Sunday, February 11, 2018

জামায়াতের সংবিধানবিরোধী অবস্থান ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম নিষিদ্ধের জন্য রীট পিটিশন ও অন্যান্য


কী যে হলো, হঠাৎ একদল হুজুর সংবাদ সম্মেলন করে ‘ফতোয়া’ জারি করে বসলেন।
 এর আগে কোন মৌলানা দলকে তো কখনই ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যাকারী, বাঙালী নারীর ধর্ষক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা বা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সেনা, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের হোতাদের বিরুদ্ধে ‘তারা কাফের, তারা জেনাকারী, হত্যাকারী হিসেবে যে স্বাধীনতার তারা বিরুদ্ধাচারণ করেছে, সেই স্বাধীন দেশে তাদের ঠাঁই হবে না,’ বলে এমন কোন ফতোয়া দিতে শুনিনি। তারা তো ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বা মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে এ যাবতকালের সবচেয়ে বড় অপরাধী। ফতোয়া যদি কেউ দিতে উদ্বুদ্ধ হতেন, তবে এদের ফতোয়া দিয়ে রাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের দাবি করতেন। মাঝখান থেকে তসলিমা নাসরিন বা দাউদ হায়দারকে তালেবানপন্থী একদল কট্টর জঙ্গীবাদী মোল্লা দেশছাড়া করেছিল ,যে দেশের স্বাধীনতায অর্জনে সেই ঘাতক ফতোয়াবাজ মোল্লাদলের কোন অবদান ছিল না।
তরিকত ফাউন্ডেশন যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের সংবিধানবিরোধী অবস্থান ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যক্রম নিষিদ্ধের জন্য রীট পিটিশন করে হাইকোর্টের কাছ থেকে একটি কাঙ্খক্ষত ঐতিহাসিক রায় জনগণকে উপহার দিয়েছে, এজন্য তাঁরা ধন্যবাদার্হ।
কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, মুসলিম দেশগুলোতে বা ভারতেও মুসলিম নারীরাই মুসলিম পুরুষের অন্যায় ফতোয়ার শিকার হয়েছে। আশ্চর্য হলেও সত্য এই যে, এই মৌলানারা কোন নারীর সন্তান, কোন নারীর কাছ থেকে তাঁরা বিবাহিত জীবনের আনন্দ লাভ করেছেন, কেউ বা প্রেম লাভ করেছেন, তাঁদের সবারই আছে পুত্র ও কন্যা, বোন, খালা, চাচি, ফুফু। নয় কি? 

তারপরও দেখা গেল, শ্বশুরের দ্বারা ধর্ষিতা নারীটি তার স্বামীর (স্বামীর মতে) সঙ্গে থাকতে চাইলেও ফতোয়াবাজ মৌলানারা শ্বশুরের সঙ্গে থাকার আদেশ দেয়। রাজিব গান্ধীর উদ্যোগে মুসলিম নারীদের সমঅধিকারের আইনটি দিল্লীভিত্তিক মুসলিম মৌলানাদের দলের প্রবল বাধার কারণে সংসদে পাস হতে পারেনি। শ্বশুর দ্বারা পুত্রবধূ ধর্ষণের চেষ্টা বা ধর্ষণ, এমনকি এ কাজে শাশুড়ি বাধ্য হয়ে স্বামীর হুকুম পালনে সহায়তা করেছেÑএমন অসংখ্য উদাহরণ পর্দার অন্তরালে সঞ্চিত আছে-এ কথা মৌলানারাসহ জনগণ ভালভাবেই জানেন।
 
এ গেল এক ধরনের নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ফতোয়ার ব্যবহার। ফতোয়ার দ্বিতীয় অপব্যবহার অতি উচ্চমাত্রায় হচ্ছেÑএটি হলো, ‘হিল্লা বিয়ে’ ও ‘তালাক’ হওয়া সম্পর্কিত। এ আলোচনায় যাওয়ার আগে আমি দেশের সব বড় আলেম-মৌলানাদের কাছে একটি প্রশ্ন করব, এই একবিংশ শতাব্দীতে যেখানে খ্রিস্টান, ভারতে হিন্দু নারীরা ‘তালাক’-এর ক্ষেত্রে কোন রকম ‘হিল্লা বিয়ে’ নামের সম্পূর্ণ অমানবিক ঘৃণ্য নারীর জন্য দ্বিতীয় প্রকৃতির ধর্ষণের ব্যবস্থা করে যেসব মৌলানা, তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কখনও ফতোয়া দিয়েছেন কি? অথবা তাদেরকে বিচারে সোপর্দ করেছেন কি
 জনগণকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে বিচারপতি গোলাম রব্বানী ও বিচারপতি নাজমুন নাহার ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন, যেটি খুব সম্ভব আপীল বিভাগে এখনও আটকে আছে। মৌলানাদের নিজ কন্যাদের ও বোনদের ’আইয়ামে জাহিলিয়া’ যুগের পুরুষের ইচ্ছায় বিবাহিতা নারীকেও অন্য পুরুষের কাছে ‘আইনী’ভাবে ধর্ষিতা হবার ধর্মের নামে সমাজে প্রচলিত অপরাধমূলক ফাক-ফোঁকরগুলো বন্ধ করতে এগিয়ে আসতে হবে। এটা বলাবাহুল্য। গ্রামেগঞ্জে এই ‘তালাক’ নিয়ে ‘হিল্লা’ বিয়ের মাধ্যমে ধর্ষণ হচ্ছে, তা বন্ধ করা মৌলবী-মোল্লাদের একটি অন্যতম দায়িত্ব। তাঁরা সে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন এবং অন্তত, কন্যা ও বোনদের নারী নির্যাতক ফতোয়াবাজদের হাত থেকে রক্ষা করবেন, অন্যকিছু করার আগে এটাই তাঁদের জন্য কর্তব্য হিসেবে অগ্রগণ্য।
এছাড়াও মৌলানাদের একটি বড় দায়িত্ব হচ্ছে, দেশের সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগুরুর দ্বারা নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ এর শিকার হওয়া, তাদের বসত-জমি-জীবিকা দখল হওয়া থেকে রক্ষা এবং সর্বোপরি তাদের প্রাণের নিরাপত্তা প্রদান যে সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, এই তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করা, পাড়া-মহল্লায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করা। ইসলামের নবী সঠিকভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সংখ্যাগুরুর হাতে ‘আল্লাহর আমানত’ হিসেবে গণ্য করতে বলেছেন। তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সংখ্যাগুরুর হাতেই, এ কথা মৌলানাদের উপলব্ধি করতে হবে এবং একই সাথে ইসলাম ধর্মের এ মহৎ সুশিক্ষার পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে হবে। মৌলানা সাহেবরা দেশের সংখ্যালঘুর, হিন্দু আদিবাসী ভূমিগ্রাসকারীদের বিরুদ্ধে ফতোয়া নয়, সামাজিক বয়কট, তাদের বিচারে সোপর্দ করতে এগিয়ে আসবেন, এটিই জনগণের প্রত্যাশা।
মৌলানা সাহেবরা  আমেরিকায় বাংলাদেশের একজন ব্যক্তি ওই দেশের একটি অঙ্গরাষ্ট্রের আইনী অধিকার সমকামী বিবাহ সম্পর্কে তাঁর ‘ব্যক্তিগত মত’ প্রকাশ করেছেন বলে তাঁকে ‘দেশ ছাড়া’ করবার ফতোয়া দেন, যা দেবার প্রয়োজন ছিল না।
 মানবাধিকারে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উচ্চ স্থান দেয়া হয়। একটা কথা না বললে এ বিষয়টা পরিষ্কার হবে না। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্ম ব্যক্তির চর্চার বিষয় কিন্তু রাষ্ট্র সব ধর্মের এবং আস্তিক-নাস্তিক সবার জন্য অধিকার রক্ষার জন্য আইন তৈরি করে।
যদিও আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোতে সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কোন ধারা যুক্ত নেই। সত্যি বলতে, ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার চর্চার ব্যাপক বিস্তৃতির সুযোগে আমাদের দেশের বা এশিয়া, আফ্রিকার সন্ত্রাসী, খুনী, জঙ্গী জেহাদীরা পশ্চিমা দেশেই ঠাঁই গেড়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী, তাদের সন্তানরা ’৭১-এ অনেক যুদ্ধাপরাধী ও তাদের সন্তানেরা তো পশ্চিমা দেশেই বসবাস করছে। জঙ্গী জেহাদীরা মালয়েশিয়াতেও বসবাস করছে যাদের অনেকেরই টার্গেট ওখান থেকে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া পাড়ি দেয়া। এই জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ বেশি জরুরী।
আমাদের তদানীন্তন শাসকদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ময়মনসিংহে সে সময়ে সিনেমা হলে জঙ্গীদের বোমা হামলা, ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের ওপর হাওয়াভবনে পরিকল্পিত শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত গ্রেনেড হামলাকে পর্যন্ত অবিশ্বাস্য জেনেও আওয়ামী লীগের দ্বারাই সেসব সংঘটিত বলে যে মিথ্যা ভিত্তিহীন অপরাজনীতি, দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি করেছিল- সেই মিথ্যা পশ্চিমারা বলে না।
কিন্তু তাদের কোন মিত্রকে যদি কখনোও আত্মবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল, নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে দেখে, তাহলে যুদ্ধাস্ত্র যাদের ব্যবসার প্রথম পণ্য, সেই পশ্চিমারা তাকে কিভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ সাদ্দাম ও গাদ্দাফী।
এমন কি আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংস করার জন্য তারা জন্ম দিয়েছিল ও বিকশিত করেছিল সস্ত্রাস, জঙ্গী দল আল কায়েদা, তালেবান ও লাদেনকে! সে অবমুক্ত দৈত্যকে আবার পরে তাদেরই হত্যা করতে হয়েছে ও হচ্ছে! দুনিয়ার তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ-সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পশ্চিমারা এক পুতুল খেলায় রত, যে খেলায় কোন একভাবে দরিদ্র দেশগুলোকেও খেলতে হচ্ছে!
তবে পশ্চিমা সাধারণ নাগরিকরা যুদ্ধ ও এসবের বিরুদ্ধবাদী এবং ওদের ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রীতি এসবের প্রতি গভীর আস্থা না থাকলে আজ আমাদের লেখক তসলিমা নাসরিন, দাউদ হায়দার, সালমান রুশদীরা প্রাণে বাঁচতে পারত না। খেয়াল করে দেখুন, এই মুরতাদ, কাফের নাম দিয়ে মুসলমান উগ্র জেহাদী মৌলানারাই তাদের কতল করবে বলে ঘোষণা দিচ্ছে-যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ! মসুলমান ছাড়া অন্য কোন ধর্মীয় সম্প্রদায় সারা দুনিয়ায় কোন কবি লেখক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীকে কত্্ল্যোগ্য দাবি করেনি! এমন কি এখনকার জঙ্গী, ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণরাও মুক্তিযুদ্ধপন্থী এখন প্রগতিশীল ব্লগারদের কতল্যোগ্য ঘোষণা করছে, কতলও করছে!
’৭১-সালের রাজাকার গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীদের উত্তরসূরী বর্তমান যুগের ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষিতদের মধ্যেও যদি জঙ্গী খুনী জন্ম নিতে পারে, মাদ্রাসায় তো কিছু সংখ্যক জন্ম নিচ্ছেই-তাহলে মৌলানারা এই জল্লাদ-সৃষ্টিকারী মসুলিম মৌলানাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ও সংশোধনমূলক প্রচার কর্মকা- শুরু করবেন।- এটাই অনেক বেশি কাক্সিক্ষত ও প্রয়োজনীয়। পশ্চিমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতাকে সম্মান করার ফলে একজন শিশুকে মা-বাবা জন্মদান করে তবে মালিক হতে পারে না, সে নির্যাতিত হলে পুলিশ ঐ মা, বাবা রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক সন্তানের দেখভালের উপযুক্ত নয় গণ্য করে শিশুকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে নিয়ে যায়!
সবশেষে ছোট্ট করে বলতে চাই- সমকামিতা-দোষে দুষ্ট পৃথিবীর সব দেশের সব সমাজ। আমাদের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এসবের হোস্টেল, আরও নানা স্থানকে সমকামিতার কেন্দ্রস্থল বলে চুপিসারে মানুষ সমালোচনা করে। পশ্চিমারা ওটাকে ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচি হিসেবে মান্য করে, সেটাকে গোপন বিষয়ে পরিণত না করতে বিবাহের আইন পাস করেছে আমেরিকার কোন কোন অঙ্গরাষ্ট্র। কে কোথায় এ বিষয়ে একমত পোষণ করল তাতে আপনাদের–আমাদের কোন ক্ষতি হবে না। আর যদি আপনারা সত্যিই ধর্ষক, সমকামী, বহু বিবাহকারী, যৌতুকদাবিকারী, নারী হত্যাকারী এবং প্রগতিশীল তরুণ-তরুণী হত্যাকারীদের দেশছাড়া করার ঘোষণা দিয়ে দাবি আদায়ের আইনসম্মত কর্মসূচী গ্রহণ করেন, তাহলে সত্যিই দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়নে আপনাদের মৌলানাদের বিপুল ভূমিকা শ্রদ্ধা অর্জন করবে।

No comments:

Post a Comment