Tuesday, July 30, 2013

ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের দৈনন্দিন জীবন


আরিফ ইকবাল হোসেন

যে ভারতমাতা সদা ভুলের প্রতি দয়া ও মহানুভবতা দেখিয়ে বলেছেন ‘আমি দিব!’, ‘আমি দিব!’ সেখানে লক্ষ্মী বলেছিলেন, ‘আমি দিব না! আমি আমার ঝাঁসি ছেড়ে দিব না! কেউ আমার ঝাঁসি কেড়ে নিতে পারবে না; যার সাহস আছে সে চেষ্টা করতে পারে!’ঝাঁসির দুঃসাহসী রানী এ আহ্বানের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের বিতাড়িত করে ঝাঁসির রানী শুরু করেছিলেন তার রাজ্য শাসন। এ ইতিহাস আমাদের সবারই মোটামুটি জানা। কিন্তু লক্ষ্মীর দৈনন্দিন জীবনের কতটুকুই বা আমরা জানি। চলুন তাহলে জানা যাক।

জানা যায়, লক্ষ্মী বাঈ সকাল পাঁচটার সময় উঠে সুগন্ধি আতর দিয়ে স্নান করতেন। সাধারণত ধবধবে সাদা চান্দেরী শাড়ি পরে তার নিয়মিত প্রার্থনায় বসতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরও মাথায় চুল রাখার অপরাধে জল ঢেলে প্রায়শ্চিত্ত করতেন; তুলসী পূজা করতেন তুলসীবেদিতে। তারপর দরবারের গায়করা যেখানে গান করতেন, সেখানে করতেন পার্থিব পূজা। পুরাণিরা পুরাণ পাঠ করা শুরু করতেন। তারপর সিরদাররা ও আশ্রিতরা এলে তিনি তাদের অভিবাদন জানাতেন।

সকালে যে সাড়ে সাতশ মানুষ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তাদের মধ্যে একজনও উপস্থিত না থাকলে তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির ফলে পরের দিন তিনি তার না আসার কারণ জানতে ভুলতেন না। ভগবানের পূজা করার পর আহার করতেন। আহারের পর, এক ঘণ্টার বিশ্রাম নিতেন যদি না কোনো জরুরি কাজ থাকতো।

লক্ষ্মী বাঈ সকালের উপহার সামগ্রী তার সামনে আনার জন্য আদেশ করতেন যেগুলো রুপার থালার উপর রেশমি কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতো। যেগুলো তিনি পছন্দ করতেন তা গ্রহণ করতেন, বাকিগুলো কোঠিওয়ালাকে (উপহারশালার মন্ত্রী)- প্রজাদের মধ্যে বণ্টনের জন্যে দেওয়া হতো। সাধারণত তিনটের সময় পুরুষের পোশাকে তিনি দরবারে যেতেন। গাঢ় নীল রঙের জামা, পায়জামা ও মাথায় একটি সুন্দর পাগড়িসদৃশ টুপি পরতেন। কোমরে জড়িয়ে রাখতেন একটি নকশা করা দোপাট্টা, যার পাশে থাকত মূল্যবান রত্নখচিত তলোয়ার। এই বেশভূষায় তাকে গৌরীর মতো দেখাত।

মাঝে মাঝে তিনি নারীর পোশাকও পরতেন। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আর কখনো নথ অথবা সেরকম কোনো অলংকার পরেন নি। তার হাতে থাকতো হীরার বালা, গলায় মুক্তার ছোট মালা এবং কনিষ্ঠ আঙুলে একটি হীরার আংটি। তার চুলগুলো পিছনে বাঁধা থাকতো। সাদা অন্তর্বাসের সাথে তিনি একটি সাদা শাড়ি পরতেন। এভাবেই তিনি কখনও পুরুষবেশে, কখনও নারীবেশে দরবারে উপস্থিত হতেন।

দরবারে সমবেত ব্যক্তিরা কখনই তার সাক্ষাৎ পেত না। কেননা তার বসার কক্ষটি ছিল আলাদা এবং এটি দিয়ে শুধু দরবারের সভাকক্ষেই প্রবেশ করা যেত। স্বর্ণালঙ্কিত দরজাগুলো সুতি ছিট কাপড়ের সোনালি পর্দায় ঢাকা থাকতো। সেই রুমে তিনি নরম বালিশে ঠেস দিয়ে কোমল গদিতে বসতেন। দরজার বাইরে সবসময় দু’জন ভৃত্য রুপার গদা নিয়ে উপস্থিত থাকতো। রুমটির বিপরীতে লক্ষ্মণ রাও দিওয়ানজী গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তার পাশে বসতেন দরবারের রেজিস্ট্রার।

প্রখর বুদ্ধিমতী বাঈজি তার সামনে আনা যে কোনো বিষয় খুব দ্রুত উপলব্ধি করতে পারতেন এবং তার আদেশগুলো হতো স্বচ্ছ, নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত। মাঝে মাঝে তিনি নিজেই আইন প্রণয়ন করতেন। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন এবং অধিকার ও অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে যোগ্যতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। রানী ভক্তির সঙ্গে মহালক্ষ্মীর পূজো করতেন। প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার দেবীর মন্দিরে যেতেন যা পদ্ম ফুলে ভরা খালের পাড়ে অবস্থিত ছিল।

একদিন বাঈ মন্দির থেকে ফেরার পথে দক্ষিণ ফটক অতিক্রম করার সময় হাজার হাজার ভিক্ষুক তার পথ আটকে হাঙ্গামা বাধায়। তাই তিনি তার মন্ত্রী, লক্ষণ রাও পাণ্ডেকে এর কারণ অনুসন্ধান করতে বলেন। তাকে জানানো হলো যে মানুষগুলো খুবই দরিদ্র এবং অত্যধিক ঠাণ্ডায় কাবু, তাই তারা বাঈজীকে সদয়ভাবে তাদের অবস্থা বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছে।

বাঈজি এই দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য কষ্ট অনুভব করেন এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ জারি করেন যে, চারদিন পর ভিক্ষুকদের একত্র করে তাদের প্রত্যেককে একটি মোটা জামা, একটি টুপি ও একটি সাদা বা কালো কম্বল দেওয়া হবে। তার পরের দিন শহরের সব দর্জিকে টুপি ও জামা তৈরির আদেশ দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে ঘোষণা দেওয়া হলো রাজপ্রাসাদের সামনে সব ভিক্ষুকদের জড়ো হতে। দরিদ্র জনগণকেও এতে শামিল করা হলো। বাঈ সবাইকে কাপড় দিলেন এবং তারা খুশিমনে বিদায় নিলো।

নাথে খানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় যখন আহতদের শহরে আনা হলো তখন বাঈজি তাদের ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধার সময় জোর করে উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতি তাদের ব্যাথার উপশম ঘটালো এবং তাদের সুস্থতা কামনায় তার দয়া ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণে তারা নিজেদের ধন্য মনে করলো। রানী তাদের দুর্দশা দেখে পীড়িত হলেন, তাদের অলংকার ও মেডেল দিলেন, অভিনন্দন জানালেন এবং হতাশ হওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতি দেখালেন আর মনে অনুভব করলেন, এরা রানীর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবে।

বাঈজীর মহিমা বর্ণনাতীত। বিশেষ বিশেষ দিনে তিনি কখনো পালকি আবার কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে মহালক্ষ্মীর মন্দির দর্শনে যেতেন। পালকিতে যাওয়ার সময় সোনালি পর্দা এবং সোনালি ফিতা দিয়ে বাঁধা নকশী কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতো। যখন তিনি পুরুষ পোশাকে ঘোড়ার পিঠে যাত্রা করতেন, তখন তার পেছনে একটি সরু ও সুন্দর বাট্টি ভাসতো যা তাকে চমৎকারভাবে মানাতো।

সামরিক সঙ্গীত পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার জাতীয় পতাকা তার সামনে সামনে বহন করা হতো। দু’শ ইউরোপীয় পতাকা তাকে অনুসরণ করতো এবং একশ ঘোড়াচালক তার সামনে ও পাশে থাকতো। পালকির সঙ্গে আসতোত কারভারিস, মন্ত্রী, সামন্তপ্রভু ও ভাইয়া সাহেব উপসেনের মতো অন্য অফিসার। বাকিরা ঘোড়া নয়তো পায়ে হেঁটে তাকে অনুসরণ করতেন।

মাঝে মাঝে ফৌজদল যাত্রার সহগামী হতো। বাঈজি রাজপ্রাসাদ থেকে যাত্রা শুরুর সময় কেল্লার চৌঘাদা থেকে সুরেলা দেশপ্রেমের সঙ্গীত তৈরি করা হতো। দেশপ্রেমের আগুন সব সময় তার মনে জ্বলজ্বল করতো। আর তিনি যুদ্ধে তার দেশের সম্মান এবং শ্রেষ্ঠতার জন্য গর্ব বোধ করতেন। একটি দেশের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় এমন প্রতিমা মেয়েকে রানী হিসেবে পাওয়া। এমন সৌভাগ্য ইংরেজদের কখনোই হয়নি। পাওয়া আলামতের ভিত্তিতে লক্ষ্মীর দৈনন্দিন জীবনের এতটুকুই জানা যায়।
লেখক: আরিফ ইকবাল হোসেন, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


No comments:

Post a Comment