Monday, July 7, 2014

আটকেপড়া পাকিস্তানী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বহুমাত্রিক সঙ্কট -শাহরিয়ার কবির

উন্নত-উন্নয়নশীল-অনুন্নত নির্বিশেষে বিশ্বের যে কোনও দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকরা কম বেশি বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার। এই নিপীড়ন বহু ক্ষেত্রে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, গৃহে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন ও অপহরণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে পর্যবসিত হয়। সংখ্যালঘু ধর্মীয় হতে পারে, জাতি-ভাষা-লিঙ্গ-কায়িক-বর্ণগত হতে পারে, এমনকি মতাদর্শগতও হতে পারে।
কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও ধর্ম-জাতি-ভাষা-লিঙ্গ-কায়িক ও মতাদর্শগত সংখ্যালঘু রয়েছে। মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে নাগরিকদের ভেতর সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বিভাজন অনভিপ্রেত হলেও রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়ের আচরণ সর্বত্র এই বিভাজন সৃষ্টি করেছে যা অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে সংখ্যালঘুর সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের দাবি অগ্রাহ্য করা।
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া প্রায়ই বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই, বাংলাদেশে আমরা সবাই বাংলাদেশী। খালেদা জিয়ার এই বক্তব্য যদি সত্য হতো আমরা যারপরনাই প্রীত হতাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ২০০১ সালের অক্টোবরে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াত-বিএনপি জোটের প্রধান হিসেবে খালেদা জিয়া যখন তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু- বিশেষভাবে হিন্দু সম্প্রদায় নজিরবিহীন সহিংসতার শিকার হয়েছিল, যা বিস্তৃত হয়েছে বিরোধী দল ও মতের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অপহরণসহ যাবতীয় মানবতাবিরোধী অপরাধে। বিএনপি-জামায়াতের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ২০১৪-এর ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও ঘটেছে। এবার হিন্দু, খ্রীস্টান ও আদিবাসীদের একমাত্র ‘অপরাধ’ ছিল তারা জামায়াত-বিএনপির নির্বাচন বর্জনের ডাক উপেক্ষা করে ভোট দিতে গিয়েছিলেন। তারপরও সম্প্রতি (২৯ জুন, ২০১৪) ভারতের ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে বেগম জিয়া বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু বলে কিছু নেই’ এবং ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য জামায়াত-বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ দায়ী।’
গত ১৪ জুন (২০১৪) ঢাকার পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পে দুর্বৃত্তদের হামলা ও অগ্নিসংযোগে ১০ জন অবাঙালী নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত ১০ জনের ভেতর ৯ জনই একই পরিবারের সদস্য। বিহারি ক্যাম্পের এই নৃশংস হামলা আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের আমলের জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার ভয়ঙ্কর ঘটনা। ২০০৩-এর ১৯ নবেম্বর চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে শিশু-বৃদ্ধ-নির্বিশেষে তেজেন্দ্র শীলের পরিবারের ১১ জনকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল বিএনপি-জামায়াত জোটের সাম্প্রদায়িক দুষ্কৃতকারীরা। খালেদা জিয়ার শাসনামলে জ্যান্ত মানুষ পুড়িয়ে মারার বহু ঘটনা ঘটেছে। ২০১৩ সালে জামায়াত-বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল না তখনও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল এবং তাদের ডাকা হরতাল-অবরোধ সফল করবার জন্য নিরীহ বাসযাত্রী, পরিবহন শ্রমিক, পথচারী এমনকি পুলিশকেও পুড়িয়ে মারা হয়েছে।

পল্লবীর বিহারি ক্যাম্পে অগ্নিসংযোগ ও হত্যার নৃশংস ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ করেছে সচেতন নাগরিক সমাজ। বিএনপি যথারীতি কোনও রকম তদন্ত ছাড়াই এ হত্যার দায় আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে কোন ঘটনা জাতির বিবেককে আহত করে। কোন ভয়ঙ্কর অপরাধীকেও এভাবে হত্যা করা সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। গত ২ জুলাই (২০১৪) অগ্রজপ্রতীম কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ দৈনিক ‘প্রথম আলো’য় ‘বিহারিসহ সব সংখ্যালঘুর কাছে ক্ষমা চাই’ শিরোনামে মর্মস্পর্শী কলাম লিখেছেন। মহিউদ্দিন ভাই ছাড়াও বিভিন্ন দৈনিকে অগ্রজ ও অনুজপ্রতিম সাংবাদিক ও কলাম লেখকরা বিহারি ক্যাম্পের নৃশংস হামলা ও হত্যার নিন্দা করে লিখেছেন। আমাদের এসব লেখায় দুষ্কৃতকারীদের শুভবুদ্ধির উদয় না হতে পারে, প্রশাসনের টনকও হয়ত নড়তে না পারে, তবে আক্রান্ত সর্বহারা মানুষরা জানবেন তাদের পাশে দাঁড়াবার মতো মানুষ এখনও আছে।
বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ধারাবাহিকভাবে চলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সরকারী চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বৈষম্য কিছুটা কমলেও অন্য ক্ষেত্রে অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না। বার বার বলা সত্ত্বেও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ আইন, সংখ্যালঘু কমিশন বা পৃথক মন্ত্রণালয়ের দাবি উপেক্ষিত থেকেছে। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ...’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রেখে দেয়া হয়েছে এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণের জটিলতাও দূর হয়নি। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিচুক্তি এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি, যে শান্তিচুক্তির জন্য ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছিলেন।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যার সঙ্গে বিহারি ও রোহিঙ্গাদের সমস্যার অনেক পার্থক্য আছে। এ দেশে বিহারি বলা হয়- যারা ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার কারণে কিংবা উন্নততর জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে আগত উদ্বাস্তুদের অধিকাংশ বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা উর্দুভাষী হওয়ার কারণে সাধারণভাবে এদের ‘বিহারি’ বলা হয়। একইভাবে দেশভাগের কারণে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকে বিপুল সংখ্যক হিন্দু ও শিখ মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে অবস্থানকারী অধিকাংশ অবাঙালী পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে ছিলেন এবং অনেকে সরাসরি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধে অংশগ্রহণ করেছেন। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযোগী অবাঙালীরা তাদের বাঙালী জ্ঞাতিভাই জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের নেতাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য জেনে ’৭১-এর ডিসেম্বরের আগেই পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। যারা থেকে গিয়েছেন তাদের সিংহভাগের আনুগত্য ছিল পাকিস্তানের প্রতি, যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি। তারা আশা করেছিলেন বাংলাদেশ সরকার যেভাবে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালীদের ফেরত এনেছে, একইভাবে পাকিস্তানও বাংলাদেশে আটকেপড়া অবাঙালী পাকিস্তানীদের ফেরত নেবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ তাদের নাগরিকদের মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করলেও পাকিস্তান তা করেনি।
আটকেপড়া পাকিস্তানীরা গত ৪২ বছর ধরে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য সংগঠন-আন্দোলন করছেন, ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে দেন-দরবার করছেন, কিন্তু পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হয়নি। বরং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইসিআই তাদের আঞ্চলিক সন্ত্রাসী বলয় বিস্তারে রোহিঙ্গাদের মতো বিহারিদেরও ব্যবহার করছে। মিরপুরের বিহারি ক্যাম্পের সাম্প্রতিক হত্যা ও সন্ত্রাসের ঘটনার জের ধরে গত ২ জুলাই (২০১৪) পুলিশ মোহাম্মদপুর থেকে জনৈক শান্নুকে গ্রেফতার করেছে। এ বিষয়ে ৫ জুলাই ‘বিহারি শান্নু গ্রেফতার’ শিরোনামে দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত এক প্রতিবদেন বলা হয়েছে-
‘১৯৭৮ সালে আটকেপড়া পাকিস্তানীদের পাকিস্তান পাঠানোর লক্ষ্যে এসপিজিআরসি নামের সংগঠনের সৃষ্টি হয়। সারাদেশের ১৩টি জেলায় ৭০টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরে ২৭টি এবং মিরপুরে ৬টি ক্যাম্প রয়েছে। ১৯৯২ সালের মক্কাভিত্তিক সংগঠন রাবিতা ইসলাম নামের একটি এনজিওর জরিপ মোতাবেক দেশের ৭০টি ক্যাম্পে ওই সময় জনসংখ্যা ছিল ২ লাখ ৩৮ হাজার ৪২৩ জন। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৫ লাখে দাঁড়িয়েছে। ভোটার সংখ্যা কমপক্ষে ২ লাখ। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অধীন রয়েছে ক্যাম্পগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এসপিজিআরসির প্রতিষ্ঠাতা নাসিম খান মারা গেলে এর প্রধান হন গ্রেফতারকৃত শান্নুর পিতা জব্বার খান। তিনি কাগজে-কলমে জেনেভা ক্যাম্পের অধিবাসী হলেও বসবাস করেন আসাদ এ্যাভিনিউয়ের ৩৬/সি নম্বর ওই বাড়িতে। ৪ ছেলে ২ মেয়ে। সবার ছোট ছেলে শান্নু।
জেনেভা ক্যাম্পের অবৈধ পানি, বিদ্যুত, মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত সন্ত্রাসী ছট্টু। জব্বার খান জনকণ্ঠের কাছে দাবি করেন, তিনি ২০০৫ সালে এসপিজিআরসির মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের নির্বাচিত সভাপতি।
সূত্র বলছে, জব্বার খান এসপিজিআরসির সভাপতি হওয়ার পর অবৈধ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে তার ছেলে গ্রেফতারকৃত শান্নু। গড়ে তোলে শান্তি কমিটি। শান্নু সব অবৈধ ব্যবসার আধিপত্য নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় শান্নু ও ছট্টু গ্রুপের মধ্যে নিয়মিত মারামারি। কারণ জেনেভা ক্যাম্পগুলোতে ব্যবহৃত বিদ্যুত ও পানির কোন বিল সরকারকে দিতে হয় না। এমন সুযোগে জেনেভা ক্যাম্পগুলো থেকে আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অবৈধ বিদ্যুত ও পানির সংযোগ দিয়ে মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণকারীরা।
দুই গ্রুপের আধিপত্যের জেরে ২০১৩ সালের ২৯ মার্চ জেনেভা ক্যাম্পে ব্যাপক মারামারি হয়। ওই মামলায় শান্নুকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া এক অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, জেনেভা ক্যাম্পগুলো থেকে যে পরিমাণ অবৈধ বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হয়েছে তাতে প্রতিমাসে সরকারের ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে।
ক্যাম্প সূত্রে জানা গেছে, শান্নু আত্মগোপনে থাকলেও তার আধিপত্য ছিল। বিশেষ করে গাঁজা, হেরোইন, আফিম, চরস, হালের ইয়াবাসহ সব ধরনের মাদক ব্যবসার একাংশের নিয়ন্ত্রণ ছিল শান্নুর শান্তি কমিটির কাছে। মাদক ও জালমুদ্রার ব্যবসা ছাড়াও ঢাকার বিহারি ক্যাম্পগুলো দেশী-বিদেশী জঙ্গীদের নিরাপদ বাসস্থান। প্রসঙ্গত, বিশ্বখ্যাত সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব গুলশান কুমার হত্যা মামলার জেল পলাতক আসামি দাউদ মার্চেন্ট ও আন্তর্জাতিক মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহীম ও আরেক মাফিয়া ডন ছোট শাকিলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী জাহিদ শেখ দীর্ঘদিন মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে পলাতক ছিল। তারা আটকেপড়া পাকিস্তানীদের মাধ্যমে এ দেশীয় দালালদের সহযোগিতায় বাংলাদেশী পাসপোর্ট তৈরি করে দিব্যি বসবাস করছিলেন বলে ডিবির হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এমন তথ্য প্রকাশ পায়। নিয়ন্ত্রণকারীদের সহযোগিতায় মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পে গড়ে ওঠে বেশ কয়েকটি বোমা তৈরির কারখানা।
গত বছরের ২০ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পের ৭ নম্বর সেক্টরের একটি বাড়িতে বোমা তৈরির সময় বিস্ফোরণে শাহীন ও গ্রেফতারকৃত শান্নুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী নাদিম আহত হন। এ ঘটনায় আহত নাদিম ও তাঁর ভাই বশির এবং শাহীনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের তথ্য মতে, জেনেভা ক্যাম্পে বোমা তৈরির কারখানা ও কারখানায় মজুদ থাকা শতাধিক তাজা বোমা উদ্ধার হয়। (জনকণ্ঠ, ৫ জুলাই, ২০১৪)
আইএসআই-এর মদদে জামায়াতে ইসলামী কীভাবে গত ৩৫ বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক গঠন করেছে এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় গণমাধ্যমে বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের আমলে আমরা বাংলাদেশে জামায়াতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে গঠিত শতাধিক জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠনের তালিকা প্রকাশ করেছিলাম, যেখানে ১৭টি ছিল রোহিঙ্গাদের। আইএসআই ও জামায়াতের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে বার্মার আরাকান এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি অংশ ও কক্সবাজারকে নিয়ে পৃথক রোহিঙ্গা মুসলিম রাষ্ট্র গঠন। যে কারণে জামায়াত ও জঙ্গীদের গোপন তৎপরতা ও সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের শতকরা ৯০ ভাগ পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত।
শতকরা ৯৫ ভাগ রোহিঙ্গা শরণার্থীর মতো বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় রেডক্রসের ক্যাম্পে অবস্থানকারী পাকিস্তানী শরণার্থী বা আটকেপড়া পাকিস্তানীরা অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তবে এসব পাকিস্তানী নাগরিকদের সন্তানরা, যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অধিকাংশই বাংলাদেশে লেখাপড়া করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। রোহিঙ্গাদের মতো এদের অনেকে মাতৃভাষা ভুলে মূল স্রোতে মিশে গিয়েছে।
প্রায় পনের বছর আগে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প থেকে কিছু তরুণ তাদের নাগরিকত্বের সমস্যা নিয়ে আমার সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিল। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে বা করতে যাচ্ছিল। তারা বলেছিল বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চেয়ে তারা হাইকোর্টে রিট করেছে, আমরা যেন তাদের দাবি সমর্থন করি। আমি তাদের দাবি ন্যায়সঙ্গত বলেছি এবং সমর্থন করে লিখেছিও। শুধু তাই নয়, যখন জেনেছি স্কুল ও পাঠ্যপুস্তকের অভাবে উর্দুভাষার চর্চা উঠে যাচ্ছে, তাদের অনেকে উর্দু পড়ালেখা এমনকি বলাও ভুলে গেছে, আমি বলেছি তারা যদি চায় এ বিষয়েও আমি ভারত ও পাকিস্তানে আমার উর্দুভাষী বন্ধুদের সহযোগিতার জন্য বলতে পারি। আমরা মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই করেছি, রক্ত দিয়েছি, ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বিশ্বের সকল ভাষার অস্তিত্ব, বিকাশ ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশে ’৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত অনেক উর্দুভাষী, অবাঙালী, পাহাড়ি, আদিবাসীও অবদান রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বহু দেশ, বহু ভাষাভাষী, বহু জাতি ও বহু ধর্মের মানুষ আমাদের সমর্থন ও সহযোগিতা করেছেন। এসব অস্বীকার করা হলে নিজেদের দীনতা ও নীচতাই প্রকাশ পাবে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্ম, জাতিসত্তা, ভাষা ও মতের মানুষ যতদিন পর্যন্ত সমান অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে বাস করতে না পারবে ততদিন আমরা বিশ্বসভায় সভ্য দেশ ও জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে পারব না। জাতি-ধর্ম-ভাষা-লিঙ্গ-বিত্ত নির্বিশেষে সকল মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের যেমন দায়িত্ব, একই সঙ্গে নাগরিক সমাজেরও, বিশেষভাবে যারা সংখ্যাগুরুর অংশ। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাস থেকে নিরীহ রোহিঙ্গা ও আটকেপড়া পাকিস্তানীদের রক্ষা করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ভেতর আইএসআই, সৌদি আরব ও জামায়াতের মদদপুষ্ট এনজিওদের তৎপরতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কারণ সমস্যাটি জাতীয় নিরাপত্তার অন্তর্গত। জামায়াত-বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম ভোটার তালিকায় ঢোকানো হয়েছিল।
রোহিঙ্গা ও বিহারিদের দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবসহ যাবতীয় অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে জামায়াত বা অন্য কেউ যাতে রাষ্ট্র ও জাতিবিরোধী কোন ষড়যন্ত্র করতে না পারে সে বিষয়ে সরকার ও নাগরিক সমাজকে যেমন সচেতন থাকতে হবে, একইভাবে সন্ত্রাসী খুঁজতে গিয়ে নিরীহ বিহারি ও রোহিঙ্গারা যাতে কোন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার না হন সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। এসব শরণার্থীর ভেতর যারা পাকিস্তানে বা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় নিষ্পত্তি না হলে আন্তর্জাতিক ফোরামে উত্থাপন করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে ভুক্তভোগী সকল দেশকে।
জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর সংখ্যা চার কোটি তিরিশ লাখ। এদের ভেতর সর্বাধিক হচ্ছে প্যালেস্টাইনের শরণার্থী, যাদের সংখ্যা প্রায় অর্ধ কোটি। সরকারী হিসেবে বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানী ও রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দেড় লাখের মতো হলেও বেসরকারী হিসেবে এদের সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপরে। স্বদেশবঞ্চিত এই অসহায় মানুষদের নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াকে বলা হয় অভিবাসীদের দেশ, কারণ এ দুটি দেশ গঠন করেছে অভিবাসীরা। শরণার্থী সমস্যা নিরসনের ক্ষেত্রে এ দুটি দেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার শরণার্থী সমস্যা আক্রান্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে বর্তমান বিশ্বের এই জ্বলন্ত সমস্যা বহুলাংশে সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, কারণ উন্নয়নশীল জনবহুল এই দেশটি গত ৪২ বছর ধরে শরণার্থী লালন করছে। ক্রমবর্ধমান এই সঙ্কট নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি ব্যর্থ হয় তাতে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাই শুধু উপেক্ষিত হবে নাÑ বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাস প্রতিহত করাও অসম্ভব হয়ে পড়বে।

No comments:

Post a Comment