

জন্ম হয়েছিল তোর সকলের কোলে আনন্দকল্লোলে।
নীলাকাশ, আলো, ফুল, পাখি, জননীর আঁখি,শ্রাবণের বৃষ্টিধারা,
শরতের শিশিরের কণা,
প্রাণের প্রথম অভ্যর্থনা।
জন্ম সেই এক নিমেষেই
অন্তহীন দান,
জন্ম সে যে গৃহমাঝে গৃহীরে আহ্বান।
মৃত্যু তোর হোক দূরে নিশীথে নির্জনে,
হোক সেই পথে যেথা সমুদ্রের তরঙ্গগর্জনে
গৃহহীন পথিকেরই নৃত্যছন্দে
নিত্যকাল বাজিতেছে ভেরী;
অজানা অরণ্যে যেথা উঠিতেছে উদাস মর্মর,
বিদেশের বিবাগী নির্ঝরবিদায়-
গানের তালে হাসিয়া বাজায় করতালি;
যেথায় অপরিচিত নক্ষত্রের আরতির থালি চলিয়াছে অনন্তের মন্দির-সন্ধানে,পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে।
দুয়ার রহিবে খোলা; ধরিত্রীর সমুদ্র-পর্বতকেহ ডাকিবে না কাছে, সকলেই দেখাইবে পথ।
শিয়রে নিশীথরাত্রি রহিবে নির্বাক,
মৃত্যু সে যে পথিকের ডাক।
( 'মৃত্যুর আহ্বান'- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
বসন্তের বাতাসটুকুর মতো চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা ঢেউয়ের মতোন ভেসে - হাসিটুকু রেখে গেছে!! শত শত ফুল ফুটিয়ে অনন্তলোকের নক্ষত্র হয়ে গেলো সবার আদরের ফারিহা !
কবিগুরু যতোই বলে যান ,"পিছু ফিরে চাহিবার কিছু যেথা নাই কোনোখানে। " ফারিহার পিছু ফিরে চাহিবার সবকিছু রয়ে গেছে ! মা, বাবা, দাদীমা, আদরের ছোটবোন...খেলার সাথী সবাই তো আছে- শুধু চলে গেলো ফারিহা!সে কোন্ অনন্তের নক্ষত্রলোকে!
"সে চাঁদের চোখে বুলিয়ে গেল ঘুমের ঘোর ,সে প্রাণের কোথায় দুলিয়ে গেল ফুলের ডোর,কুসুমবনের উপর দিয়ে কী কথা সে বলে গেল...."
আকাশের এক ধ্রুবতারার নাম ফারিহা জাহান !মাত্র সতেরো বছর বয়সে স্বজন পরিবার বন্ধুদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশে হারিয়ে গেলো গত ৩ মে, ২০১৪ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়!
কথায় বলে, পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারী বস্তু 'পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ'! বিশ্বকবির চিত্তের জোর ছিল,তাই তাঁর মাতা , স্ত্রী , তিন সন্তান হারানোর শোক সয়ে ও জ্ঞানের সাধনা করে গেছেন সেই কৈশোর থেকে একাশি বছর বয়স পর্যন্ত। সেই মানসিক জোর আজ বড়ো প্রয়োজন সদ্য সন্তানহারা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু এবং ফারাহ দিবার।
সদ্য প্রয়াত কিশোরী ফারিহার মা ফারাহ দিবা একজন ব্যস্ত ব্যাংক কর্মকর্তা! সব ব্যস্ততা আজ থমকে গেছে!
প্রথম সন্তান- অনেক স্বপ্নের , অনেক আকাঙ্খার ! প্রথম মা হতে গেলে অনেক জটিলতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় একজন মা'কে। একেবারে যেন মৃত্যুর দুয়ার পার হয়ে আসা! ফারিহাকে জন্ম দেবার সেই কষ্ট নতুন করে যেন মায়ের বুকে বাজছে আজ!
১৭ বছরের প্রাণোচ্ছ্বল কন্যারত্নটি এভাবে সবাইকে ছেড়ে চলে
গেলে, কী থাকে আর মায়ের স্বান্তনা?
ফারিহার জন্ম ১৯৯৬ সালের ৯ সেপ্টেম্বর । ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী যাবার পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দিবার বাবা-মা একসাথে প্রাণ হারান।ফারিহা তখন ৬ মাসের; দিবা তার বাবা-মাকে একসাথে হারালেন। এর কিছুদিন পরই দিবা তার অতি প্রিয় মেজো ভাই কে হারান। প্রিয়জন বিচ্ছেদের ঝড় এসে আবার লুটে নিলো দিবার প্রাণের চেয়ে প্রিয় বড়ো সন্তান ফারিহা জাহানকে!
ফারিহা যখন কথা বলতে শিখলো, দাদীমার ভাষাই যেন তার ভাষা। দাদীমার ভাই-বোন ভগ্নীপতি , যাদের যে নামে তিনি ডাকতেন, ছোট্ট ফারিহা ও একই সম্বোধন বা নাম ধরে ডাকতো তাদের সবাইকে। শওকত আরা জাফরের একমাত্র বড়ো বোন রওশন আরা হাসনাত দম্পতি কে 'বড়ো আপা' আর 'দুলাভাই' সম্বোধনেই কথা বলতো ফারিহা। দাদীমার ভাই দের ডাকতো সাদবাস, খোশবাস! দাদীমার ছোটবোন- ভগ্নিপতি আল্লাদি- সাইফুদ্দিন ও ফারিহার কাছে 'আল্লাদি-সাইফুদ্দিন' ! তৃতীয় প্রজন্মের কেউ নাম ধরে ডাকছে-এতে সবাই যেন অন্যরকম ভালোবাসা আর আন্তরিকতার ছোঁয়া পেতেন; একই সাথে মজাও পেতেন! ফারিহার শেষ নিঃশ্বাসটুকুর সাথে তাকে ঘিরে সকলের সব স্বপ্ন আর ভালোবাসা যেন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
৩ মে ২০১৪, শনিবার বিকেল ৫ টার দিকে হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে ঝড় উঠলো! দু'দিন ধরে এজমার টানে কষ্ট পাচ্ছিলো, সেদিন শ্বাসের কষ্টটা একটু কম মনে হওয়াতে ছুটে বেড়াচ্ছিলো কিশোরী মেয়েটা।দুরন্ত কৈশোরের উন্মাদনায় ভুলে যায় নিজের অসুস্থতার কথা! পাশের বাড়ির খেলার সাথীকে নিয়ে ছাদে ছুটে যায় ফারিহা।
সেদিন দিবার ব্যাংক বন্ধ। ছুটির দিনে সন্তানদের সাথেই সময় কাটাতে চায় মা! মায়ের মন যেন 'কু' ডাকে কোথাও! দিবা বারণ করলেন কন্যাকে বাইরে যেতে!
দুরন্ত কৈশোর কী আর মায়ের বারণ মানে! ফারিহা জবাব দেয়, " ছাদ থেকে কাপড় নিয়েই চলে আসবো আম্মু, একটু যাই? " মা'কে দেয়া কথা রেখেছিলৌ ফারিহা । কাপড় তুলতে যেটুকু সময়, ততোটুকুই । বেশিক্ষণ ছাদে থাকে নি; ঘরে ফিরে আসে ফারিহা!
তবু আকাশ -বাতাস কাঁপানো সেই ধুলিঝড়ে এই পরিবারটির সব সুখের বার্তা যেন উড়িয়ে নিয়ে গেলো !! ফারিহার নির্মল কৈশোরের অনাবিল আনন্দের বানের তোড়ে মৃত্যুবাণ ছিল কি সেই ঝড়?
এরপর আবার বাড়ীতে ঢুকে কী মনে করে ময়দা দিয়ে ঝাল পিঠা
বানিয়ে বাবা- মা,দাদী, ছোট বোন ফাইরুজ - সবাইকে খাওয়ালো।
কেউ বুঝতে পারলো না দ্বিতীয় বারের মতো ডাষ্ট ইনহেইল করে
সর্বনাশ ডেকে আনলো মেয়েটা! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে ছটফট করলো - ইনহেলার, নেবুলাইজার- কোনটাই কোন কাজই করলো না, শ্বাসনালীতে পানি জমে গেছে ইতিমধ্যে।
নিঃশ্বাসের প্রবল কষ্ট থেকে একটু বাঁচার আকুতিতে অসহায় ফারিহা চিৎকার করে বাড়ির এই কামরা থেকে ঐ কামরা... ..ডাইনিং থেকে ড্রইং রুমের এপ্রান্ত -ওপ্রান্ত আছড়ে পড়লো,"আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, আমি কি বাঁচবো না? আমি বাঁচতে চাই..."!
খবর পেয়ে গলির মুখ থেকে ছুটে ঘরে ফিরে এলো অসহায় পিতা!
পিতা মাতা , আদরের ছোটবোন, দাদীমা, খেলার সাথী- সবার সামনেই মৃত্যুযন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে ঘরের দরজায় পড়ে গেলো ফারিহা।
আবার উঠে প্রিয়তম বাবার বুকে ঝঁপিয়ে পড়ে বললো, "আব্বু আমাকে বাঁচাও, আব্বু আমি বাঁচতে চাই, আব্বু, আমি বাঁচতে চাই!!" ফারিহার হাত ধরে তার পাশেই ছিল তাদের চার দশকের প্রতিবেশী শাহীন, তার ভাই হাসনাতসহ তাদের পরিবারের সবাই- যারা এই পরিবারের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়ের চেয়েও অনেক বেশি আপন, অনেক নিকটজন। নেবুলাইজার ইনহেলার কাজ করছে না, হাসনাত স্যান্ডেল ছাড়াই ছুটে যায় নতুন ইনহেলার আনতে । রুদ্ধশ্বাসে ইনহেলার নিয়ে ফিরেও আসে হাসনাত। না , কিছুতেই কিছু কাজ করলো না শেষ মুহুর্তে!
অসহায় পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর ডাকে নিমেষে ছুটে এলো বন্ধু ডাক্তার মঈনুদ্দীন। চিকিৎসক হয়েও অসহায় ভাবে কন্যাসমা ফারিহার মৃত্যু মেনে নিতে হলো তাকে।আপ্রাণ চেষ্টা করেও প্রয়োজনীয় জরুরী চিকিৎসা দেবার জন্যে কিছুই পাওয়া যায়নি সেদিন। গলি পেরুতেই সদরঘাট পোষ্ট অফিস। গাড়ি স্টার্ট দিতেই বড়ো একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো প্রাণোচ্ছল কিশোরী মেয়েটি।
চট্টগ্রামের সদরঘাট কালিবাড়ি মোড়ে জনসাধারণের চিকিৎসার জন্যে সম্প্রতি মেমন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ! কোন স্বাস্থ্যসেবাই নেই এখানে। সবই মিথ্যা ! ফারিহা কে কোলে নিয়ে অক্সিজেনের জন্যে এই হাসপাতালের তিনতলা পর্যন্ত ছুটে যেতে হয়েছে পাপ্পু এবং অন্যদের । সেদিন পাওয়া যায়নি অক্সিজেন। এর পর গোলপাহাড়ের মোড়ে রয়েল হাসপাতালে চুটে গেলো তারা। ফারিহার খালু ডা. লিয়াকত এই হাসপাতালের পরিচালক । পাপ্পু এই হাসপাতালেই দুইটি দোকান পরিচালনা করেন। কিন্তু না, এখানেও ফারিহা কে জরুরী চিকিৎসা দেয়া গেলো না। ডাক্তার মঈনুদ্দিনের মনে হলো,সামান্য জরুরী চিকিৎসা দেবার মতো কোন হাসপাতাল ও যেন চট্টগ্রামে নেই!
ফারিহার দাদীমা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা শওকত আরা জাফরের চোখের দৃষ্টিই ছিল পৌত্রী ফারিহা। ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন তিনি । রাতে দাদিমার গায়ে কাঁথা তুলে দেয়া , সকালে তাকে পত্রিকা পড়ে শোনানো,খাওয়ার সময় বা কোথাও বেড়াতে গেলে নজরদারী করা -সবকিছু ফারিহা আগ বাড়িয়েই করতো। আজ এ শূন্যতা বড়ো কঠিন হয়ে বাজে শওকত আরা জাফরের বুকে! চোখের জলে লাগলো জোয়ার, দুখের পারাবারে , ও চাঁদ!!

ফাইরুজের নিদ্রাহারা রাতের প্রহর কাটে না !! ফারিহার আদরের ছোট বোন ফাইরুজ ষষ্ঠ শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রী। পড়ালেখা ছাড়া বাইরের জগত তার খুব চেনা নেই ! সারা দিন খুনসুটি করা একমাত্র বোনের আকস্মিক প্রয়াণে নির্বাক নিস্তব্ধ ফাইরুজ! ৩ মে দুপুরে ও একই রকমের টপ্স পরে ছবি তুলেছে ফারিহা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সব শূন্য করে চলে গেলো বোন টি!! খেতে বসলে মুরগীর মাংস দেখলেই বুকে মোচড় দেয়, আদরের বোনটি মুরগীর মাংস ছাড়া খেতেই চাইতো না। ফারিহার স্মৃতিতাড়িত ফাইরুজ আর খেতে পারে না! কী করে চলে গেলো আদরের বোন টি!! কী করে খাবো আমি!
অবিরল অশ্রুধারায় ভেসে মায়ের মনে পড়ে আদরের কন্যাটি দু'দিন আগে ৩০এপ্রিল মায়ের জন্মদিন পালন করেছে ! রাত প্রথম প্রহর -১২ টা ১ মিনিটে ফারিহা 'হ্যাপী বার্থডে টু ইউ' গানটা ছেড়ে মাকে জন্মদিনের শুভকামনা জানালো। দুপুরে শওকত আরা জাফর অনেক কিছু রান্না করলেন একমাত্র পুত্রবধুর জন্মদিন উপলক্ষে । ।ফারিহা বললো, " দাদী, আজকে তোমার রান্না অনেক মজা হয়েছে! আম্মু, দ্যাখো, দাদি তোমার জন্মদিনে কী মজা করে রান্না করেছে!" এসব বলে অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছে সন্তান হারা মা দিবা! ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার শুরুতেই ফারিহার নামে একটা ডিপিএস করেছিলো দিবা। সেটা ম্যাচিউরড হয়েছে ১২ বছরে। দিবার স্বপ্ন ছিল, ফারিহার একদিন বিয়ে হবে, সেই সময়ে তার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান এই টাকায় করবে!!দিবা তার সেভিংসের ও নমিনি করেছিলো ফারিহাকে; প্রথম সন্তান, সবাইকে দেখে শুনে রাখবে-এমন স্বপ্নে !
সব যেন আজ ধুলায় হয়েছে ধুলি!!
কী স্বান্তনা আছে সন্তানহারা এই মায়ের??
দাদীমার শখ , তাই বড়োফুপুর মতো বাড়িতে বসেই গান শিখতো
ফারিহা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হাতে খড়ি হয় দাদীমার ইচ্ছেতেই। দাদী
বললেই হারমোনিয়াম নিয়ে বসে যেতো গাইতে!
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে
বন্ধ- এই বানী চিরন্তন হয়ে গেঁথে ছিলো ফারিহার মনে। আর তাই এইটুকু বয়সেই সবার একজন করে ফারিহা গড়ে
তুলেছিলো নিজেকে!
শুধু কি পরিবারে? প্রতিবেশী , শিক্ষক সবার কাছেই ফারিহা ছিল একান্ত স্বজন!
ফ্ল্যাট সংস্কৃতির এই বন্ধ্যা সময়ে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিবেশীদের
অন্তর দিয়ে র্হাদিক বন্ধনে আত্মার আত্মীয় করে নেবার অসাধারণ
বিশালত্ব ছিল ' ফারিহা' নামের ক্ষণজন্মা কিশোরীটির অন্তরে!!যা আত্মকেন্দ্রীকতার এই নষ্ট সময়ে সত্যিই বিরল!
চট্টগ্রামের সদরঘাট পোষ্ট অফিস গলি সনাতন ধর্মবলম্বীদের আদি এলাকা। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়েও এই পাড়ার মানুষগুলো ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে তরুণদের মাঝে এই এলাকায় অসাম্প্রদায়িক বন্ধন ধরে রেখেছিলো যারা ,তাদের মধ্যে ফারিহা ছিল সবার আগে।
প্রতিটা পূজা পার্বনে ফারিহার সরব উপস্থিতি মাতিয়ে রাখতো প্রতিবেশীদের!! তাদের আত্মার আত্মীয় ছিল যেন চঞ্চলা হরিনী এই কিশোরী।কলা পাতায় রাখা পূজার প্রসাদ তার ভীষণ প্রিয় ছিল।
রক্ষণশীল মা দিবার সংস্কারমনস্ক মন কোনভাবেই মেনে নিতে পারতো না জনারন্যে ফারিহার এমন সহজ মিশে যাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে মায়ের বারণ বদলাতে পারেনি ফারিহার মুক্ত অসাম্প্রদায়িক মানবিক জীবনাচার!!
ফারিহার এ মানবিক আচরণ সকলের অন্তরের একজন করে তুলেছিলো ফারিহাকে। যে কারণে ফারিহার আকস্মিক প্রয়াণ প্রতিবেশীদের মধ্যে বিশাল এক শূন্যতার সৃষ্টি করেছে!
প্রতিবেশীদের আকুল কান্নার জল অতলে ভাসিয়ে দেয় ফারিহার বাবা-মায়ের বেদনার্ত হৃদয়! তাদের অন্তরের শূণ্যতাকে যেন আরো শূন্য করে দেয়!
পাঁচিলের ওপারে সঙ্গীতা বিশ্বাস পলিরা সপরিবারে থাকে। এই
দুই পরিবার গত চার দশকের ও বেশি একসাথে আছেন। হিন্দু-মুসলিম অকৃত্রিম অসাম্প্রদায়িক বন্ধনের চার দশকে এসেও অটুট
থাকার প্রধান সূত্র ছিল ফারিহা।
ফারিহা তার বাবার সহপাঠী পলিকে পাঁচিলের এপার থেকে চিৎকার করে ডেকে বলতো, "পলি ফুপু, নিরামিষ রেঁধেছো? আমাকে দিও কিন্তু!"
পলি কয়েকদিন আগে এ্র্যাক্সিডেন্ট করে বেশ ব্যথা পায়। চিকিৎসকের পরামর্শে ফিজিওথেরাপী নিতে হয়। আর পলির ফিজিওথেরাপিষ্ট ছিল ফারিহা। পলিকে প্রতিদিন ফারিহার কাছে চলে আসতে হতো। ফারিহার টেবিলে বসে ফারিহার হাতে ফিজিওথেরাপী নিতে হতো পলিকে ।
একদিন ফারিহার মা দিবা বললো, আজকে আমি পলিকে থেরাপী দিই, ফারিহা?" সেদিন পলিকে থেরাপী দেবার পর দিবার অনভ্যস্ত হাতে প্রচন্ড ব্যথা হয় । মায়ের মন,!! ফারিহা কে দিবা বলে, "একদিন থেরাপী দিয়েই আমার হাতে কী প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে, ফারিহা,, তুমি প্রতিদিন এভাবে পলিকে থেরাপি দিওনা।, তোমার অনেক কষ্ট হয়, ব্যথা বেড়ে যাবে !"
ফারিহা হেসে জবাব দেয়, " না, আম্মু, পলি ফুপুর হাতে অনেক ব্যথা। আমি থেরাপি দিলে ব্যথাটা ভালো হয়ে যাবে! " এমনই মানবিক অনুভূতিসম্পন্ন চপলা কিশোরী ফারিহার মৃত্যু কী করে মেনে নেবে তার পলি ফুপু?!
এলাকার আরেক আদি বাসিন্দা 'হাজী সাহেব' এবং তার পরিবার।
তাদের বড়ো বউ ফারিহার প্রিয় মিলি আন্টি। শেষ দিন টিতেই
তার কাছে চুটে গিয়ে ফারিহা বলেছিলো, " মিলি আন্টি, তুমি কবে
আমাকে চিকের বিরিয়ানী খাওয়াবা?" জবাবে ফারিহার মিলি
আন্টি দুষ্টুমি করে বলেছিলেন," তুই আগে আমাকে পিৎজা
খাওয়াবি কবে? তারপর তোকে বিরিয়ানী খাওয়াবো।" না, আর
কখনো চিকেন বিরিয়ানী খেতে আসবে না ফারিহা! ফারিহার
আকস্মিক প্রয়াণে শোক বিহ্বল হলেও ,মিলি আন্টি চিকেন
বিরিয়ানি রান্না করে পাঠালেন। ফারিহার ছোট ফুপু ইসরাত
জাহান কণা তাৎক্ষণিকভাবে সেই চিকেন বিরিয়ানি ডেকচি সহ
এতিম খানায় পাঠিয়ে দিলেন। অনাথ শিশুরা যদি খেয়ে খুশি হয়,
নিশ্চয়ই ফারিহার আত্মা শান্তি পাবে!
এভাবেই আত্মার আত্মীয় হয়ে প্রতিবেশীদের সাথে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ানো চঞ্চলা- চপলা কিশোরী ফারিহা চোখের পলকে প্রাণহীন নীরব শবদেহে পরিণত হলো!
রূঢ় এ বাস্তবতা এলাকার আত্মার আত্মীয় - শিশু থেকে বৃদ্ধ নারী-পুরুষ কেউ মেনে নিতে পারছেন না!! ফারিহা আর কখনো খেলতে আসবে না, পূজা দেখতে আসবে না! প্রতিবেশীদের কাছে পূজার প্রসাদ বা তার প্রিয় নিরামিষ খাবার খেতে আসবে না!!
সদরঘাট পোষ্ট অফিসের সামনে গলির ভেতরে বাইরে কালো ব্যানার আর ফারিহার জন্যে শোকের বাণীতে ছেয়ে গেছে। যে কারো চোখ জলে ভিজে যায়!
মনে করিয়ে দেয়, প্রাণের পরে চলে গেলো ,বসন্তের বাতাস টুকুর মতো ...সে যে চঞ্চলা কিশোরী ফারিহা!
২৮ এপ্রিল ২০১৪ তার জীবনের শেষবারের মতো একাদশ শ্রেনীর ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নেয় ফারিহা। এর পরের পরীক্ষার দিনগুলোতে তার নামের পাশে 'অনুপস্থিত' লেখা হলো, যা চিরস্থায়ী হয়ে গেলো। আর কোনদিন ফারিহা পরীক্ষার কেন্দ্রে বসে পরীক্ষা দেবে না! ৫ মে তার একাদশ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো। কথা ছিলো পরীক্ষা শেষ করে ফারিহা চিরাচরিত নিয়মে আনন্দে মেতে উঠবে, আর ২য় বর্ষে ক্লাস শুরু করার মানসিক প্রস্ততি নেবে।
এসবের কিছুই হলো না।পরীক্ষার কক্ষে তার আসনটি শূণ্যই পড়ে রইলো।ফারিহার সহপাঠীরা কলেজ ক্যাম্পাসে ঝুলালো কালো ব্যানার।
মৃত্যু অমোঘ! তার কাছে সত্যিই মানুষ বড়ো অসহায়!!
অমরত্বের প্রত্যাশা কারো নেই । তবু এমন অকাল আর এমন আকস্মিক মৃত্যু কাঙ্খিত নয় কারো! প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে সময়মতো জরুরী চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাতে হলো এই কিশোরীকে। যা মেনে নেয়া অসম্ভব !
ফারিহার মা দিবা এবং বাবা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুর বুকে পাথর সমান এ ভার বয়ে বেড়াতে হবে আমৃত্যু । ফারিহার প্রাণ ছিল তার দাদীমা শওকত আরা জাফর । অবসরপ্রাপ্ত এ ব্যাংক কর্মকর্তা কোন ভাবেই ভুলতে পারেন না প্রিয়তম নাতনীর বাঁচবার আকুল মিনতি !, নুসরাত জাহান রুমা এবং ইসরাত জাহান কণাও প্রাণপ্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রীর আকস্মিক প্রয়াণে মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত!
ফারিহার বালিশ, জামা কাপড় নিয়ে অবিরল অশ্রুধারায় নির্ঘুম প্রহর কাটছে তার মা দিবার। কী স্বান্তনা আছে , যা দিয়ে মায়ের শূন্য বুকে ফিরিয়ে আনা যায়, এমন প্রানবন্ত সন্তানকে?
ফারিহার ছোট ফুপা কাজী আদনান শিশুদের সাথে মিশে যান শিশুদের মতো হয়ে। ফারিহা- ফাইরুজ শৈশব থেকেই ফুপার কোলে পিঠে বড়ো হয়েছে পুপাতো বোন আইমান আতুশার সাথে সাথে। আরো ছিলো আইমান আতুশার ফুপাতো বোন শামা-ইয়ানা এবং সমবয়সী অন্যান্যরা। নিজের কন্যা না হয়েও কন্যা সমতুল্য ফারিহার এমন আকস্মিক মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না কাজী আদনান।
আর প্রিয়তম পিতা -যাকে চোখে হারাতো ফারিহা? সেই পিতার বুকেই বারবার আছড়ে পড়েছে বাঁচবার আকুতি তে। সবার সাথে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে সদ্য সন্তান হারা পিতা সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পু । শূন্যতার জগদ্দল পাথর বুকে নিয়েও সবসময়ের মতোহাল্কা রসিকতা - তার বুকের ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা কখনোই পূরণ হবার নয়! তবু জীবন বয়ে যায় নিত্য, অনন্ত ধারায়!!
রবীন্দ্রনাথ অমৃতের সন্তান ছিলেন- মৃত্যুশোককে সহজে মেনে নেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তার! কৈশোর থেকে মাতৃমৃত্যুর মধ্যে দিয়ে শুরু হয় কবিগুরুর মৃত্যুশোক!
ফারিহার স্বজন- প্রিয়জনদের বেদনার ঝড় কাটাতে শরণাপন্ন হলাম রবীন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন তেরো বছর দশ মাস, তখন তিনি তাঁর মা'কে হারান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ে করার চার মাস পর ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী কাদম্বরী দেবী ।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আট বছর বয়স থেকে যিনি তাঁর খেলার সাথী ছিলেন।
মৃত্যুশোকের এই ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছেদশোকের অশ্রুমালায় যুক্ত হলেন কবিপত্নী মৃণালিনী দেবী৷ প্রথম সন্তান প্রসবের সময় মৃনালিনীর বয়স কম ছিল বলে কবি যেন ভরসা পেতেন না ।তাই সন্তানের দেখা শোনা অনেকাংশেই রবীন্দ্রনাথ করতেন। তিনি পিতা হয়েও কন্যাকে লালন পালন করতেন মাতৃরূপে। শিশুকে খাওয়ানো, কাপড় পড়ানো, বিছানা বদলানো এসবই তিনি করতেন নিজ হাতে।
১৩০৯ সালে ৭ই অগ্রহায়ণ, ইংরেজী ১৯০২ সালের ২৩শে নভেম্বর, রবিবার কবিপত্মী মৃনালিনী দেবী মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রীর মৃত্যু শয্যায় নিজ হাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সেবা-যত্ন করতেন। প্রায় দু'মাস তিনি শয্যাশায়ী ছিলেন, ভাড়া করা নার্সদের হাতে পত্মীর সুস্থ্তার ভার তিনি একদিনের জন্যও দেননি। সেই সময়ে প্রচলিত অর্থে স্বামীর সেবা পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়! মৃনালিনী দেবী সেটা পেয়েছিলেন ভাগ্যগুনে। তখনকার দিনে ইলেকট্রিক ফ্যান আসেনি । হাত পাখা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি বাতাস করেছেন স্ত্রীকে। এক মুহুর্তের জন্যেও হাতের পাখা ফেলেননি।অকালে চলে গেলেন তিনি৷ তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ৷
এভাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনে পরপর তিন সন্তান সহ ১৩ প্রিয়জন কে হারাতে হয় ! কবিগুরুর জীবনের সবচেয়ে বড়ো অধ্যায়, শোকবিধুর সেই অধ্যায় স্মরণ করছি আজ ।যাঁকে প্রিয়জন হারানোর শোকে আক্রান্ত হতে হয়েছে বারবার।
দেড়শ' বছরের ও বেশি সময় পর আজকের দিনেও সদ্য সন্তানহারা শোক বিধ্বস্ত মা ফারাহ দিবা এবং সৈয়দ আবু শাকের পাপ্পুসহ ফারিহার স্বজনদের মানসিক শক্তি ধরে রাখার প্রেরণা দেবে রবীন্দ্রনাথ!
সব শেষে রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি। তাতে কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘‘সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোন খানে কোন সূত্র যেন ছিন্ন হয়ে না যায়৷ যা ঘটে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি৷'' রবীন্দ্রনাথ সকল মৃত্যুশোককে এভাবেই সহজ করে বরণ করে নিয়েছিলেন৷ অনায়াসে তাই বলতে পেরেছিলেন, ‘‘ঈশ্বর যাহা দিয়াছেন তা গ্রহণ করিয়াছি৷ আরো দুঃখ যদি দেন তো তাহাও শিরোধার্য করিয়া লইব৷ আমি পরাভূত হইব না!"
এভাবেই ফারিহার পরিবার এবং বান্ধবদের শক্তি দিক্ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!
১০ মে ২০১৪, শনিবার, রাত প্রথম প্রহর, চট্টগ্রাম
রাত ২টা ৩৮ মি.