
আকাশের এক ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!
ফারিহার মা দিবা স্বাভাবিক ভাবেই ভেঙ্গে পড়েছে খুব। প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দশ মাস দশ দিন যে কষ্ট পায় একজন মা, ১৭ বছরের হতেই মেয়েটা চলে গেলে কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা??
৩ মে ২০১৪, বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ ঝড় এলো আকাশ কাঁপিয়ে।পাশের বাড়ির খেলার সাথী ফারিহাকে ডাকতে এলেই ছাদে ছুটে যায় ফারিহা। প্রচন্ড ধুলিঝড়...কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়?
দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো মেয়েটা। ইনহেলার, নেবুলাইজার কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে।
বাঁচার আকুতিতে অসহায় আমাদের ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা...ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!
খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা! পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী সবার সামনেই মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।
আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!" সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন।কোলে করে গাড়িতে উঠানো হলো, গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি.!
ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর। তার চোখের দৃষ্টি ছিল পৌত্রী ফারিহা। রাতে দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে পত্রিকা পড়ে শোনানো, খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে নজরদারী করা -সবকিছু যেন ফারিহার করতে হবে। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে দাদীমার বুকে!
আদরের ছোট বোন ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ! ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপস পরে ছবি তুলে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! ফাইরুজের নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কেটে যায়, খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!
অবিরল অশ্রুধারায় ভেসে মায়ের মনে পড়ে আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু, দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!"
এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা!...একটা ডিপিএস ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে, দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবার সবকিছুতে নমিনি করেছিলো ফারিহাকে! প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে ! সব আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!! কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??
রবীন্দ্রসঙ্গীতশিখতো ফারিহা। দাদিমা বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে গড়ে তুলেছিলো নিজেকে!
শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন! ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ বিশালত্ব ছিল ফারিহা নামের কিশোরীটির অন্তরে!! যা আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল!
চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা। সাম্প্রতিক সময়েও তরুণ দের মাঝে এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা , তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে। প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী। কলা পাতায় করে দেয়া পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল।
পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা। ফারিহার বাবার সহপাঠী পলিকে পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো, আমাকে দিও কিন্তু!" পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো। একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি দিই থেরাপী। সেদিন প্রচন্ড হাতে ব্যথা হয় দিবার। মায়ের মন, ফারিহা কে বলে, " আমার একদিনেই হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে থেরাপি দিওনা, তোমার অনেক কষ্ট হয়!" ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে। সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে , গলির ভেতর কালো ব্যানার আর ফারিহার জন্যে শোক চোখে পড়ার মতো ! মনে করিয়ে দেয় , মানুষের প্রাণের পরে চলে গেলো যে, বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!
৫ মে তার একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো।কথা ছিলো পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে। ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।ওসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্য পড়ে থাকলো।ফারিহার সহপাঠীরা তার জন্য কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালোরঙ ব্যানার। মৃত্যুর কাছে আমরা কত অসহায়।
প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হবার রূঢ় বাস্তবতা এলাকার যারা তার আত্মার আত্মীয় ছিল- শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ !! এদের কেউ মেনে নিতে পারছেন না -ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না! প্রতিবেশীদের কাছে তার প্রিয় খাবার খেতে আসবে না!! !!
প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। বাঁচবার আকুল আকুতিতে পিতার বুকে আছড়ে পড়েছিলো ফারিহা! অসহায় পিতা নিকটস্থ হাসপাতালে ছুটে গেলেও তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন এবং জরুরী চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হন। মৃত্যুর অমোঘ নিয়তি কেড়ে নেয় দিবা-পাপ্পুর বুকের ধন , তাদের প্রথম সন্তান ফারিহাকে। ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফর কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচার আকুতি !, তার দুই কন্যা নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত!
ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?
স্বজনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রনাথের জীবনে পর পর ১৩ স্বজন কে হারাতে হয় ! কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি।যাকে স্বজন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি মাকে হারান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তার খেলার সাথী ছিলেন।
পরিণত বয়সে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায় যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷ প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।
১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার মৃনালিনী দেবী মৃত্যু বরণ করেন। স্ত্রীর মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দুমাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্যতার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ বয়স তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷
রবীন্দ্রনাথের দুই ছেলে, তিন মেয়ে – মাধুরীলতা, রথীন্দ্রনাথ, রেণুকা, মীরা ও শমীন্দ্রনাথ৷ মাধুরীলতার ডাক নাম বেলা, রেনুকার ডাক নাম রাণী৷ স্ত্রী বেঁচে থাকতেই তিনি মাধুরীলতা ও রেনুকার বিয়ে দেন, তাদের অল্প বয়সে৷ বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই রেণুকা গুরুতর অসুস্থ হলো। ডাক্তাররা রোগ পরীক্ষা করে রায় দিলেন – যক্ষ্মা৷ ডাক্তারদের পরামর্শে রবীন্দ্রনাথ রেণুকাকে নিয়ে হাওয়াবদল করলেন দু'বার৷
অসুস্থ রেণুকাকে শোনানোর জন্য লিখলেন ‘শিশু' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুচ্ছ৷ অবশেষে মাত্র বারো বছর বয়সে চলে গেলো রেণুকা; মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর দশ মাসের মধ্যে৷
১৯০৫-এ পরিণত বয়সে মৃত্যু হলো পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের৷
এর মাত্র দু'বছর পর রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র এগারো বছর বয়সি শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুত্যুবরণ করলো । মুঙ্গেরে বেড়াতে গিয়ে কলেরায় আক্রান্ত হলো শমীন্দ্রনাথ৷ খবর পেয়ে শান্তিনিকেতন থেকে মুঙ্গেরে পৌঁছানোর আগেই মারা গেলো শমীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ তখনো পথে। বলে দিলেন তার জন্যে অপেক্ষা না করে শমীন্দ্রনাথকে দাহ করে ফেলতে। আদরের ছেলে কে শেষ দেখা ও দেখতে পারলেন না কবিগুরু।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘‘...শমী যে রাত্রে চলে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে, কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই৷ মন বললে কম পড়েনি, সমস্তর মধ্যে সবই রয়ে গেছে৷ আমিও তার মধ্যে৷' সে সময়ে রচিত হলো তার অমর সৃষ্টি ," আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে !
আজ জ্যোত্স্নারাতে সবাই গেছে বনে
বসন্তের এই মাতাল সমীঁরণে ।।
যাব না গো যাব না যে, রইনু পড়ে ঘরের মাঝে-
এই নিরালায় রব আপন কোণে
যাব না এই মাতাল সমীরণে ।।
আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে
ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে ।
আমারে যে জাগতে হবে, কী জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে
বসন্তের এই মাতাল সমীরণে ।।
বড়ো মেয়ে মাধুরীলতার সংসার জীবন শেষ পর্যন্ত সুখের ছিলো না৷ রবীন্দ্রনাথের জীবনে এটাও এক বেদনাত্মক অধ্যায়৷ জামাতা শরতের অন্যায় গর্হিত আচরণ আর মাধুরীলতার প্রতি চরম নির্যাতন সইতে না পারলে ও অসহায় পিতা রবীন্দ্রনাথ কিছুই করতে পারেন নি।জামাতার সাথে তাঁর সম্পর্ক তিক্ততায় পৌঁছেছিলো৷ মেয়ের বাড়িতে তাঁর যাওয়া আসাও তেমন ছিলো না৷ কন্যার কষ্ট সইতে না পেরে বলতেন." ছোটকালে মাধুরীলতার কঠিন অসুখ হয়েছিলো, সেদিন সে মরে যেতো যদি, আমাকে তার এমন কঠিন সময় দেখতে হতো না।"
একদিন হঠাৎ খবর এলো মাধুরীলতা অসুস্থ৷ রাজরোগ যক্ষ্মায় আক্রান্ত মাধুরীলতা । শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে রবীন্দ্রনাথ প্রায় রোজই মেয়েকে দেখতে যান৷ জামাতার চরম অপমান জনক আচরণ নীরবে সয়ে গেছেন বিশ্বজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! লেখিকা হেমলতা দেবী জানাচ্ছেন, ‘‘অতি আদরের মেয়ে বেলা মৃত্যুশয্যায়, সব অপমান চেপে তিনি দেখা করতে যেতেন তার কন্যা বেলা (মাধুরীলতা) র সাথে। শ্বশুর মশাইকে দেখে শরৎ টেবিলের ওপর পা তুলে দিয়ে সিগারেট খেত৷ পা নাবাতো না পর্যন্ত – এমনি করে অপমান করত৷ উনি সব বুকের মধ্যে চেপে মেয়ের পাশে বসতেন...৷''মাধুরীলতার মৃত্যু হলো বত্রিশ বছর বয়সে৷
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পিতৃস্মৃতি' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘‘সেদিন ২ জ্যৈষ্ঠ – যখন তিনি শ্রীরামপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন, তিনি বুঝতে পারলেন যা হবার তা হয়ে গেছে৷ গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন৷ সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্রার বৈঠক ছিল৷ বাবা সকলের সঙ্গে হাসিমুখে গল্পসল্প যেমন করেন, সেদিনও তাই করলেন৷ তাঁর কথাবার্তা থেকে একজনও কেউ ঘুণাক্ষরে জানতে পারল না যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা হয়ে গেছে, মনের কী অবস্থা নিয়ে বাবা তাদের সঙ্গে সদালাপ করছেন৷''
১৯২৩-এ মৃত্যু হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৯২৫ সালে মারা যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯২৬-এ দ্বিজেন্দ্রনাথ, ১৯৩২-এ দিদি স্বর্ণকুমারী মুত্যুবরণ করেন ৷
১৯৩২-এ একাত্তর বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ হারালেন কন্যা মীরার পুত্র কুড়ি বছর বয়সি আদরের নাতি নীতিন্দ্রনাথকে৷ উচ্চতর শিক্ষার জন্য নীতিন্দ্রনাথ গিয়েছিলো জার্মানিতে৷ টেলিগ্রামে নীতুর মৃত্যু সংবাদ এলো৷ শান্তিনিকেতনে তখন 'বর্ষা মঙ্গল' উৎসবের আয়োজন চলছে৷
আয়োজন বন্ধ হলো না৷ রবীন্দ্রনাথ মীরাকে দীর্ঘ চিঠিতে লিখলেন, ‘‘নীতুকে খুব ভালবাসতুম, ... অনেকে বললে, এবার বর্ষামঙ্গল বন্ধ থাক আমার শোকের খাতিরে৷ আমি বললুম, সে হতেই পারে না; আমার শোকের দায় আমিই নেব৷''
শোকের দায় আবার নিতে হলো রবীন্দ্রনাথকে , তার মৃত্যুর এক বছর আগে৷ আরেক প্রিয় ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অকাল মৃত্যুর সংবাদ পেলেন মংপু-তে বসে৷ জন্মদিনের আয়োজন চলছিলো তখন৷ ভাইঝি ইন্দিরাকে লিখলেন, ‘‘তোরা বোধহয় জানিস আমার নিজের ছেলেদের চেয়ে সুরেনকে আমি বেশি ভালোবেসেছিলুম৷'' কবিতা লিখলেন সুরেনের স্মৃতিতে, ‘‘আজি জন্মবাসরের বক্ষ ভেদ করি/ প্রিয়মৃত্যুবিচ্ছেদের এসেছে সংবাদ...''
রবীন্দ্রনাথ একবার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এ ভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না৷''
No comments:
Post a Comment