Wednesday, March 13, 2019

সংকট মুক্তির পথে নারীর পাশে থাকুক তার মা, পরিবার এবং সমাজ-সুমি খান

  আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলো বিশ্বব্যাপী । March 8 ,2019- #BalanceforBetter প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার নারী দিবস পালিত হলো। একটু ভালোর জন্যে জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যালেন্স করে চলতে শিখতে হয় আমাদের।
 অনেকটা নীরবেই পার করেছি এবারের নারী দিবস। আমার কৈশোর থেকে নারী দিবসের প্রাক্কালে পত্র পত্রিকায় লেখা দিয়েছি। সকালবেলা মা’কে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যে দিয়ে শুরু হতো নারী দিবস। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এ দিবস পালনের রীতি ছিল । এবারে একটু দেরিতেই নারী দিবস বিষয়ে লিখতে বসলাম। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে মনে করেন অনেকে। আপাতদৃষ্টিতে তেমন মনে হলে ও বাস্তবে তা হয়েছে বলে মনে করেন না সমাজবিশ্লেষকেরাও।তবু নারীর অধিকারের লড়াইয়ের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গোৗরবোজ্জ্বল। 

এই দিবসটি উদযাপনের নেপথ্যে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে গুলি চললে নিহত হন অনেক নারীশ্রমিক।সরকারী লাঠিয়াল বাহিনীর দমন-পীড়ন চলে মিছিল কারী প্রতিবাদী নারীশ্রমিকদের উপর।
 ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়- ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে 'নারীদের সম-অধিকার দিবস' হিসেবে দিনটি পালিত হবে।
দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি - নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে।
বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তন্মধ্যে - আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া,আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা,জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ,ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা,মঙ্গোলিয়া,মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া,তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান,উগান্ডা,ইউক্রেন,উজবেকিস্তান,ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া।এছাড়া, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার,নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিনভোগ করেন। আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে নারী দিবস পালিত হলেও এখনো নারীর অধিকার প্রশ্নে পরিবার এবং সমাজ আন্তরিক ভূমিকা পালনে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে ।
নারী দিবসে বাণী দিলেন দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকে। বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোও তাদের বাণিজ্য করতে ছাড়ে নি । মীনা বাজার এর মেসেজ এলো নারী দিবসে তাদের পণ্যমূল্যে ছাড় দেবার প্রলোভন দেখিয়ে। 
পরিবার এবং সমাজে নারী তার প্রাপ্য সম্মান থেকে এখনো বঞ্চিত । এ কারণে নারী দিবসে ঔদার‌্য দেখাতে যারা বাণী দিলেন, তাদের নিজেদের বোধ ও বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা আছে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। নারীর মাতৃত্ব যাদের কাছে দুর্বলতা , তাদের শঠতা ,নীচতা আর হঠকারীতার কাছে কেন বিকিয়ে যায় জীবনের দায়িত্ব! নারী তার পরিবারেই বঞ্চিত হয় প্রাপ্য সম্মান থেকে।কবে এর অবসান হবে? বিবাহিত নারীর প্রতি স্বামী কর্তৃক সহিংসতা-সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের রিপোর্টে এ সহিংসতার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে কমে হয়েছে ৮০ শতাংশ। আবার পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা-বিষয়ক মামলা রুজুর হার বেড়ে চলেছে। যেমন: ২০১০ সালে সারা দেশে এ বিষয়ক মামলা রুজু হয়েছিল মোট ১৭ হাজার ৭৫২টি, সেখানে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২২০টি। এই দুটি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে একদিকে নারীর প্রতি সহিংসতার হার কমছে, আবার এ ধরনের সহিংস ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। অর্থাৎ নারী আইনের পথে তার বঞ্চনা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজে নিচ্ছে। জয় হোক নারী অধিকারের। আইনী পথে প্রতিকার খুঁজে নেবার পর ও পরিবার নারীকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এমন দৃষ্টান্ত খুবই হতাশাব্যঞ্জক !
২০১৯ সালের নারী দিবসের অঙ্গিকার হোক এ ধরণের সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্ত করতে হবে সমাজকে। নারীর প্রতিটি সংকটে পাশে থাকুক তার জন্মদাত্রী মা এবং পরিবার ; সংকট থেকে উত্তরণের পথে একাত্ম হোক । 
নারী মুক্তি মানব মুক্তির পথ খুলে দেয়। এ কারণেই নারী দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য’  সমান চিন্তা, বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণ, পরিবর্তনের জন্য উদ্ভাবন', যা সেই সব পরিকাঠামো, ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে চিহ্নিত করে, যেগুলো গড়ে উঠেছে পুরুষ নির্ধারিত সংস্কৃতির আলোকেই। পুরুষ শাসিত সমাজে বেড়ে ওঠা নারী এখনো বিব্রত হয় কন্যা সন্তানের অধিকারের লড়াইয়ে একাত্ম হতে। পুরুষ নির্ধারিত সংস্কৃতির আলোকে বন্দী নারী নিজের অজান্তে অথবা সচেতন ভাবেই ডুবে যায় অন্ধকারের অতল গর্ভে!তবে কি  কন্যা সন্তান এখনো নিরাপদ নয় জন্মদাত্রী মায়ের ছায়াতে থেকেও?
   মায়ের ছায়া যদি ঢাকা পড়ে যায় পুরুষতান্ত্রিকতার দাপুটে  সংস্কৃতির আলোছায়ার খেলায়, অসহায় কন্যার বেঁচে থাকার অধিকার লুঠ হয়ে যায়!
আইনি সুরক্ষায় ক্ষেত্রবিশেষে নারী কোনরকমে রক্ষা পেলে ও পুরুষ নির্ধারিত এবং পরিচালিত সংস্কৃতির প্রতি অন্ধ পরিবারের দায়িত্বহীন বিরূপ অবস্থান সংকটময় করে তোলে নারীর জীবন ও ভবিষ্যৎ।
 সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের জয় হোক! সফল হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবস!
 সুমি খান: সম্পাদক, সূর‌্যবার্তানিউজডটকম
১৩ মার্চ, ২০১৯, ঢাকা

No comments:

Post a Comment