
আমার খুব ভালো লাগছে। এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করছি। দেশের আর সব ক্ষেত্রের মত সাংবাদিকরাও যখন দলীয়ভাবে বিভক্ত তখন একটি ইস্যুতে দেশের ১৬ জন সম্পাদক এক হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, এটা শুধু আমার জন্য নয়, সবার জন্যই আনন্দের। গত ১৮ মে দেয়া বিবৃতিতে কী আছে তা দেখার আগে মানতেই হবে দেশের কোনো একটি ইস্যুতে তাদের একমত হতে পারাটাও আমাদের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য বিশাল অগ্রগতি। বিস্তারিত দেখার আগে আমি গভীরভাবে নামের তালিকায় চোখ বুলিয়েছি।
আমাদের স্বভাব হলো লেখা, বিবৃতি, টক শো- যাই দেখি, কী বলছেন তা শোনার আগেই মিলিয়ে নেই- তিনি আওয়ামী লীগ না বিএনপি। সেই ‘কুস্বভাব’ মাথায় রেখেই আমি বিবৃতিদাতাদের তালিকা দেখেছি। সত্যি আমি বিস্মিত, আমি আনন্দিত। তালিকায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান যেমন আছেন, আছেন নয়া দিগন্ত সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিন। সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার যেমন আছেন, আছেন ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দিনও। বিস্তারিত লেখার আগে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই তালিকাটি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করছি। চারজনের নাম তো লিখলাম। বাকিরা হলেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সম্পাদক মাহবুবুল আলম, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, ডেইলি টুডে সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ, কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান, মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক এ এইচ এম মোয়াজ্জেম হোসেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজাম, নিউ নেশন সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক সাইফুল আলম এবং বাংলানিউজ ২৪ডটকমের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন। তালিকার সবাই আমার পরম শ্রদ্ধেয়। ওনাদের প্রায় সবাই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনেক স্নেহ করেন। অন্তত দুজন সম্পাদকের অধীনে আমি কাজ করেছি। অন্তত চার জনের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ে রিপোর্টিং করার সৌভাগ্য হয়েছে। এই তালিকায় ইত্তেফাক, জনকণ্ঠ, ভোরের কাগজ, সংগ্রাম, দিনকাল-এর মত মূলধারার বাকি কয়েকটি পত্রিকার সম্পাদকদের যুক্ত করে নিলেই এটি হতে পারে দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফোরাম।
তাদের বিবেচনার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। এমনকি আমি আশা করবো এই ফোরাম কোনো দাবি জানালে তা সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়িত হবে। আমাদের সব প্রাপ্তি যখন দলবাজির চোরাবালিতে হারিয়ে যায়, তখন এই ফোরামটি হতে পারে দলনিরপেক্ষতার বাতিঘর, আমাদের সবার আশ্রয়, জাতির সত্যিকারের বিবেক। গণমাধ্যমের প্রধানদের এই ফোরামটির সঙ্গে নিত্যদিন জনগণের সরাসরি যোগাযোগ। তাই আমাদের সরকারি দল, বিরোধী দল এদের সঙ্গে পরামর্শ করেই তাদের কর্মপন্থা ঠিক করতে পারেন। কী করলে জনগণের ভালো হবে, জনগণ খুশী হবে, তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন।
বিভিন্ন নামে সংবাদপত্রের মালিক-সম্পাদকদের একাধিক সংগঠন আছে। তারা সংবাদপত্রের ছুটি, নিউজপ্রিন্টের দাম, বিজ্ঞাপনের মূল্য, ওয়েজবোর্ড- এই ধরনের নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই শুধু মাথা ঘামান। কিন্তু এই বিবৃতিতে যে ফোরামের ভ্রুণ লুকিয়ে আছে তা আরো বৃহত্তর বিষয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। নির্ধারক হতে পারে সাংবাদিকতার মানদণ্ডের। এখন দেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা পড়ানো হয়। এটা খুবই আনন্দের খবর। এখন অনেক মিডিয়া, তাই অনেক প্রশিক্ষিত সাংবাদিক দরকার। কিন্তু সাংবাদিকতার ক্লাশে কী পড়ানো হয় আমি জানি না। আমার কখনো ক্লাশরুমে সাংবাদিকতা শেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু আমাদের মিডিয়ায় ক্লাশরুম সাংবাদিকতার ছাত্রের বাইরে আমার মত অনেক হাতুড়ে সাংবাদিক আছেন, যারা হাতুড়ে ডাক্তারদের মত না বুঝেই অপারেশন করে ফেলেন। যে কোনো বিষয়, যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতার সবার সাংবাদিকতা করার সুযোগ রয়েছে। আবার অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেই কোনো একটা মিডিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যান। তিনি যদি মিডিয়ায় ভালো করেন এবং পড়াশোনাটা আর না চালান, তাহলে যত বড় সাংবাদিকই হন, তিনি কিন্তু ইন্টারমিডিয়েট পাশই থেকে যান।
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পালনীয় কোনো নীতিমালা নেই। প্রেস ইনস্টিটিউট বা প্রেস কাউন্সিলকে ‘জাতিসংঘ মার্কা’ ঠুটো জগন্নাথ বললেও কম বলা হবে। আর সরকার গণমাধ্যমের ব্যাপারে ন্যায্য কথা বললেও আমাদের কাছে সেটা বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ মনে হয়। তাই সাংবাদিকরা কী করবেন, না করবেন তার নির্ধারক হতে পারে এই ফোরাম। এই বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আমি লেখালেখি করছি। কিন্তু যাদের জন্য লিখেছি, তাদের তেমন কারো চোখে পড়েনি সেই লেখা। কিছু পাঠক পড়ে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। কিন্তু আমি তো ধন্যবাদের জন্য লিখিনি, লিখেছিলাম যাতে সত্যি সত্যি দেশে সাংবাদিকদের পালনীয় একটি নীতিমালা হয়। গত বইমেলায় প্রকাশিত আমার প্রথম বই ‘স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না’তেও এই বিষয়ে বেশ কয়েকটি লেখা আছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে যে স্বেচ্ছাচারিতা দেখেছি এবং দেখছি তাতেই আমি লিখেছিলাম, ‘স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না’। কিন্তু ‘স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায়’। এ কারণেই সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়ার সম্ভাবনায় খুশীতে নাচতে চাইছে আমার মন। এই ফোরামটা যদি সত্যি দাঁড়িয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তা নেই। তারাই ঠিক করে দেবেন কোনটা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আর কোনটা স্বেচ্ছাচারিতা, কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক। এখন একই ইস্যুতে একেক পত্রিকা একেক রকম রিপোর্ট করে। কেউ লাশের ছবি ছাপে, কেউ ছাপে না। কেউ ধর্ষিতার নাম লেখে, কেউ লেখে না। এখন যারা লাশের ছবি ছাপে বা ধর্ষিতার নাম উল্লেখ করে তাদের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয়, কেন তারা ছেপেছে? তারা যদি উত্তর দেয়, লাশের ছবি ছাপা যাবে না বা ধর্ষিতার নাম উল্লেখ করা যাবে না, এমন কোনো কথা আছে নাকি। তাহলে? এখন গণমাধ্যমে বিশেষ করে টিভিতে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলে, কে কার আগে, কে কত বেশি নিখূঁত-তা নয়। এ কারণেই সম্পাদকদের একটি ফোরাম খুবই দরকার। এই ফোরাম বাংলাদেশের সকল গণমাধ্যমের জন্য একটি অবশ্য পালনীয় নীতিমালা ঠিক করে দিতে পারে। কারণ গণমাধ্যম কিভাবে চলবে সেটা যদি তথ্যমন্ত্রী ঠিক করে দেন, তাহলে সেটা যত ন্যায্যই হোক, আমরা সেটা মানবো না। সেটা হবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ। কিন্তু সেই একই কথা যদি মতি ভাই, মাহফুজ ভাই, সারওয়ার ভাই, রিয়াজ ভাই বলেন; আমরা সেটা মাথা পেতে নেবো। সম্পাদকদের এই ফোরাম সবার কাছে শ্রদ্ধেয়। কারণ এখানে সব মতের মানুষ আছেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নামে যখন ব্যক্তির চরিত্র হনন করা হয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট করে যখন প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করা হয়; সেই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা কোথায় যাবেন, কার কাছে প্রতিকার পাবেন? অনেকেই এ ধরনের সংক্ষুব্ধদের প্রেস কাউন্সিলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। আমি কখনো দিই না। আমি জানি সেখানে যাওয়ার চেয়ে সুন্দরবনে গিয়ে কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করে আসা অনেক কাজের। বিশৃঙ্খলা এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে, সাভারে উদ্ধারকর্মীদের সরিয়ে রেখে সাংবাদিকরা ঢুকে যান সুরঙ্গে, জুতা পায়ে কবরে নেমে পড়েন কেউ কেউ। আমি আসলে রিপোর্টারদের দোষ দিই না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ; কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত- কেউ তো জানি না। আমাদের কেউ বলে দেয়নি। যিনি যেটা ভালো মনে করেন, তিনি সেটাই করেন। অভিন্ন কোনো প্লাটফরম নেই বলেই সবাই আমাদের জ্ঞান দেন। তথ্যমন্ত্রীও জ্ঞান দেন, আদালতও সীমানা ঠিক করে দেন। কিন্তু আমরা তথ্যমন্ত্রী বা আদালতের নির্দেশনা মেনে সাংবাদিকতা করবো না। আমরা মানবো সম্পাদকদের কথা।
আসলে আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, এই ১৬ জনের যে কোনো একজন যদি আমাকে সারাদিন ফার্মগেটের ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেন, আমি প্রশ্ন ছাড়াই সেটা করবো। আর ১৬ জন একসঙ্গে বললে সেটা আমি কেন বাংলাদেশের সব সাংবাদিক মানবেন আশা করি। এই সুযোগ বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার।
ছোটবেলায় পড়েছি একটি কাঠি একজন ভাঙতে পারে, কিন্তু ১০টি কাঠি পারে না। এই গল্পের মোরাল ছিল- একতাই বল। এটা সব ক্ষেত্রেই সত্যি। জাতির বিবেক সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা আরো জরুরি। কিন্তু ৯০ দশক থেকেই সাংবাদিকরা দ্বিধাবিভক্ত। তাদের আলাদা অফিস। একদম আওয়ামী লীগ-বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের মত তাদের অফিসে বঙ্গবন্ধু আর জিয়ার ছবি। সম্প্রাতি সাগর-রুনী হত্যার বিচারের দাবিতে সাংবাদিকরা রাজপথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। আমরা আশাবাদী হয়েছিলাম। কিন্তু মাহমুদুর রহমান ইস্যুতে আবার আলাদা হয়ে গেছেন। আমরা আবার হতাশায় নিমজ্জিত। এই সময়ে আলোর দিশারী হয়ে এলেন সম্পাদকরা। তারা ঐক্যবদ্ধ। এই ঐক্যকে বৃহত্তর স্বার্থে কাজে লাগাতে হবে।
মাননীয় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু সম্পাদকদের যুক্ত বিবৃতির তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। তারা নাকি না বুঝে বিবৃতি দিয়েছেন। আমি তথ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ১৬ জন সম্পাদক না বুঝে বিবৃতি দিয়েছেন, আর মাননীয় তথ্যমন্ত্রী একাই সব বুঝে গেলেন! এই সরকারের আসলে ৩টি টিভি চ্যানেল আর একটি পত্রিকা বন্ধ হয়েছে। তারমধ্যে বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর আমলেই টপাটপ দৈনিক আমার দেশ আর এক রাতে দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এর আগে বন্ধ হয়েছে চ্যানেল ওয়ান। আওয়ামী লীগের আগের সরকারের আমলে বন্ধ হয়েছে দৈনিক বাংলা, বাংলাদেশ টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রা। আরেকটু পেছনে গেলে দেখবো ’৭৫ সালে বাকশাল কায়েমের সময় তখনকার আওয়ামী লীগ সরকার চারটি রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দিয়েছিল।
গণমাধ্যম বন্ধের ব্যাপারে কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা হলে তাতে আওয়ামী লীগ রেকর্ড গড়ে প্রথম হবে। বিএনপিও কম যায় না। বিএনপি ক্ষমতায় এসে বন্ধ করেছিল জনপ্রিয় ইটিভি। গণমাধ্যম বন্ধে বিশ্বরেকর্ডধারী আওয়ামী লীগ সরকারের তথ্যমন্ত্রী দাবি করেন, দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু ১৬ জন সম্মানিত সম্পাদকের একটি বিবৃতি তিনি সইতে পারলেন না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার এ কেমন নমুনা। ওদিকে আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক মাসের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়ে টুটি চেপে ধরেছেন বাক স্বাধীনতার। সমাবেশ করে কেউ সংষর্ষ বাধালে তা সামলানোর ক্ষমতা নেই, তাই নিষিদ্ধ করে দাও সমাবেশ। মাথা ব্যথা হয়েছে, কেটে ফেলো মাথাটাই। আমরা মনে হয় হীরক রাজার দেশে আছি। তথ্যমন্ত্রী নানা আইন-কানুনের কথা বলেন। আমাদের অত হাইকোর্ট দেখিয়ে লাভ নেই। এক মাসের মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের হাজারখানেক কর্মী বেকার হয়ে গেছেন। বেকারত্বের জ্বালা আমি বুঝি। ওয়ান-ইলাভেনের সরকার বন্ধ করে দিয়েছিল দেশের প্রথম নিউজ চ্যানেল সিএসবি নিউজ। সেই প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মী হিসেবে আমি বেকারত্বের দিনগুলির অনিশ্চয়তা দেখেছি। সম্প্রতি বন্ধ হয়ে যাওয়া তিন প্রতিষ্ঠানেই ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিচিত অনেকেই কাজ করেন। আমার মাসের বেতন একটু দেরি হলেই সব এলোমেলো হয়ে যায়। আর তাদের বেতন পাওয়ারই কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিভাবে চলবে তাদের সংসার। তথ্যমন্ত্রী বারবার বলছেন, আমার দেশ বন্ধ করা হয়নি। তারা চাইলে অনুমতি নিয়ে যে কোনো প্রেস থেকে ছাপতে পারে। মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর তালা লাগিয়ে দেয়া হয় আমার দেশ প্রেসে। পরে তারা সংগ্রাম প্রেসে ছাপতে গেলে মামলা দেয়া হয় সংগ্রাম সম্পাদকের বিরুদ্ধে। এরপর আর কোন্ প্রেস আমার দেশ ছাপতে রাজি হবে? আর নিজেদের প্রেস থাকতে তারা অন্যের প্রেসে ছাপতে যাবেন কেন। আমার দেশ প্রেসে তালা লাগিয়ে রাখা হয়েছে কেন? প্রেসে তো কোনো অপরাধী লুকিয়ে নেই।
তথ্যমন্ত্রী বলছেন, আমার দেশ প্রেসে হ্যাকিং-এর যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। আমি অত প্রযুক্তিবান্ধব নই। কিন্তু হ্যাকিং করতে এমন কী যন্ত্রপাতি লাগে, যা একটি প্রেসে লুকিয়ে রাখার মত? হা হা হা। তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, তল্লাশী শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার দেশ-এর প্রেস খুলে দেয়া হবে না। এখন এই তল্লাশী কতদিন চলবে? আমি যতদূর জানি, গত ১১ এপ্রিল রাতে পুলিশী অভিযানে তালা লাগানোর পর আর তা খোলাই হয়নি। যে দেশের পুলিশ ১০ মিনিটের অভিযানে মতিঝিল থেকে হেফাজতে ইসলামের হাজার হাজার কর্মীকে তাড়িয়ে দিতে পারে, তাদের একটি জনশূন্য প্রেসে তল্লাশী চালাতে প্রায় দেড় মাস লাগবে কেন? এই হলো আইনের নিজস্ব গতি! খলের কখনো ছলের অভাব হয় না। একে অজুহাত বললেও কম বলা হবে। দেশের মানুষ এত বোকা নয় যে মন্ত্রীরা যা বলবেন তাই তারা অন্ধের মত বিশ্বাস করবে। তথ্যমন্ত্রী মুখে বলবেন, আমার দেশ বন্ধ করা হয়নি, আবার প্রেসে তালা লাগিয়ে রাখবেন, অন্য কোথাও ছাপতে গেলে সেই প্রেসের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। হাত পা বেধে সাঁতারের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দেয়ার তো কোনো মানে হয় না। আমার দেশ বন্ধ করার কৌশল দেখে আমার একটি গল্প মনে পড়ে গেল- এক বাঘ ঝরনায় পানি খেতে গিয়ে দেখে নিচে একটি হরিণও পানি খাচ্ছে। বাঘ হরিণটিকে বললো, তুই আমার পানি ঘোলা করছিস, তোকে আমি খাবো। হরিণ বললো, মহারাজ আমি তো আপনার ভাটিতে, আমার পক্ষে তো পানি ঘোলা করা সম্ভব নয়। তখন বাঘ বললো, তুই ঘোলা না করলে তোর মা করেছে, তোকে আমি খাবোই।
আচ্ছা ক্ষমতায় গেলে মানুষের বুদ্ধিশুদ্ধি কমে যায় নাকি? ৫ মে মধ্যরাতে মতিঝিল অপারেশনের সময়ই বন্ধ করে দেয়া হলো দিগন্ত টিভি আর ইসলামিক টিভি। গুজব ছড়ালো মতিঝিলে রাতে ৩ হাজার মানুষ মারা হয়েছে। আর সেই ছবি দেখাচ্ছিল বলে দুটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেন গুজবের বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। বন্ধ করা যদি অপরিহার্য হতো, তবে অপারেশনের আগের দিন বা পরের দিন করতে পারতো। আমার দেশ-এর ক্ষেত্রে আগে তদন্ত, পরে প্রেস খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত। আর টিভি দুটির ব্যাপারে আগে বন্ধ, পরে তদন্ত। যেটা আমার সুবিধা, সেটাই কাজে লাগাবো। বাহ। কেন বন্ধ করা হলো টিভি দুটি? তথ্যমন্ত্রী বলছেন, লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করায় তাদের সম্প্রচার বন্ধ করা হয়েছে। কী ভয়ঙ্কর! এ ধরনের হাওয়াই অভিযোগ দিয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে যদি যখন তখন যে কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া যায়। এরপর আর অন্তত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা না বললেই ভালো। শুনলে হাসি পায়। টপাটপ তিনটি গণমাধ্যম বন্ধ করাতে যতটা না আতঙ্কিত, তারচেয়ে বেশি আতঙ্কিত সরকার বন্ধ করার কৌশল শিখে গেল বলে। প্রতিষ্ঠান তিনটি বন্ধের পর তেমন কোনো প্রতিবাদও হয়নি। গণমাধ্যমের এই দুঃসময়েও এক হতে পারেননি সাংবাদিকরা। আমার দেশ বন্ধের প্রতিবাদে একটি অভিন্ন বিবৃতি দিতেই ১৬ সম্পাদকের লেগেছে ৩৮ দিন। সবাই হিসাব করছেন রাজনৈতিক আনুগত্যের। ভাবছেন, আমারটা তো বন্ধ হয়নি। নগরে আগুন লাগলে দেবালয় রক্ষা পায়না, এটা মনে রাখা উচিত সবারই। আইন-কানুন বুঝি না, কিভাবে কি হবে জানি না, ১৬ সম্পাদকের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে অবিলম্বে আমার দেশ প্রকাশ এবং দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি। কারণ দর্শানো নোটিশ, তদন্ত- এই সব চলুক, তবে আগে চাই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এইসব অজুহাত দিয়ে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা যাবে না। গণতন্ত্র আর ন্যায়বিচারের স্বার্থেই মুক্ত ও দায়িত্বশীল গণমাধ্যম প্রয়োজন।
শ্রদ্ধেয় ১৬ সম্পাদকের বিবৃতির অন্য সব বিষয়ে একমত হলেও একটি বিষয়ের সঙ্গে বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি। বরং এমন একটি বিস্ময়কর দাবির অন্তর্ভূক্তি এই শুভ উদ্যোগকেও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একটি বাংলাদেশের মানে স্বাধীনতার পক্ষে, আরেকটি স্বাধীনতার বিপক্ষে মানে বাংলাদেশের বিপক্ষে। একটি শুভশক্তি, আরেকটি অশুভ-অন্ধকার। সর্বশেষ এই বিভক্তির জন্য অনেকাংশে দায়ী মাহমুদুর রহমান। বাংলাদেশকে ভালোবাসেন এমন কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ মাহমুদুর রহমানের মুক্তি চায় না। বরং বিচার চায়। বিবৃতিতে ১৬ সম্পাদক বলেছেন, সমাজের কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। তারা আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু পুরো বিষয়টি স্ববিরোধী হয়ে গেল না? কেউ যদি আইনের উর্ধ্বে না হয় আর আইন যদি নিজের গতিতে চলে তাহলে তো মাহমুদুর রহমানের কারাগারেই থাকার কথা, মুক্তি পাওয়ার কথা নয়।
প্রথম কথা হলো মাহমুদুর রহমান সাংবাদিক কিনা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সাংবাদিক মনে করি না। পেশায় প্রকৌশলী সারাজীবন কর্পোরেট চাকরি করেছেন, সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। আর শেষ জীবনে এসে পয়সার জোরে আমার দেশ কিনে বনে গেছেন সম্পাদক। যে ১৬ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি চেয়েছেন তারা প্রত্যেকেই তৃণমূল থেকে উঠে এসে ধাপে ধাপে নিজ নিজ যোগ্যতায় সম্পাদক হয়েছেন। আর মাহমুদুর রহমান হয়েছেন পয়সার জোরে, পত্রিকায় তার প্রথম পদের নাম- সম্পাদক! সম্পাদক হলেই তার মুক্তি দাবি করতে হবে? তাহলে কি বাংলাদেশের কোনো একজন সম্পাদক গ্রেপ্তারযোগ্য অপরাধ করলে বাকি সম্পাদকরা তার মুক্তি দাবি করবেন। এফবিসিসিআই কিন্তু হলমার্কের মালিকের মুক্তি দাবি করেনি, বিজিএমইএ কিন্তু রানা প্লাজার গার্মেন্টসের মালিকদের মুক্তি চায়নি। আমার দেশ বন্ধ হওয়াতে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কোনো সম্পর্ক নেই।
এই সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টিই আমাকে বারবার ধন্দে ফেলে দেয়। স্বাধীনতার সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতার যে বিরোধ, স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতার যে সম্পর্ক- তা নির্ধারণ করতে গিয়ে আমরা বিপাকে পড়ে যাই। তাই মাহমুদুর রহমানের মত একজন ভয়ঙ্কর লোকের গ্রেপ্তারকেও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি। আমার ধারণা ১৬ সম্পাদকের কোথাও ভুল হচ্ছে। বিবৃতিতে সই করার আগে হয় তারা সেটি ভালোভাবে পড়ে দেখেননি। অথবা মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তারের আগের দেড়মাসের বাংলাদেশকে ভুলে গেছেন। প্লিজ, একটু রিওয়াইন্ড করে দেখে আসুন সেই বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের সংবিধানেও সংবাদ ক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া আছে, তবে তা ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে।’ গ্রেপ্তার হওয়ার আগের দেড়মাসে মাহমুদুর রহমান জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা, মানহানি ও অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দিয়েছেন।
সাইবার অপরাধে গত ডিসেম্বরে দায়ের করা একটি মামলায় গত ১১ এপ্রিল মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের একটি ছবিকে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের ছবি হিসাবে চালিয়ে দেয়ার ঘটনায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে আরো একটি মামলা হয়। মাহমুদুর রহমান নিজেও জানতেন যে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। চোরের মন পুলিশ পুলিশ। তাই গ্রেপ্তার নিয়ে সরকারের সঙ্গে চোর পুলিশ খেলেছেন চার মাস। সরকার গ্রেপ্তার করতে দেরি করায় তিনি অপরাধের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেন। একরকম সরকারকে বাধ্য করেন তাকে গ্রেপ্তার করতে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এক বিচারপতির স্কাইপ কথোপকথন ছাপার অপরাধে গত ডিসেম্বরে মামলা হওয়ার পর থেকে তিনি অফিসেই থাকতেন। তার আকাঙ্খা ছিল অফিস থেকেই গ্রেপ্তার হবেন। ‘সংবাদপত্র অফিস থেকে সম্পাদক গ্রেপ্তার’ শিরোণাম হিসাবে দারুণ আকর্ষণীয়। টানা চার মাস অফিসে ব্যাগ গুছিয়ে থাকার পর তার অপেক্ষার অবসান ঘটে। আর এই চারমাসে কারওয়ান বাজারের অফিসে বসে মাহমুদুর রহমান যা করেছেন তাতে বাংলাদেশ অন্তত ৪০ বছর পিছিয়ে গেছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সুযোগে সাংবাদিকতার নামে মাহমুদুর রহমান যা করেছেন তাতে তার মুক্তি দাবি নয়, সম্পাদকদের লজ্জা পাওয়ার কথা। নিজেদের পেশা ও পদের সম্মান রক্ষার্থে সম্মাদকদের উচিত ছিল তখন মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের গণদাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে বিবৃতি দেয়া।
গ্রেপ্তারের কয়েকদিন আগে মাহমুদুর রহমান তার অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে গোলাম সারওয়ার, ইকবাল সোবহান চৌধুরী আর মনজুরুল আহসান বুলবুলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে কথা বলেছেন, তা দেখে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি, অপমানটা আমার গায়ে লেগেছে। এই এখন লিখতে বসেও সেই রাগটা যাচ্ছে না। ইকবাল সোবহান চৌধুরী কোথায় কাজ করেন; মনজুরুল আহসান বুলবুল কিসের সম্পাদক; গোলাম সারওয়ার সম্পদশালী সম্পাদক, বিশেষ ভবন থেকে সুবিধা নিয়েছেন- এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ করেছেন মাহমুদুর রহমান। আজ তার মুক্তির দাবির বিবৃতিতে সারওয়ার ভাইয়ের নাম দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি বুঝি সারওয়ার ভাই, ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন’ নীতিতে বিশ্বাসী। আমরা জানি সারওয়ার ভাই বড় সাংবাদিক, তার চেয়েও বড় মনের মানুষ। কিন্তু মাহমুদুর রহমানের মত খারাপ লোকের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যে কোনো মহত্ব নেই। আমার খুব আফসোস আমানউল্লাহ কবির, আতাউস সামাদের গড়া আমার দেশ মাহমুদুর রহমানের হাতে পড়ে কিভাবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রতীক হয়ে উঠলো। ‘পদ্ম বনে মত্ম হাতি’র এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হতে পারে না। যে সরকার রাত আড়াইটায় মতিঝিলে অভিযান শুরু করে সাড়ে ৪টায় দিগন্ত টিভি বন্ধ করে দিতে পারে। তারা মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতে কেন চারমাস সময় নিল আমার মাথায় ঢোকে না। যদি ডিসেম্বরেই সরকার মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করতো তাহলে বেঁচে যেতো কয়েকশ মানুষের জীবন। সাম্প্রদায়িক হামলা থেকে রক্ষা পেতো কয়েকশ মন্দির। ‘চাঁদে যাওয়া থেকে রক্ষা পেতেন কারাগারে আটক দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী’।
মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের কত বড় ক্ষতি করেছেন, তা টের পেতে আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে। তার বিরুদ্ধে মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধের বহর অনেক লম্বা।
৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে শুরু হলো বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মহৎ আন্দোলনের। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শুরু হওয়া সেই আন্দোলনের ঢেউ খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়লো সারাদেশে, সারাবিশ্বে। মূলত সরকারের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া সে আন্দোলনের ভয়ে ঘাঁপটি মেরে থাকলো জামায়াত, দিশেহারা বিএনপিও। শুরুর দিকে বিএনপি শাহবাগের ব্যাপারে অবস্থান পরিস্কার করতে পারছিল না। একেক জন একেক কথা বললেও শেষ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রথম প্রতিক্রিয়ায় অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাহবাগের আন্দোলনকে স্বাগতই জানিয়েছিল বিএনপি। এমনকি জামায়াতকে সঙ্গে নিতে হবে বলে বিএনপি তাদের একাধিক সমাবেশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিল। আন্দোলনের চাপে বিএনপি-জামায়াতের অশুভ আঁতাত যখন যায় যায় অবস্থা তখনই তাতে নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেন মাহমুদুর রহমান। তার দোসর বাংলাদেশকে বরবাদ করতে মাঠে নামা ফরহাদ মাজহার। একদা বাম, স্বঘোষিত নাস্তিক এবং বাংলাদেশে বিয়ে ছাড়াই এক সঙ্গে বসবাসের ধারণার অগ্রদূত এই ফরহাদ মাজহার আর মাহমুদুর রহমান এখন বাংলাদেশে ইসলামের রক্ষক। শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে দেশজুড়ে এমন অশান্তি ছড়িয়ে দিয়েছে যারা তাদের বিচার হওয়াই উচিত। না, সম্পাদকরা যতই বলুন, মাহমুদুর রহমানের মুক্তি আমরা চাই না। আমরা শান্তি চাই। মাহমুদুর রহমান মানেই অশান্তি। তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণে মাহমুদুর রহমান শুনতে পেলেন ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি। তারপর চতুর মাহমুদুর রহমান সেই আন্দোলনের সঙ্গে নাস্তিক্যবাদকে ট্যাগ করে দিলেন। যে শাহবাগে কোনোদিন ইসলামের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি, সে শাহবাগকে করে দিলেন ইসলামের প্রতিপক্ষ।
ব্লগার রাজিব মারা যাওয়ার দুদিন পর আমার দেশ তার নামে চরম ইসলাম বিদ্বেষী কিছু লেখা ছাপলো। মহানবী (সঃ)এর নামে আমার দেশ যা ছাপলো তাতে যে কোনো মুসলমান ক্রুদ্ধ ও ক্ষিপ্ত হবেন। সেই লেখা যে কোনো মুসলমানের রক্তে আগুন লাগিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রথমত আমি বিশ্বাস করি এটি রাজিবের লেখা নয়। কারণ এটি ছাপা হয়েছে রাজিব মারা যাওয়ার দুদিন পর। কারণ সত্যি সত্যি রাজিব এই লেখা লিখে থাকলে অনেক আগেই দেশজুড়ে হইচই শুরু হয়ে যেতো। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই রাজিব লিখেছিল তা, তাতেও আমার দেশ-এর অপরাধ কমে না। রাজিবের ব্লগ ছিল হাজার মানুষের গন্ডিতে। মাহমুদুর রহমান চরম ইসলাম বিদ্বেষী সেই অশ্লীলতা ছড়িয়ে দেন সারাদেশে, সারাবিশ্বে। রাজিব যদি ইসলাম বিদ্বেষী সেই ব্লগ লিখেও থাকে, মৃত রাজিবকে তো আর কোনো শাস্তি দেয়া সম্ভব ছিল না। সম্ভব ছিল রাজিবের লেখা যারা সারাদেশে ছড়িয়ে দিল, সেই আমার দেশ আর মাহমুদুর রহমানের মুখ বন্ধ করা। উল্টো আমার দেশ ব্লগার রাজিবের রেফারেন্সে সব ব্লগারকেই বানিয়ে দিল নাস্তিক আর শাহবাগকে বানিয়ে দিল নাস্তিকদের আন্দোলন। শাহবাগের লোকজন যতই বলেন, আই ডোন্ট নো অর্থ আমি জানি না। ততই মাহমুদুর রহমান সারাদেশের অল্পশিক্ষিত ধর্মভীরু মুসলমানদের বলতে লাগলেন, এই দেখেন, শাহবাগীরা ফ্যাসিবাদী, এরা কিছু জানে না। ব্যাপারটি ঠিক তাই হয়েছে। শাহবাগে ফুটলো সম্ভাবনার ফুল, আর মাহমুদুর রহমান বলতে লাগলেন, এদের দিয়ে সম্ভব না। ইসলামের অবমাননায় ক্ষিপ্ত মুসলমানরা লাখে লাখে ছুটে এলেন ঢাকায়। হেফাজতে ইসলাম গঠনের পর আমার ধারণা ছিল তাদের এক নাম্বার দাবি হবে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণার অভিযোগে আমার দেশ বন্ধ করা এবং মাহমুদুর রহমানকে গ্রেপ্তার। কিন্তু কী আশ্চর্য, আমার দেশ হয়ে গেল তাদের মুখপত্র, মাহমুদুর রহমান আর ফরহাদ মাজহার হলেন আদর্শিক গুরু।
সত্যি হেফাজতে ইসলামের কান নিয়েছে চিলে। চতুর মাহমুদুর রহমান ঐতিহ্যগতভাবে জামায়াতবিরোধী হেফাজতে ইসলামের কাঁধে বন্দুক রেখে বাস্তবায়ন করে নিলেন জামায়াতের এজেন্ডা। জুনায়েদ বাবুনগরী এখন রিমান্ডে কান্নাকাটি করে বলছেন, তারা জানতেন না কিভাবে কারা এই তাণ্ডব চালালো। তিনি জানবেন কিভাবে, এটা তো মাহমুদুর রহমানের প্লট। ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মাহমুদুর রহমানের অতীত অভিজ্ঞতা আছে। উত্তরা ষড়যন্ত্রের সময় তার হাতে কোনো পত্রিকা ছিল না। আর এবার তো ছিল আমার দেশ। মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মাত্র দুটি মামলা হয়েছে। কিন্তু তার অপরাধ বহুবিধ এবং বহুমাত্রিক। সবচেয়ে বড় অপরাধ ধর্মভীরু মুসলমানদের মনে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো। মাহমুদুর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের ভারসাম্যটাই নষ্ট করে দিয়েছেন। আইনে এর বিচার কতটা সম্ভব জানি না, কিন্তু তার এই অপরাধের প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এমন একজন ভয়ঙ্কর এবং ক্ষতিকর লোকের মুক্তির জন্য দেশের ১৬ জন সম্মানিত সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন, ভাবতেই অবাক লাগে। উপরন্তু উস্কানিদাতা ফরহাদ মজহারকেও কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না সেই বিষয়টা তারা বেমালুম এড়িয়ে গেলেন!
মাহমুদুর রহমান যখন সাংবাদিকতার নামে অবাধে দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছিলেন, তখন তো এই ১৬ জনের কেউ তাকে থামানোর চেষ্টা করেননি, বলেননি, আপনি সাংবাদিকতার নামে যা করেছেন তা আসলে সাংবাদিকতা নয়, অপরাধ। তাহলে এখন কেন তার মুক্তির দাবি করছেন। যে দৈত্যকে বোতলবন্দী করার ক্ষমতা আপনার নেই, তাকে মুক্ত করার ঝূঁকি আপনারা কেন নিচ্ছেন? ধরে নিচ্ছি সম্পাদকদের দাবি মেনে সরকার মাহমুদুর রহমানকে ছেড়ে দিল, খুলে দিল আমার দেশের প্রেস। তার মানে আবার ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা, আবার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, সারাদেশে মারামারি, মন্দিরে হামলা- হায় আল্লাহ। আমরা আর সেই সহিংস অন্ধকার সময়ে ফিরে যেতে চাই না। সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ আপনারা যা বলবেন তাই শুনবো, প্রয়োজনে আপনাদের সম্ভাব্য ফোরামের কেরানির কাজটি করে দিবো, কিন্তু মাহমুদুর রহমানের মুক্তির দাবির সঙ্গে একমত হতে পারছি না। বিনীত অনুরোধ, আপনারা এই দাবিটি প্রত্যাহার করে নিন।
প্রভাষ আমিন
probhash2000@gmail.com
২১ মে ২০১৩
[মতান্তরে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব]