বেবী মওদুদ, সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
বেবী মওদুদ: বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে এ সম্পর্কে
বিস্তারিত বিবরণ আছে। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্টের দ্বিতীয় দফায় যখন মন্ত্রীর
শপথ নিলেন সেদিনই এ ঘটনাটি ঘটেছিল। তিনি তো ছুটে যান সেখানে। আপনার নিশ্চয়ই
মনে আছে।
জিল্লুর রহমান:
খুব মনে আছে। ঘটনার ভয়াবহতায় প্রচণ্ড আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছিল তখন। পাকিস্তানি
শাসকদেরও একটা ষড়যন্ত্র ছিল যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে। পূর্ব বাংলায়
মুসলিম লীগের চরম ভরাডুবি তারা মেনে নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু সেদিন তরুণ
নেতা ছিলেন। তিনি সাহস করে দাঙ্গাপীড়িত এলাকায় গিয়েছিলেন, সেটা একটি বড়
ঝুঁকি ছিল। তিনি যে আমাদের কাছে কত বড় শক্তিমান আদর্শ ছিলেন সেটা বায়ান্ন
সাল থেকে স্বচক্ষে দেখে আসছি।
বেবী মওদুদ: আপনার দেয়া বই ও কাগজপত্র পড়েছি। আপনার শৈশব কাটে ময়মনসিংহে।
জিল্লুর রহমান:
হ্যাঁ। আমার জন্ম হয় নানাবাড়িতে ৯ মার্চ ১৯২৯ সালে। আমার বয়স যখন মাত্র ছয়
মাস, তখন আমার মায়ের মৃত্যু হয়। সুতরাং মায়ের স্নেহ-ভালোবাসা আমি পাইনি।
এই একটা কষ্ট আমাকে জড়িয়ে থাকে। আমার বাবার মৃত্যু হয় যখন আমার বয়স মাত্র
দশ বছর। তিনি ময়মনসিংহ জেলা শহরে আইনজীবী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর খুব
দুঃখ-কষ্টে দিন কেটেছে। এতিম অবস্থায় মা-বাবার স্নেহ-মমতাহীন হয়ে বড় হওয়া
বড় বেদনার। এরপর দাদা বেঁচে ছিলেন বলে পিতৃসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ি-
কিছুই করার ছিল না, ওই সময়ের আইন অনুযায়ী এটা করা হয়েছিল। পড়াশুনায় ভালো
ছিলাম, উপস্থিত জ্ঞানও ছিল বলে নিজেই নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছি। পিতা-মাতা,
ভাই-বোন হারা হয়ে বড় হওয়া বড় দুর্ভাগ্যজনক। সেই একাকীত্ব ও নিঃসঙ্গতা
পরবর্তী জীবনে আমাকে পরিপূর্ণ করেছে। তবে আমার বন্ধুভাগ্য সর্বদাই ছিল
ভালোবাসার ও আনন্দের। আমি এখানে কৃতজ্ঞ। আর আমার নেতা, যাকে আমরা ‘মুজিব
ভাই’ বলে ডাকতাম, পরে তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’ হলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে
তিনি আমাদের ‘লিডার’ হলেন। আমার প্রতি নেতার স্নেহ-ভালোবাসার জন্য আমি
কৃতজ্ঞ। আমার ভালো-মন্দের খবরদারী, তাঁর পরামর্শ ও নির্দেশ মাথা পেতে
নিয়েছি। তিনি আমার বিয়ে দিয়েছেন, অন্যতম সাক্ষী ছিলেন, আর উকিল বাপ ছিলেন
আতাউর রহমান খান। আরও একজন সাক্ষী ছিলেন মনসুর আলী সাহেব। আর ভাবী তো মেয়ে
দেখে আসা, আমার গায়ে হলুদ, কেনাকাটা এবং নিজের গাড়ি সাজিয়ে বরযাত্রীসহ
বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন। ঠিক মায়ের মত বড় বোনের মত, এটা আমার জীবনের অনেক বড়
পাওয়া।
বেবী মওদুদ: ছাত্র রাজনীতির পর আপনি আওয়ামী লীগ করলেন। কেমন লেগেছিল তখন?
জিল্লুর রহমান:
যখন ছাত্র রাজনীতি তখন তো ছাত্রলীগ হলো। আমরা ছাত্রাবস্থা থেকে জাতীয়
রাজনীতিতে কর্মী হিসেবে জড়িত হয়ে যাই। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তো আমরাই ছিলাম।
তাঁর সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে নির্দেশ মত যে কোনও কাজের জন্য প্রস্তুত
থাকতে হতো। সেই আইয়ুব আমল, বাষট্টি ও পঁয়ষট্টির নির্বাচন, তারপর ছেষট্টির
ছয় দফা, ঊনসত্তর, অসহযোগ- একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের শুধু
আন্দোলন-সংগ্রাম জেলজুলুমের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে।
বেবী মওদুদ: মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার সদস্য পদ বাতিল ও কুড়ি বছর কারাদণ্ড হয়েছিল।
জিল্লুর রহমান:
মুক্তিযুদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের পুরস্কার। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়
অর্জনের পর, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর নেতৃত্বে সরকার গঠিত
হলে সবাই ব্যস্ত হয়ে গেলেন দেশ গড়ার কাজে। তিনি আমাকে বললেন দলটা নিয়ে
থাকতে। দলের কাজকর্ম ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে। ১৯৭২ সালের কাউন্সিলে আমাকে
সাধারণ সম্পাদক করে দিলেন। সে সময়ের অনেক কথা আছে পরে বলবো।
বেবী মওদুদ: ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর তো আপনি অনেকদিন কারাবন্দি ছিলেন।
জিল্লুর রহমান:
আমাকেও গ্রেপ্তার করে প্রথমে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে রেখেছিল। সেদিন
জাতীয় চার নেতার সঙ্গে আমাকেও তো মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু ভাগ্যটা ভালো
বলতে হবে, আমাকে দু’তিনদিন আগে তারা কুমিল্লা কারাগারে নিয়ে যায়। আমি
নিশ্চিত যে ঢাকায় থাকলে তারা আমাকে মেরে ফেলতো। মুশতাক এ কাজটা করেছিল।
বেবী মওদুদ: তিনি তো তাজউদ্দীন সাহেবকে পছন্দ করতেন না।
জিল্লুর রহমান:
তিনি আমাদের কাউকেই পছন্দ করতেন না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে ষড়যন্ত্রে
ছিলেন-একদল কুলাঙ্গারের সঙ্গে হাত মেলান শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য। বঙ্গবন্ধু
আমাদের পছন্দ করতেন, আমাদের ওপর নির্ভর করতেন, এটা তিনি সহ্য করতেন না।
বেবী
মওদুদ: ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন, কৃষক-শ্রমিক
আওয়ামী লীগ হলে আপনি প্রথম সম্পাদক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন
আপনি। একজন বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন।
জিল্লুর রহমান:
সেটা আমার সৌভাগ্য। তিনি আমাদের কয়েকজনকে খুব বিশ্বাস করতেন। আমরা দোষ
করলে তাঁর সামনে স্বীকার করতাম, লুকাতাম না, মিথ্যা কথা বলতাম না। আমার ওপর
তার আস্থা ছিল, বিশ্বাস ছিল। তিনি জানতেন কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে।
বেবী মওদুদ: পঁচাত্তরে কারাবন্দি ছিলেন, কারামুক্তির পরও আপনাকে সামনে কম দেখা গেছে। নেতৃত্বে অনেকে উঠে এসে দলের হাল ধরেছেন।
জিল্লুর রহমান:
আমি তো চার বছর জেলে ছিলাম। যারা বাইরে ছিলেন, তারা তখন দলের হাল ধরেছেন।
আমার এতে কোন আক্ষেপ নেই, কারও প্রতি অভিযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ও
বিশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাকে হত্যা করে নাই কেন- সেটাই মনে হয়।
বেবী মওদুদ: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর আবার আপনি দলীয় নেতৃত্বে এলেন। তার নেতৃত্বে ফেরাটা কি জরুরী ছিল?
জিল্লুর রহমান: বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দেশে ফেরাটা শুধু দল নয়, সবার মনে স্বস্তি এনে দেয়। আর জেনারেল জিয়া ও খুনিদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
আমি
বলবো নেতৃত্ব নিয়ে তার ফেরাটা খুবই জরুরি ছিল। দেশের কী অবস্থা তখন ছিল
আপনি ভালো জানেন। আমি তো কারাগারে বসে অনেক সময় একাকী কাঁদতাম বঙ্গবন্ধুর
সোনার বাংলা কি ধ্বংস হয়ে যাবে? দেশে কি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন হবে না?
সামরিক শাসকরা কবে দূর হবে? কেন আন্দোলন গড়ে উঠছে না? তবে আমি খুব আশাবাদী
ছিলাম। আইভী দেখা করতে এসে কত কথা জানাতো। বলতাম, সব ঠিক হয়ে যাবে। এ
অবস্থা তো চিরকাল থাকতে পারে না।
বেবী মওদুদঃ বঙ্গবন্ধুর সময়টা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করতে চান?
জিল্লুর রহমান:
বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে দেশ
স্বাধীন করেছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে
শত্রুমুক্ত করেছে- এটা হচ্ছে অনেক বড় কথা। এটাই ইতিহাসে লেখা থাকবে। তাঁর
মত নেতা, আদর্শ, আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেম যার একমাত্র আধার- বহু যুগ
প্রতীক্ষার পর মেলে। তাঁর পূর্বেও অনেকের নাম আমরা শুনি, তাদের আদর্শ ও
কাজকর্ম হয়তো মহৎ ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মত করে বাঙালি জাতির মুক্তির
জন্য, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, বাঙালি জাতিসত্ত্বার প্রতিষ্ঠা এবং
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এমন আত্মত্যাগী, দূরদর্শী ও সাহসী নেতা আমরা আর
একটিও দেখি না। এজন্যই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি। আমি বলবো,
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বিশ্ব মানবতাবাদী- যিনি শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
করতে চেয়েছিলেন। তিনি আমার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন- তাঁর কাছে শিক্ষা ও দীক্ষা
পেয়ে আমি ধন্য।
No comments:
Post a Comment