শেষ দিনগুলোকে একটু শান্তিময় করতে। আসুন না, যার যার অবস্থান থেকে ঝণ শোধবার কাজে হাত বাড়াই। তাদের ন্যায্য সম্মান প্রতিষ্ঠায় কাজ করি। তা না হলে আগামী ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না আমাদের।

No comments:

Post a Comment