Thursday, October 10, 2019

আবরারদের কেউ হনন করে কেউ হননকারী - জ শ তিমির


রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বলে যাওয়া কথাগুলি নিয়ে ভাবছিলাম   'দেশ মানুষের সৃষ্টি। দেশ মৃন্ময় নয়, দেশ চিন্ময়। মানুষ যদি প্রকাশমান হয়, তবেই দেশ প্রকাশিত। সুজলা, সুফলা মলয়শীতলা ভূমির কথা যতই উচ্চকণ্ঠে রটান ততই জবাবদিহির দায় বাড়বে, প্রশ্ন উঠবে প্রাকৃতিক দেশ তো উপাদানমাত্র, তা নিয়ে মানবিক সম্পদ কতটুকু গড়ে তোলা হল। মানুষের হাতে দেশের জল যদি শুকিয়ে যায়, ফল যদি যায় মরে, মলয়জ যদি বিষিয়ে ওঠে মরিবীজে, শস্যের জমি যদি হয় বন্ধ্যা, তবে কাব্য-কথায় দেশের লজ্জা চাপা পড়বে না। দেশ মাটিতে তৈরী নয়, দেশ মানুষে তৈরী’' ।

 বাংলাদেশ তথা রাজধানীর শ্রেষ্ঠ মানুষ গড়ার অন্যতম কেন্দ্র বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ বুয়েটে  একটি টর্চার সেল আছে, এই টর্চার সেলে কিভাবে আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল সেটির  বিবরণী পত্রিকাতে পড়তে পড়তে খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটির ফেসবুক আইডিতে গেলাম - আবরার সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ট্রো অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে ভূমিকাতে লিখেছিলো - 'অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা অসীম মহাকাশের অন্তে ''।

কয়েকটি সংবাদপত্রে এসেছে আবরারের পড়ার টেবিলে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পাওয়া গেছে, কয়েকটি স্ট্যাটাস নজরে পড়লো, একাত্তরে বিরূপ পরিবেশের মধ্যেও কিন্তু বিবিসি মুক্তিবাহিনীর খবর প্রচার করে গেছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর অপপ্রচার আর তাদের মিডিয়াতে শান্ত কাশ্মীরের যে খবর প্রচার করছে একাত্তরে পাকমিডিয়াও একই কাজ করেছিল'আর কয়েকটি পোস্টে দেখা গেলো ভারতকে পানি, গ্যাস ও সমুদ্রবন্দর দেয়ার চুক্তির বিরোধিতা করে  তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, নিজস্ব মতামত।

আমাদের সাথে তার সে মতামত বা দৃষ্টিভঙ্গি নাও মিলতে পারে, আবার মিলতেও পারে ।
কারো মতামত কারো সাথে না মিললে তাকে হত্যা বা নির্যাতন করার কোনো অধিকার বা ক্ষমতা ছাত্রলীগ বা কাউকেই কেউ দেয়নি। কথিত, যে, নিহত ফাহাদের ফেসবুক একাউন্ট ও ইনবক্স ঘেঁটে তার সঙ্গে ছাত্র শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া গেছে বলে মনে করেছিল ফাহাদ হত্যার সাথে জড়িত বলে সন্দেহভাজনরা ।
জামাত শিবির বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়নি, জামাত  শিবিরের অনেক নেতা কর্মী সদস্যরা  বর্তমান সরকারি দলটিতে যোগদান করেছে, এমন খবর পত্রিকাতে প্রচুর পাওয়া যাবে, কুখ্যাত  যুদ্ধাপরাধী মানবতাবিরোধী দণ্ডিত অপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ছেলে  নিবাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, এই বাস্তবের প্রেক্ষাপটে কোন স্পর্ধাতে ঘন্টার পর ঘন্টা অত্যাচার করে  একজন ছাত্রকে হত্যা করলো আরো কয়েকজন ছাত্র ?

এই ছাত্র রাজনীতি আমাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ৬৮ এর শিক্ষানীতি, ৬৯ এর গণ অভ্যুত্থান ও  মুক্তিযুদ্ধ, নব্বই এর স্বৈরাচার  বিরোধী গণ আন্দোলন - একের পর এক মাইল ফলক  দিয়েছে স্বর্ণালী ইতিহাসের নেতৃত্বদানকারী নেতা নেত্রী, উত্তরাধিকার নেয়ার সন্তান সন্ততি কেউ কি কোথাও নেই ?

পাকিস্তান আমলে ভারত  বিদ্বেষী রাজনীতির সমর্থনে ছিল এদেশের ২০ শতাংশ মানুষ, বর্তমান বাংলাদেশে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮০ শতাংশ, ভারত ছিল ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক আজ সেখানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী  তথা মুসলিমদের নানা ভাবে নিগৃহীত করা হচ্ছে, তবে ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এখনো পাল্লা ভারী। 

বাংলাদেশে এখন ভারতবিদ্বেষী রাজনীতির সমর্থকের পাল্লা ভারী, বিদ্বেষপ্রসূত হয়ে  মানুষ যদি হত্যা করতে হয় তাহলে তো বর্তমান বাংলাদেশের আশি ভাগ জনসংখ্যা হাপিশ করার মতো গণ হত্যা যজ্ঞে নামতে হবে, সেটা কি সভ্য বা সুস্থ কোনো চিন্তা চেতনা ? এই চিন্তা বা কর্ম একটি মারাত্মক অপরাধ !

তবে, বিচারহীনতা আমাদের সমাজকে বেপরোয়া করে দিয়েছে, আমরা মানুষের জীবন দিতে পারিনা, মানুষকে দুবেলা খেতে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা ভাবিনা, মানুষের দায়িত্ব নেয়ার কথা ভাবিনা, মানুষের উপকার করার কথা ভাবিনা, কিন্তু স্বার্থে লাগলে খুন করতে,  জীবন কেড়ে নিতে, পিছপা হয়না, প্রয়োজনে জোট বাঁধি ।

ভিন্ন মতের মানুষ হত্যা বাংলাদেশে খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে , দেশের মানুষ ভিন্ন মতের  মানুষ হত্যা কখন স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারে অথবা কখন যে পারেনা, সেটা কি বোঝা সহজ !একটু ফ্ল্যাশব্যাক -

১৯৭৭ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র শিবির নামে জামাত ই ইসলামীর ছাত্র সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। হাতুড়ি, রড, ইট, মুগুর দিয়ে হাড় গুঁড়ো করে দেয়া, রিকশার স্পোক কানের ভেতর ঢুকিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মগজ বের করে আনা, হাত ও পায়ের রগ কেটে দেয়া, চোখ উপড়ে ফেলা, মেরুদণ্ড ভেঙ্গে ফেলা, কব্জি কেটে নেয়া, কিরিচ, ছোরা, কুড়াল ব্যবহার করে হত্যা করার মতো নৃশংসতা এদেশের ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে কেবল শিবিরের নামের সাথেই যুক্ত ছিল । ৮০ র দশকে ভিন্ন মতের ছাত্র ও তরুণ প্রজন্ম হত্যার কাফেলা  শুরু করে শিবির, মাত্র কয়েকটি উদাহরণ -

১৯৮১: শিবির ক্যাডাররা চট্টগ্রাম সিটি কলেজের নির্বাচিত এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তবারক হোসেনকে কলেজ ক্যাম্পাসেই কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।   ১৯৮৪: চট্টগ্রাম কলেজের সোহরাওয়ার্দী হলের ১৫ নম্বর কক্ষে শিবিরেরকর্মী ছাত্র ইউনিয়ন নেতা  শাহাদাত হোসেনকে জবাই করে হত্যা করে।  ১৯৮৬ :শিবির ডান হাতের কবজি কেটে নেয় জাতীয় ছাত্রসমাজের নেতা আবদুল হামিদের। পরবর্তীতে ঐ কর্তিত হাত বর্ষার ফলায় গেঁথে তারা উল্লাস প্রকাশ করে।   ১৯৮৮: রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মেইন হোস্টেলের সামনে, কলেজের প্রিন্সিপাল ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্যবৃন্দ, ও শত শত শিক্ষাথীদের সামনে ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত পায়ের রগ কেটে হত্যা করে শিবিরের ক্যাডাররা। ১৯৮৮:  চাঁপাইনবাবগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ীর সামনে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। 

১৯৮৮:  সিলেটে শিবির ক্যাডাররা মুনীর, জুয়েল ও তপনকে বর্বরভাবে হত্যা করে। ২২ ডিসেম্বর, ১৯৯০: ছাত্রমৈত্রীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামান ফারম্নককে শিবিরের ক্যাডাররা জবাই করে।  ১৯৯২ : শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হরতাল কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে জাসদের মিছিল চলাকালে শিবিরের সশস্ত্র হামলায় সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে জাসদ নেতা মুকিম মারাত্মক আহত হন এবং ২৪ জুন তিনি মারা যান।  ১৯৯৩: বহিরাগত সশস্ত্র শিবির কমীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা বিশ্ববিদ্যালয় টিমের মেধাবী ক্রিকেটার জুবায়েদ চৌধুরী রিমুকে হাত-পায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে।  ১৯৯৩: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালালে ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, সাধারণ ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপন সহ ৫ জন ছাত্র নিহত হয়।

১৯৯৪: পরীক্ষা দিতে আসার পথে তৃতীয় বিজ্ঞান ভবনের সামনের রাস্তায় ছাত্রমৈত্রী নেতা প্রদুৎ রুদ্র চৈতীর হাতের কব্জি কেটে নেয় শিবির কমীরা।১৯৯৫ : শিবির কমীরা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ্ববতী চৌদ্দপাই নামক স্থানে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী সকাল-সন্ধ্যা বাসে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে বাসের মধ্যে যাত্রীদের সামনে কুপিয়ে হত্যা করে। হত্যার আগে বর্বর শিবির ক্যাডাররা তার হাত ও পায়ের রগ কেটে নেয়।১৯৯৬ : জাসাস রাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমানকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে এবং

১৯৯৭: চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য শিবির ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মোহাম্মদ জমির ও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদউদ্দিন আহমদকে গুলি করার পর পায়ের রগ কেটে হত্যা করে।
১৯৯৮:  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী সঞ্জয় তলাপত্রকে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ২০০০: চট্টগ্রামের বদ্দরহাটে শিবির ক্যাডাররা মাইক্রোবাসের মধ্যে থাকা ৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে প্রকাশ্য দিবালোকে ব্রাশফায়ার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৯৯৯: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. এনামুল হকের ছেলে ও ছাত্রদল নেতা মোহাম্মদ মুছাকে শিবিরকমীরা নৃশংসভাবে হত্যা করে।২০০৪: অধ্যাপক মোঃ ইউনুসকে ফজরের নামাজ পড়তে যাবার সময় কুপিয়ে হত্যা করা হয়।এলাকাবাসী অনেকেরই মতামত হচ্ছে ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররাই তাকে হত্যা করেছে।

উল্লেখ্য, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে দুই দফায় ছাত্র শিবির তাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল।২০০৪: বরিশালের বাবুগঞ্জের আগরপুর ইউনিয়নের ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি শামীম আহমেদকে শিবির ক্যাডাররা হত্যা করে।২০০৬ : বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাতপন্থী শিক্ষক মহিউদ্দিন এবং রাবি ছাত্র শিবির সভাপতি মাহবুব আলম সালেহীন সহ আরো দুইজন শিবির ক্যাডার মিলে একযোগে অতকিতে হামলা চালিয়ে রাবি’র ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু তাহেরকে হত্যা করে।   ২০১০: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হোসেনকে হত্যা করে ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে রাখে শিবিরের ক্যাডাররা।

বাংলাদেশে প্রথম বড় রকমের বোমা হামলা হয়েছিল বিএনপি আমলে ১৯৯৯ সালের ৭ই মার্চ৷ যশোরে উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে চালানো বোমা হামলায় সেদিন ১০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছিলেন ৷ সে বছরেরই ৮ই অক্টোবরে খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে বোমা হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় সাত জনকে, আহত হয়েছিলেন কমপক্ষে ৩০ জন৷ তারপর ২০০১ সালে রমনা বটমূলে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন, এখনো শরীরে হামলার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন শতাধিক মানুষ ৷ ২০০৫ সালে  দেশের ৬৩টি জেলার পাঁচশ'রও বেশি স্থানে সিরিজ বোমা হামলা চালায় নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ৷

৮০ র দশকে ভিন্ন মতের ছাত্র ও তরুণ প্রজন্ম হত্যার কাফেলা  শুরু করে ইসলামী ছাত্র শিবির, পরবর্তীতে শুধু কওমি মাদ্রাসাগুলোই  নয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোও জঙ্গিবাদের কারখানা হিসাবে চিহ্নত হতে থাকে, আনসারুল্লাহ, হিজবুত তাহেরি ও হেফাজতি ইসলামী সহ নানা নামে নানা তরিকতে  ইসলামী উগ্রপন্থী ও জঙ্গিরা ভিন্ন মতের ভিন্ন ধর্মের  মানুষ কোপানো ও হত্যালীলা শুরু করে ফতোয়া দিয়ে তালিকা পাঠিয়ে ৷

২০১৩ সালে  রাজীব হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।অভিজিৎ রায়কে হত্যার এক মাসেরও কম সময়ের মাথায় ২০১৫ সালের ৩০শে মার্চ ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে ঢাকার তেজগাঁও এলাকার একটি সড়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।২০১৫ সালের ১২ মে ঢাকার বাইরে সিলেটে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দুর্বৃত্তদের হামলায় খুন হন ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী অনন্ত বিজয় দাশ, সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ প্রকাশ্যে রাস্তায় খুন হওয়ার পর তিন মাস না পেরোতেই ঢাকায় আরেক ব্লগার নিলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নিলয়কে বাসায় ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ।

২০১৫ সালের ৩১ অক্টেবর রাজধানীর লালমাটিয়ায় ব্লগার অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুলসহ দুই জনকে কুপিয়ে আহত করা হয় । এর চার ঘণ্টার মাথায় শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট সাভারে ব্লগার আশরাফুল আলমকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।  একই কায়দায় ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শফিউল ইসলামকে হত্যা করা হয়। ২০১৬ ২৬ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করে স্লোগান দিতে দিতে দিনের আলোয় পৰ ছেড়ে বেরিয়ে যায় হত্যাকারীর দল ।

এর দুই দিন আগে ২৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে একইভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১ ৬ তে, এই ফেসবুকে লেখার জন্যেই, রাজধানীতে খুন হয়েছিলেন  অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিমউদ্দিন সামাদ, হত্যা করা হয়েছে শাহজাহান  বাচ্চুকে  ।  প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডেই নিহতদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, অথবা মোটর সাইকেল যোগে দিনের আলোয় এসে  হত্যা করা হয় এবং এখনো কোনোটার বিচার শুরু অথবা শেষ হয়নি ।

বেশ ক বছর হলো আওয়ামী লীগ পুশব্যাক দেখছি বুক ফুলিয়ে  মুসলিম আওয়ামী লীগের দিকে ৷ কারণ তারা দেখেছে,  ধর্ম দিয়ে রাজনীতি খেতো ব্রিটিশ আমলের ভারতীয় উপমহাদেশ, খেয়েছে পাকিস্তান, স্বাধীন বাংলাদেশের পঁচাত্তর পরবর্তী ফর্মুলা গেছে জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার হাত ধরে ৷

আর তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাহাত্তরের সংবিধান এবং কওমি দোয়া নিয়ে ইসলামিক বাংলাদেশের সোজা পথে আগে বেড়েছে বর্তমান ক্ষমতাশীল রাজনৈতিক দল  ৷

অথচ, দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা ছিল সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা  মৌলবাদ-কূপমণ্ডুকতা থেকে উত্তরণের উৎকৃষ্ট উপায়, আর প্রগতিশীল এবং বামপন্থি নামধারী গোষ্ঠী শুয়োরের  মতো ঘোৎ ঘোৎ আওয়াজ তোলার শক্তি নিঃশেষ করে ফেলেছে বিধায় শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সমাজের সর্বস্তরে ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় উগ্রতা প্রতিষ্ঠিত করতে কারো কোনো বেগ পেতে হয়নি  ৷ ক্ষমতাসীন দলে জায়গা হয়েছে জামাত শিবির বিএনপি মাহে কলেমা দিব্যি করে  পেশা ছেড়ে দেয়া জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্যদের ৷

একাত্তর ও পঁচাত্তরের খুনি ও পরিকল্পনাদাতা নেতৃবৃন্দ পার পাননি, ২১ শে আগস্টের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য  ৷  আবার হাজারো  রাজনৈতিক গুম খুন জোড়া খুন, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার এখনো হয়নি ৷  দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী তারেক রহমানের হাওয়া ভবনও টেঁসে গেছে, তার স্থলাভিষিক্ত  হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের বহু কোটিপতি নেতা পাতি নেতাদের ভবন ৷  রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে অবৈধ ব্যবসা, দুর্নীতি, হত্যা, জুলুম  আর জবরদখলে বঙ্গবন্ধুর সেই চাটার দল এখন কোটি গুনে স্ফীত আর শক্তিশালী ৷

জনগণ ই সকল ক্ষমতার উৎস, যে ভুলেছে সে ডুবেছে,  আর জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠী হলো তরুণ প্রজন্ম যাদেরকে হত্যার লক্ষ্য ও হত্যাকারী হিসাবে নয়, আমাদের জীয়ন কাঠি হিসাবে আগলে রাখতে হবে আমাদের সামনের দিনের জন্যে নাহলে আলো জ্বালাবার কেউ থাকবে না !
১০ অক্টো, ২০১৯ 

Wednesday, October 2, 2019

মা দিবসে অামার মা

মা অামার  অকপট, অকৃত্রিম অশেষ ভালোবাসা, মানবতার সেবা আর প্রাণ খোলা হাসির প্রাণপ্রাচুর্যে ভরিয়ে রাখেন চারপাশের জগৎ সংসার! অথচ নিজে কখনো জানতেই পারলেন না ‘মায়ের কোল’ কাকে বলে-;মায়ের অাদর ‘ কাকে বলে, জানলেন না। মায়ের ছোঁয়া ই পেলেন না কখনো আমার মা !  অাম্মুর জন্মের তিন দিনের দিনই  অাম্মুর জন্মদাত্রী মা জাহান অারা বেগম টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রয়াত হন।জন্মানোর পর পর ই আমার মা  নূরজাহান খান মা হারানোর গভীরতম শূন্যতায় ডুবে গেলেও যেন অন্য কাউকে  সেই বেদনা পেতে না হয়, সেই প্রচেষ্টা করে যান চিরকাল। যে কারণে আম্মুর অাশে পাশে  নানান জাতি, বর্ণ গোত্রের অনেক মানুষ তাঁর অাদরে স্নেহে ধন্য শত শত সন্তান -আকুল  হয়ে তাঁকে ‘মা’ বলেই ডাকেন ! অামি অাম্মুর অযোগ্য কন্যা! অাজ মা দিবসে অাম্মু অামাকে  প্রাণ ভরে অাশীর্বাদ করে  বললেন, "তুমি অামার মা, অামি যেমন তোমার মা...অনেক ভালো থেকো.."!  অাম্মু, এতো ভালো কেন, তৃমি? অামি যেন তোমার সত্যিকার মায়ের দায়িত্ব পালন করতে পারি।তুমি শতায়ু হয়ে এমন করেই পূর্ণতায় ভরিয়ে রাখো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে!

আমার গহনের মাতৃত্বের পূর্ণতার ২০ বছর

মাতৃত্বের পূর্ণতা হয়তো একেই বলে। মায়েদের খুব বেশি কিছু অথবা কিছুই চাওয়ার থাকে না।  অনেক কষ্টের অশ্রুধারায় অনেক দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আমার গহন আজ ২০ বছর পূর্ণ করলো। Full Scholarship নিয়ে IUB তে ভর্তি হবে।  ১৯৮৭ সাল থেকে লেখালিখি করি। 'নারী' হবার দোষে সংবাদপত্রে চাকরি হলোনা। ফ্রিল্যান্স কাজ করে অনেক কাভার স্টোরি করলাম।  অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করলাম। ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রামের সাড়া জাগানো ইংরেজী মাধ্যম স্কুল CGS য়ে যখন চাকরি শুরু  করি purely breastfeeder baby গহন তখন ৭ মাস বয়স।  সেই সাতসকাল থেকে দুপুর,  মা ছেলে দু'জনেরই অনেক কষ্ট হতো। ওর জন্য ছুটে অাসতে হতো। চাকরি ছেড়েই দিলাম একদিন। বাচ্চাকে সুস্থ রাখতে ভালো রাখতে সর্বোচ্চ ত্যাগে এতোটুকু দ্বিধা করিনি কখনো। ১৯৯৭ য়ের ৩০ নভেম্বর থেকে ১৯৯৯ য়ের ডিসেম্বর এক রাত ও ঘুমাইনি।  ২ বছর যতো কষ্টই হোক, অামার সন্তানদের কখনো ফ্যাশান বা বিলাসিতা দেখাতে  বা নিজের ঘুম নিশ্চিন্ত করার জন্যে বেবিকট য়ে রাখিনি, ফিডার ( Feeder)  দেইনি। অামাদের অভিভাবক অামাদের বাপ্পু ডাক্তার কামাল এ খান অামাদের শৈশব থেকেই বাচ্চাদের ওয়াকারে হাঁটানো শিখানো বিপদ্জজনক বলে মানা করেছিলেন অামার মা'কে। মা তাই অামাদের ওয়াকারে হাঁটানো শেখান নি। শিশুর কোমরের হাড়ে চাপ পড়ে বলে অামিও চারপাশের মানুষের মতো 'দেখানোপনা' র স্রোতে ভেসে ওয়াকার (Walker)  দিয়ে বাচ্চাদের হাঁটা শিখাইনি।বিছানার পাশ ধরে দাঁড় করাতাম, খেলনা দিচ্ছি দেখিয়ে বিছানার দুইপাশে হাঁটাতাম। বাড়ির বড়োদের হাত ধরে একটু একটু হাঁটতো। রাতে বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি। কখনো কোন কৃত্রিমতায় অামার বাচ্চাদের বড়ো করিনি। গহনকে নিয়ে একবার চট্টগ্রাম মেডিকেলে গেছি একলাই। অামার কোলে গহনকে দেখে কার্ডিওলজিস্ট এসসি ধর বললেন, " নিশ্চয়ই ব্রেস্টফিডার বাচ্চা? বাচ্চার মুখ দেখলেই বোঝা যায়।  তুমি  ওর শারীরিক অার মানসিক  ভিত গড়ে দিলে। খুব মেধাবী হবে এই বাচ্চা। অারে, গরুর দুধ তো গরুর বাচ্চার জন্যে, মানুষের বাচ্চা তো মায়ের দুধ খাবে।" ধীমান 'দা (ডা. ধীমান চৌধুরী)  সতর্ক করেছিলেন ৫বছর বয়সের নীচে চিপস, কোক ফান্টা দিলে ব্রেনে এফেক্ট হতে পারে, যা পরে প্রভাব পড়বে। তাই বাচ্চাদের ৮/৯ বছর বয়স পর্যন্ত কোক ফান্টা বা চিপস খেতে দেইনি।  এর পর মেহমান দের দেখে কোক ফান্টা খেতে চাইতো গহন, তাই  একটু পানি মিশিয়ে দিতাম। কয়দিন অাগে পর্যন্তও গহন পানি মিশিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেতো। কতো স্মৃতি মনে পড়ছে অাজ! অনেক না বলা রইলো, কিছু বলি অাজ।
জ্যেষ্ঠ সন্তান অতুলনকে  কাজীর দেউড়ি বাসা থেকে রিক্সায় করে ফুলকিতে অানা নেয়ার সময়ে ছোট্ট গহন অামার বুকে ঘুমাতো।  ফুলকির দরজায় দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের ভেতরে ঢুকাতেন বীরেন'দা। কয়েক বছর পর গহন হাঁটছে, বড়ো হচ্ছে দেখলেন। একদিন বললেন, "এই বাচ্চাটা একদম অাপনার বুকের মাঝেই বড়ো হয়েছে। দেখবেন দিদি, ও কখনো অাপনাকে ছেড়ে যাবেনা। "  অতুলনকে ৪ বছর বয়সে বৃটিশ কাউন্সিলে ভর্তি করলাম YLC course য়ে। ১৯৯৮ সালে ২/ ৩/৪ মাসের গহন কে বৃটিশ কাউন্সিলের তক্তপোষে  শুইয়ে রাখতাম। অতুলনকে শেলফ থেকে বই নামিয়ে চেয়ারে বসে পড়াতাম।  তখন ইঞ্জিনীয়ার্স ইইন্সটিটিউট ভবনে  বৃটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরী।  মাতৃভূমি,  মানবতা,  পেশাদারীত্ব অার সন্তান সমান্তরাল রেখে এই সংসার সমরাঙ্গনে  ঠকেছি অার ঠেকেছি বারবার। তবু তো মাতৃত্ব সবার উপরে। সন্তান প্রতিপালনে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিতে চায় একজন মা। ২০০৪ সালে জামাত বিএনপি'র সন্ত্রাসীরা হামলা করলো, ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে বাচ্চারা খুব কষ্ট পেলো। অতুলন খুব কাঁদতো,  মুখের সামনে অাসতে পারতো না। গহন ওর মাটির টেরাকোটার ছোট্ট পুতুল গুলো এনে দিতো অামি যেন বিছানায় শুয়ে খেলতে পারি, অামার মমন যেন  ভালো থাকে।  জামাত বিএনপি  সসরকারের পুলিশ গ্রেফতার করলো যেদিন,  গহনের প্রচন্ড জ্বর সেদিন।  ছোট্ট গহন তার মায়ের জন্যে কাঁদতে কাঁদতে পুলিশের জীপের পেছন পেছন ছোট্ট ছোট্ট পায়ে অাস্তে অাস্তে হেঁটে চলে গিয়েছিলো অনেক দূর। প্রতিবেশী  হরিজন পললীর লোকেরা গহনকে নিয়ে পৌছে দিয়েছিলো বাসায়। প্রতিটি সংকটে  অামার সন্তানেরা অামার বুকের মাঝে, অামার পাশে থেকেছে। অামি ইটিভিতে যোগ দেবার পর ২০০৭ সালের শুরু থেকে সেই ৯  বছর বয়স থেকে মায়ের সান্নিধ্য থেকে দিনের পর দিন বঞ্চিত থেকে সপ্তাহশেষে শুক্রবার অামি চট্টগ্রামে এলে মায়ের উমে নাক ডুবিয়েছে।  ইটিভি তে যোগ দেবার সময়ে অামার চট্টগ্রামে  কাজ করবার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ সেই কথা অার রাখেন নি। দুস্তর বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে যেন চোখ মেলে দেখছি অামার সকল সুখদুঃখে র সাথী অামার নাড়িছেঁড়া ধন অামার গহন।  যখন অামার বুকে মাথা রাখে অামার কনিষ্ঠ সন্তান গহন,  জগতের সকল সুখ যেন অামায় ঘিরে রাখে।  মানবতায় উৎসর্গিত হোক তোমার জীবন,  বাবাধন!  এদেশের মাটি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে লক্ষ কোটি মানুষের পবিত্র রক্তে স্নাত মনে রেখেই নিজেকে সুকঠিন দায়িত্ব পালনে  নিবেদিত রেখো সেই প্রতিদান পরবর্তী প্রজন্মে ফিরিয়ে দিতে।  ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ নির্যাতন, পাকিস্তানী শাসক শোষকদের নিপীড়ন নির্যাতন সয়ে মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে  অকাতরে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন যাঁরা, তাঁদের মহান অাত্মদানের ইতিহাস পৌঁছে দিও প্রজন্মান্তরে তৃণমূ্ল থেকে বিশ্বসভায়। জ্ঞানে, মেধায় অনেক বড়ো হবে,কঠোর পরিশ্রম অার সততায়  জিনে নিও বিশ্ব। Celebrating 20th Birthday of My lovely  younger Son Writban. 

Sunday, September 1, 2019

রূপবতী- সুমি খান

যুগ থেকে যুগান্তরে অামার চাক্ষুষ করা ব্যস্ত নগর এবং অজ পাড়া গাঁয়ের কয়েকটি ঘটনা, যার সঙ্গে বর্তমানের খুব বদল নেই।  তার ভিত্তিতে রচিত অামার লেখা প্রথম ঝুরোগল্প! অাধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচায় যদি এ গল্প!
ছবি- অালমগীর হক স্বপন 


  রূপবতী। অাজন্ম 'পাগল' ডেকে যাকে সমাজ বঞ্চিত করলো তার ন্যূনতম মানবিক অধিকার থেকেও। জন্মদাতা পিতা সমাজের প্রথম সারির ব্যক্তি হলেও কন্যা যে অাজন্ম সমাজে অবাঞ্ছিত! কৈশোরেই পিতৃহীন রূপবতী তার পরিবারে,সমাজে অবাঞ্ছিত। অার সমাজ ' রক্ষা' র নামে  তাকে 'পাত্রস্থ' করতে মরিয়া সমাজপতিরা। একদিন বিয়ের ঢাক বেজে উঠলো।স্বজন মহলে সাজ সাজ রব! ভুড়িভোজ অার পানাহারে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুললো সকলে। বিশাল রাজত্ব অার রাজকন্যা পেলো বর।......তার পর??
 হঠাৎ এক সূর্যোদয়েের ভোরে নিরাভরণ হলো রূপবতী! ধীরে ধীরে নিরাবরণ করে ফেললো নিজেকে রূপবতী। নিমেষে ছুঁড়ে ফেলে দিলো গায়ের কাপড়ের ক্ষুদ্র চিহ্ণটুকুও। চেয়ে দেখলো না কোনদিকে; এমনকি নিজের দিকে ও না!ভোরের অালোয় ঝিকমিকিয়ে উঠছে রূপবতীর বাহুতে পরা রূপোয় গড়া হীরের বাজুবন্ধ!ঝলসে উঠলো রূপবতীর  ডান হাতের ধারালো চাকুর ফলা!!
 ব্যস্ত রাজপথ!
কুঁচবরণ কন্যার মেঘছায়া এলো চুল ঢেকে দিলো তার দীর্ঘ কপাল।তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থির সম্মুখে!
সটান  নিটোল বক্ষ, নিদাগ, অপরূপ দেহ ছুটছে দিগ্বিদিক.....তবে জ্ঞানশূন্য নয়!   পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে ছুটছে রূপবতী। ব্যস্ত রাজপথে কর্মব্যস্ত পথচারীরা হঠাৎ স্তব্ধ!
দৃষ্টিহারার চোখে হঠাৎ অালোর ঝলকানি....... নিষ্প্রাণ ফিরে  পেতে চায় প্রাণ..পাগলপ্রায় উন্মত্ত দেহজীবির দল..... হৃত যৌবন নবতিপর, নবযৌবন ধর্মজীবী, হর্ম্যজীবি,ঘর্মজীবি,ছুটছে রাজপথের মোহনার দিকে  ..... নগ্ননারীর নিরাবরণ রূপ দেখবার লোভে.... নগরজুড়ে সাইরেন.... মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে ওয়্যারলেসে বার্তা যায়- "পাকড়াও করো  উন্মাদিনীকে...."
হঠাৎ একটা নীল চাদরে ঢেকে গেলো রূপবতীর নগ্ন দেহ! পিছন থেকে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো তাকে জন্মদাত্রী মা!  চাদরের ভেতর থেকে রক্তে ভেজা  ডান হাত শূণ্যে উঁচিয়ে ধরে চারপাশের লালায়িত চোখগুলোতে একে একে  চোখ রাখে রূপবতী.... এতোক্ষণ যে চোখগুলোতে ধর্ষণের লোভে লালায়িত ছিল,  অাকস্মিক নীল চাদরের পর্দায় ঢাকা রূপবতীর শরীরের একমাত্র  নগ্ন  অংশ দক্ষিণ হস্তের পানে তাদের চকিত নজর।
বিষ্ফারিত নেত্রে সবাই চেয়ে দেখে রূপবতীর হাতে পূর্ব পশ্চিমে  পেন্ডুলামের মতো ঝুলছে  রক্তাক্ত একটি  লম্বাটে মাংসপিন্ড! টপ্....টপ্....টপ......রক্ত ঝরছে.....!!

এতোক্ষণ নিষ্পলক পুঙ্গবের দল সঙ্গে সঙ্গে বুঁজে ফেললো তাদের চোখ! সাথে সাথে তাদের নগ্ন লালায়িত হাত চলে যায় নিজেদেরই দু' পায়ের মাঝখানে!!
চারিদিক থেকে রায়ট ভ্যান অার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দাঙ্গা পুলিশের বীর সন্তানেরা ভীড় সরাতে ব্যস্ত হয়ে যায়!
সুমি খান। বেলা ১২টা পয়লা সেপ্টেম্বর, ২০১৭, চট্টগ্রাম

Sunday, August 18, 2019

মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন সাবিত্রী রায়- জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও আজ বিস্মৃত তিনি-বিপ্লব আর দেশভাগ জীবন্ত তাঁর কলমে

তাঁর উপন্যাস নিষিদ্ধ করেছিল কমিউনিস্ট পার্টি। কিন্তু কলমকে থামাতে পারেনি। সাম্যবাদী রাজনীতির প্রতি আজীবন শ্রদ্ধা রেখেই একের পর এক উপন্যাসে মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন সাবিত্রী রায়। জন্মশতবর্ষ পেরিয়েও আজ বিস্মৃত তিনি।

শিশির রায়  
কলকাতা| ,১৮ অগস্ট, ২০১৯, ০০:০২:০০
শতবর্ষে বিস্মৃত  লেখিবা বিপ্লবী সাবিত্রী রায়
মিঠিসোনা, তুমি যখন বড় হ’য়ে স্কুলে পড়বে, ঐ ভিখিরী শিশুদের চাইতে নিজেকে বড় মনে করো না। যারা বাড়ীর আবর্জনা থেকে ছেঁড়া পুরানো কাগজ কুড়িয়ে নিচ্ছে একাগ্রমনে, কেউবা বনে বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে শুকনো ডালপালা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, শীতের রাতে ওদের শীর্ণ কঙ্কাল হাতগুলি গরম করবে বলে, আর ওদের মায়েরা রুটি সেঁকবে সে ধোঁয়াটে আগুনে তিন ইটের উনুনে খোলা প্ল্যাটফর্মের এক কোণে।...এমন দিন যদি কখনও আসে, ওদের সঙ্গে মানবতার প্রতিযোগিতায় (যার নাম প্রগতি) নামতে হয়েছে তোমাকে পৃথিবীর ময়দানে, হয়তো দেখবে, তুমি পিছিয়ে আছ অনেক পিছনে। ওদের চোখে জয়ের স্নিগ্ধ হাসি।’

আদরের নাতিকে চিঠি লিখেছিলেন সাবিত্রী রায়। ‘নীল চিঠির ঝাঁপি’ নামের সেই চিঠির বইয়ের পাতায় পাতায় স্নেহময়ী দিদিমার মনের কথা, কবিতার টুকরো, রোজনামচা। আছে ভবিষ্যতের প্রতি দিক্‌নির্দেশ, নিজে যে বিক্ষুব্ধ রক্তাক্ত অতীত পেরিয়ে এসেছেন তার ইঙ্গিতও— শিশুমনের যতটুকু প্রয়োজন। ইতিহাসে কিছু মানুষ শুধু জমি তৈরি করে আর তার ফসল তোলে আর একটি প্রজন্ম, এই সারসত্য মনে রাখার আর মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটুকু জীবনসায়াহ্নেও ভোলেননি ‘স্বরলিপি’, ‘পাকা ধানের গান’, ‘মেঘনা পদ্মা’ উপন্যাসের লেখিকা।

কিন্তু কে চেনে আজ তাঁকে? যে দলের মতাদর্শের প্রতি তাঁর আজীবন প্রতীতি, সেই কমিউনিস্ট পার্টিই তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তাঁর লেখা থেকে! ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরকার দ্বন্দ্ব থেকে একটু উপরের তলার নেতাদের দ্বিচারিতা— সোজাসাপটা লিখেছিলেন তিনি। সেই বই নিয়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল, নিষিদ্ধ করা হয়েছিল তার পাঠ। নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনার ‘আদেশ’, স্বামী শান্তিময় রায়কে পার্টি থেকে বহিষ্কার, কোনও কিছুই সাবিত্রীকে দমাতে পারেনি। থামাতে পারেনি তাঁর কলমও।

‘স্বরলিপি’ প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। সেটা তাঁর তৃতীয় উপন্যাস। তার পরেই তিনি লিখেছেন তাঁর দুই ম্যাগনাম ওপাস— তিন খণ্ডে ‘পাকা ধানের গান’, দু’খণ্ডে ‘মেঘনা পদ্মা’ (তার তৃতীয় খণ্ড আবার ‘সমুদ্রের ঢেউ’ নামে আলাদা উপন্যাস হিসেবে)। চল্লিশের দশকের জটিল ও রক্তাক্ত রাজনীতি— বিয়াল্লিশের অগস্ট আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, হাজং বিদ্রোহ, দেশভাগ, দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা— তাঁর উপন্যাসে শুধু উঠে এসেছে বলাটা ভুল, সমসময় ও সাহিত্য সেখানে একে অন্যের আয়না। এই সমস্তই তিনি দেখছেন, লিখছেন— কমিউনিস্ট মতাদর্শের প্রতি অটল কিন্তু নির্মোহ থেকে। লেখক তো দ্রষ্টা, ব্যক্তিগত দেখাটাও তাঁকে করে তুলতে হয় নৈর্ব্যক্তিক। কিন্তু দল তা মানবে কেন? সে তো বোঝে কেবল ‘পার্টি লাইন’, দাবি করে মনোযোগ আর আনুগত্যের সবটুকু। সমালোচনা দূরস্থান, মতামতে যে মতের পাশাপাশি অমতও থাকতে পারে, ‘পার্টি’ তা বুঝেও বোঝে না। এই সিদ্ধান্তটা ভুল হচ্ছে, ওই কাজটা করা উচিত নয়— বললে নেমে আসে ‘সংস্কারবাদী’ তকমা, বহিষ্কারের ফতোয়া, একঘরে করার হুমকি। সাবিত্রীর নিজের জীবন আর তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের জীবন তাই দিনশেষে এক ও অকৃত্রিম হয়ে ধরা দেয়।

১৯১৮-র ২৮ এপ্রিল ঢাকায় জন্ম সাবিত্রীর। শৈশব কেটেছে ফরিদপুরের গ্রামে। পিতার পদবি সেন। বাবা-মা ছাড়াও দশের কাজে এগিয়ে-আসা পিসির প্রভাব পড়েছিল তাঁর জীবনে। বেথুন কলেজ থেকে বিএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি পাশ করা মেয়েটি নিজের বিপ্লবী দাদার বন্ধু শান্তিময় রায়কে বেছে নিয়েছিল জীবনসঙ্গী হিসেবে। ১৯৪০-এ বিয়ে, বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই স্বামীর কারাবাস। স্কুলে পড়ানোর কাজ নিয়েছিলেন সাবিত্রী, চাকরি করতে গিয়ে শিশুকন্যার দেখাশোনায় সমস্যা হচ্ছে দেখে ছেড়ে দেন সে কাজ। শিক্ষিতা মেয়ে অথচ নিজে উপার্জনক্ষম নন, এই আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে। লেখালিখিকে আঁকড়ে ধরায় সেই খেদ দূর হয়েছিল। সংসারের নানা কাজের মধ্যেই সময় বার করে লিখেছেন ন’টা উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প, এমনকি শিশু-কিশোরপাঠ্য বইও। শেষ উপন্যাস ‘বদ্বীপ’ প্রকাশিত হয় ১৯৭২ সালে, শেষ বই ‘নীল চিঠির ঝাঁপি’ ১৯৮০-তে। মারা গিয়েছেন ১৯৮৫ সালের ৮ ডিসেম্বর। ক্যালেন্ডারের হিসেবে এই তো সে দিন, ত্রিশ বছরের কিছু বেশি। অথচ পঞ্চাশ থেকে সত্তর দশকের মধ্যে লেখা সাবিত্রী রায়ের বইগুলো আজ কলেজ স্ট্রিটের বইবাজারে পাওয়া যায় না— একমাত্র ‘সাবিত্রী রায়ের নির্বাচিত রচনা-সংকলন’ নামে তাঁর ছোটগল্প-সংগ্রহটি ছাড়া।

এ আমাদের দুর্ভাগ্য। সাবিত্রীর বই, বিশেষত উপন্যাসগুলি না পড়া মানে, একটা খুব জরুরি আর জটিল সময়কে শুধু সাম্যবাদী মতবাদের দিক দিয়ে বলে নয়, মানবিক জীবনবোধ দিয়ে বুঝতে অস্বীকার করছি আমরা। ভুলে থাকছি একটা বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের যাত্রাপথের মাইলফলক আর খানাখন্দ, উভয়কেই। এই বিস্মৃতি কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, ভয়ঙ্করও; কারণ আজকের রাজনীতিতেও চোখে পড়ে সেই উত্তরণ ও স্খলন, সাবিত্রী যা পঞ্চাশ বছর আগে লিখে গিয়েছেন।

তাঁর ‘স্বরলিপি’ উপন্যাসে পৃথ্বী, রথী, ফল্গু, শীতা, সাগরীর মতো নিবেদিতপ্রাণ পার্টিকর্মীর গায়ে গায়েই ঘোরাফেরা করে নন্দলাল, ব্যোমকেশ, মধু মুখার্জির মতো স্বার্থান্বেষী নেতারা। শীতাংশু নামের তরুণ কর্মীটি স্তম্ভিত হয়ে দেখে, সারা দিন না-খাওয়া কৃষক কর্মীদের একটু অর্থসাহায্যের আবেদন নস্যাৎ করে ব্যোমকেশ তাকে নিয়ে ‘একটু চা খাওয়া যাক’ বলে রেস্তরাঁয় ঢোকে, ডবল কাপ চা আর পুরু অমলেট অর্ডার দেয়। ব্যোমকেশের বাড়িতে শৌখিন আসবাব, নরম গালিচা, বিলিতি কাপে সুগন্ধি চায়ের সঙ্গে সাম্যবাদী নেতার বিপ্লবের বুলিকে মেলাতে পারে না সে। প্রতিবাদ করে পৃথ্বী আর রথী দু’জনেই ‘বুর্জোয়া সংস্কারবাদী’ ছাপ্পায় দল থেকে বহিষ্কৃত, নেতা নন্দলাল কৌশলে রথীর স্ত্রী সাগরীকেও টেনে আনে নিজের কমিউনে, সাগরীকে চাপ দেয় রথীকে ডিভোর্স দিতে। আসলে হিংস্র পুরুষের কামুক নজর পড়েছে বিপ্লবের স্বপ্ন-দেখা মেয়ের উপরে, নন্দলালের স্যাঙাত এক দিন সাগরীকে জানিয়েই দেয়, ‘নন্দলাল is waiting for you...’ এই ঘিনঘিনে নীচতার আবর্তে সাম্যবাদ কোথায়! দল আর মতাদর্শের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকে যে পুরুষতন্ত্রের রাক্ষস, সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে দাঁতনখ নিয়ে— রাজনীতি-সচেতন নারী তার কবল থেকে বাঁচে কী করে— লিখে যান সাবিত্রী।

শুধু নেতা আর কর্মী নয়, জোতদার আর কৃষক নয়, পুরুষ আর নারী নয়। সবার উপরে তো জেগে থাকে মানুষ। বিপ্লব, বিদ্রোহ, দেশভাগ, দাঙ্গা পেরিয়ে রোজকার জীবনটা টেনে-হিঁচড়ে বয়ে নিয়ে যেতে হয় তাকে। ভাত খেতে হয়, ভাতের সন্ধানে বেরোতে হয়। এই নিরাবরণ নিরাভরণ মানুষকে সাবিত্রী দেখেন দরদ দিয়ে। ‘পাকা ধানের গান’-এর মূল চরিত্র পার্থ যখন হাজংদের নিয়ে কৃষক আন্দোলনে মিলিটারির গুলিতে প্রাণ দেয়, সাবিত্রীর কলম সে বর্ণনায় দৃঢ়। জমিদারের ধামাধরা জগাই বাড়ুজ্জের বিরুদ্ধে পাহাড়পুরের সাধারণ মানুষের সংগঠিত প্রতিরোধের ছবি আঁকেন অনমনীয় ঋজুতায়। সেই কলমই যেন ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ছোটগল্পে— যেখানে মন্বন্তরের পরের কলকাতায় বিরাট অভিজাত বাড়ির নর্দমা দিয়ে গড়িয়ে আসা ফ্যান আর তার সঙ্গে মিশে থাকা কয়েকটা ভাতের জন্য কামড়াকামড়ি করে ক্ষুধার্ত মানুষ। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা— কাজের মেয়ে গোলাপি যে ক’টা ভাত পায় নিজেই খেয়ে ফেলে, স্বামীকেও দেয় না। আবার ‘পাকিস্তান’ থেকে চলে আসা অন্ধ ভিখিরি শহরের রাস্তায় ‘ময়ূরপঙ্খি নৌকা আমার মেঘনা চরে বাড়ি’ গান গেয়ে যত না ভিক্ষে চায়, তারও বেশি চায় বাউলের, শিল্পীর যথোচিত সম্মানটুকু। পুব বাংলার গ্রামের সম্পন্ন বাড়িতে সারা জীবন সেবা-দেওয়া বুড়ি পরিচারিকাকে রেখেই ‘ইন্ডিয়া’ রওনা দেয় সবাই। যে ছেড়ে যায় আর যাকে ছেড়ে যাওয়া হয়, এই দুই অসহায় মানুষের জন্যই ভালবাসা টলটল করে সাবিত্রীর কলমে।

এক ক্রান্তিকালের কথাকার হয়েও বাংলার ‘মূলস্রোতের’ সাহিত্যিকদের আলোচনায় উঠে আসে না সাবিত্রী রায়ের লিখন। বিয়াল্লিশের অগস্ট আন্দোলন বলতেই যেমন অমোঘ ভাবে ভেসে ওঠে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’, তেভাগা আন্দোলন-দেশভাগ-দাঙ্গার সূত্রে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’ যেমন প্রগাঢ় ভাবে মনে পড়ে, পঞ্চাশের মন্বন্তর বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (নাকি সত্যজিৎ রায়ের?) ‘অশনি সংকেত’, অমলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পটা মনে না রেখেও যে ভাবে মৃণাল সেনের ছবির জন্য মনে রাখি ‘আকালের সন্ধানে’, তেমন করে তো সাবিত্রী রায় আর তাঁর লেখালিখিকেও মনে রাখা উচিত ছিল! এই অতল বিস্মৃতি প্রাপ্য ছিল না সাবিত্রীর। গণ্ডিবদ্ধ সাংসারিকতা থেকে বাঙালি মেয়েকে উত্তরণের হদিশ দেওয়া আশাপূর্ণা দেবী, বা জল-জঙ্গল-মাটির সংগ্রামের হয়ে কলম ধরা মহাশ্বেতা দেবী যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন, সাবিত্রী রায় তা পাননি। তিনি রয়ে গিয়েছেন তাঁরই গল্পের চরিত্র শকুন্তলা দেবীর মতোই নিভৃতে, পানের পিক আর সর্দি-বসা পাকা কফ লাগা দেওয়াল পেরিয়ে সরু গলির মধ্যে স্যাঁতসেঁতে বাড়ি যার ঠিকানা; জ্বরার্ত শিশুর পরিচর্যা, রান্না, দেবর-শাশুড়ির বিদ্রুপ আর স্বামীর উদাসীনতা সয়েও যিনি লিখে যান। গত বছর জন্মশতবর্ষ পেরিয়েছে সাবিত্রী রায়ের, বাঙালি প্রকাশনাগুলো তাঁর বই পাঠকের হাতে ফের তুলে দেওয়ার ভার নিলে তাঁর লেখক-সম্মানটুকু বাঁচে। আনন্দবাজার



Sunday, June 16, 2019

চিরনির্ভর, চিরশান্তি - আমার বাবা সাইফুদ্দিন খান

কন্যাসন্তানের নামের সাথে 'কল্যাণীয়া' শব্দ বসাতে খুব ভালোবাসতেন অামার বাবা অাকৈশোর সংগ্রামী এক অনন্য মানবতাবাদী মানুষ সাইফুদ্দিন খান।বাবার কোলে করে বেড়ানোর স্মৃতি এখনো অমলিন।বাসা থেকে বেরুলেই হেঁটে কোর্ট বিল্ডিংয়ের মুখের দোকান থেকে নানান স্বাদের নাবিস্কো চকলেট কিনে দিতো অামাদের তিন ভাইবোন কে। কন্যাসন্তানের ও জীবন অাছে, তার ইচ্ছেমতো চলার স্বাধীনতা অাছে - একথা বাবাই প্রথম অামাকে বুঝতে শেখান। অাজ বাবা নেই বলে গভীর শূণ্যতায় ডুবে যাই বারবার!
 অামার যতো অনুযোগ, অনুরোধ,অভিমান প্রকাশের একচ্ছত্র অাধিপত্য ছিল যার ওপর,অামার অাব্বু কে খুব মিস করছি। অাজ বাবা দিবসে বাবাকে কাছে পেলে স্বর্গীয় সুখ পেতাম নিশ্চয়!
বাবাকে এভাবে না হারালে ও তো পারতাম!
 সময় কতো বদলে যায়, সন্তানদের কাছে  বাবার মতো অাব্দার করা না গেলে ও সন্তানদের বাবা বলে ডাকি।সন্তানদের গুরুত্ব, তাদের অাব্দার, মান অভিমান অামাদের কাছে অনেক গুরুত্ব রাখে। অার তাই তাদের বয়স এবং সময়ের কাছে ছেড়ে দিতে হয় তাদের বোধগম্যতা।অামার অাব্বু, তুমি যেখানেই থাকো- তোমার অসমাপ্ত কাজ অামার কর্মযজ্ঞের অংশ,জানো তুমি। তোমার স্পর্শ প্রতিমুহূর্তে অামি অনুভব করি,অাব্বু অামার! বাবা দিবসে অামার চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি বাবা সাইফুদ্দিন খানকে অন্তরের অন্তঃস্থলে অনুভব করছি, যিনি অামার সবকিছুতে অামার সঙ্গে অাছেন বলে অামি অনুভব করি প্রতি মুহূর্তে!
বেলা ১১টা
১৬ জুন ডাবলিন,অায়ারল্যান্ড

Monday, April 29, 2019

এবার ফিরাও মোরে- কোথায় আল্লাহ ঈশ্বর ভগবান?-সুমি খান

প্যাগোডা গীর্জা
মসজিদ মন্দির
কোথায় আল্লাহ-তুমি অবতার?
কোথায যে ভগবান?
কোথায় কৃষ্ঞ যিশু?
কাঁদছে নারী
কাঁদছে পুরুষ
আবাল বৃদ্ধ শিশু!

পবিত্রতায় নিস্তরঙ্গ
করুণায় থরোথর!
বিপন্ন আজ তোমার মানুষ
কান্নার সরোবর!
রক্তের নদী বয়ে যায়
সিনাগগ,গীর্জায়!
মসজিদ -মন্দির ভাসে শুধু রক্তের বন্যায়!

তথাগত কতো শান্তির বাণী দিলো-
মন্দিরে দেবী খন্ডিত-
ভেঙ্গে চুরে
আর আগুনে পুড়ে
রামুর যতো বুদ্ধমূর্তি
সব একাকার লুন্ঠিত!

কেন তবু তুমি নির্বিকার-নীরব ?
বিশ্বজুড়ে যখন তারা সরব !
তাদের হাতেই খোলা তরবারি -
তাদের মাথায় কৃপা যে তোমারি!
যাদের হাতের খড়গ কৃপাণ
কেড়ে নিলো কোটি নিরীহ প্রাণ!

খড়গ হাতে গুজরাট জুড়ে
ছুটেছে কৃপাণ আসানসোলে
নিরীহ কিশোর সিবঘাতুল্লাহ
প্রাণ হারিয়েছে যাদের হাতে!
তাদেরও কপালে জ্বল জ্বল করে
ভগবান পদচিহ্ণ !
তারা শুধু ছুটে চলেছে অসীমে-
সভ্যতা নিশ্চিহ্ণ!

খোলা তরবারী পতাকায় আঁকা
কলেমা তৈয়ব লেখা -
উড়িয়ে সে ধ্বজা
হেসে হেসে খুন করে গেলো তারা
নিরীহ শিশু যতো -
দ্যাখোনি কি তুমি
জায়াানের মা- ’হায় খোদা ‘বলে
তোমায় ডেকেছে কতো?
তবু যে তোমার আরশ কাঁপে না-
শিয়রে তাদের মৃত্যু হাসে না
আসে না তো যম-
আসে না তো আজরাইল!
আসে না তো কোন দৈববাণী
শান্তির দূত হয়ে-
এবার ফিরাও মোরে!
হে বিধাতা মোর-
এবার ফিরাও মোরে!
------------------------
০০২
----------------
লক্ষ্মীপেঁচা জেগেছিলো কাল
বলে গেছে অমানিশা
ঘিরেছে পৃথিবী -
হারিয়েছে যেন দিশা!
সকাল ৮টা ২৪ মিনিট, ৩০ এপ্রিল,২০১৯, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা

Saturday, April 6, 2019

৮০% দগ্ধ মাদ্রাসা ছাত্রী রাফি বাঁচতে চায়- নারী নেত্রীরা একাত্ম হবেন কি আজ?-সুমি খান

০৬ এপ্রিল, ২০১৯
শরীরের ৮০% দগ্ধ  নুসরাত জাহান রাফি (১৮) কে বাঁচানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন ডা. সামন্ত লাল সেন স্যার। রাফি শুধু একটি শব্দ বলেছে, ”আমাকে বাঁচান ।”
 রাফিকে বাঁচানোর চেষ্টার পাশাপাশি জোরালো প্রতিবাদ গড়ে তুলতে হবে রাফির গায়ে আগুন দিয়ে যারা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পেটোয়া বাহিনীর উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে।
রাফির অপরাধ  গত ১৭ মার্চ সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজ উদ্দৌলা তার কক্ষে  রাফীকে ডেকে নিয়ে যৌন হয়রানির চেষ্টা করে। সেই অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ্দৌলাকে আটক করেছে পুলিশ। সেই ঘটনার পর থেকে  শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অধ্যক্ষের শাস্তির দাবিতে মানবন্ধন করেছে।  যৌন হয়রানির অভিযোগে আটক অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার অনুগত ছাত্ররা তার মুক্তির দাবিতে মানবন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে ।
ফেনী জেলার সোনাগাজীতে আলিম পরীক্ষাকেন্দ্রে  নুসরাত জাহান রাফি (১৮) র গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্যান্ত  পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা  করেছে তার সহপাঠিরা। রাফির শরীরের প্রায় ৮০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে গেছে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছে তার ভাই। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে।
ফেনী সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আবু তাহের জানান,দগ্ধ ছাত্রীর শরীরের ৭০-৮০ শতাংশ পুড়ে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ রাফীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেছেন।
নুসরাত জাহান রাফির ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন,শনিবার সকালে আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষায় অংশ নিতে রাফি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা কেন্দ্রে যায়।তখন অধ্যক্ষ সিরাজ্উদ্দৌলার নিয়ন্ত্রিত কয়েকজন শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে ফুসলিয়ে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা নুসরাত জাহান রাফিকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরবর্তীতে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য রাফিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান। সেখানে ডা. সামন্তলাল সেনের তত্বাবধানে রাফির চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
ডা. সামন্তলাল সেন এই প্রতিবেদককে জানান, নুসরাত জাহান রাফির অবস্থা ভালো নয়, তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়েছে। নুসরাত জাহান রাফি ডা. সামন্ত লাল সেনকে শুধু একটি কথাই বলেছে, “আমাকে বাঁচান।!”  ডা. সামন্তলাল সেন এই প্রতিবেদককে জানান, তাঁরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন রাফিকে বাঁচানোর জন্যে। এদেশে বার্ণ ইউনিটের অনেক রোগীর জন্যে ডা.সামন্তলাল সেন ’ফেরেশতা’ বা ’দেবদূত’। তাঁর সাধ্যাতীত চেষ্টাতে সেরে উঠেছেন অনেকেই। আমরা রাফির সুস্থতার জন্যে প্রার্থনা করছি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের একজন নেত্রীকে ফোন করে জানালাম রাফির শারীরিক অবস্থা । তিনি জানালেন , ”আজ আর সময় নেই।” আরো বললেন. কাল ভেবে দেখবেন কাউকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো যায় কিনা। বিস্ময়ে হতবাক হতে ভুলে গেছি আমি।
নুসরাত জাহান রাফির জন্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ অথবা মাদ্রাসার শিক্ষক সমাজ বা ওলামা সমাজ কারো কি কোন দায়িত্ব নেই? নুসরাত জাহান রাফি আজ একটি প্রতীকি নাম ।
নুসরাত জাহান রাফি তার উপর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ‘দায়ে’ পরীক্ষার হলে জীবন্ত দগ্ধ হলো তার মাদ্রাসার ছাদে।
২০১৯ সালে এসে এ কোন মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হতে হলো রাফিকে। আমার দু’চোখে নীরব অশ্রুধারা। রাফি মাদ্রাসা ছাত্রী । ধর্ম কর্ম তো শতভাগ মেনেই চলেছিলো মেয়েটি। তাহলে কোন্ অপরাধে তাকে আজকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করালো তারই সহপাঠীবৃন্দ, যারা ইসলাম ধর্মের শিক্ষার্থী ? তাদের কি ধর্ম অধর্ম জ্ঞান আদৌ শেখানো হয়? কোন মানবিক শিক্ষা তাদের দেয়া হয় কিনা যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
সরকার মাদ্রাসার জন্যে দু’হাত তুলে সহযোগিতা করছেন। আজকের দিনে আবারো প্রমাণিত হলো তাদের  সুশিক্ষা, মানবিক শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করতে হবে সবার আগে।
 রাফির সাথে যে বর্বরতা হয়েছে তার প্রতিবাদে কি মুখর হবেন না কেউ?
ফেণীতে যৌন নিপীড়নকারী অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন আর মিছিল যারা করছে, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক্ । আশা করি প্রতিবাদী নারী সমাজ মাঠে নামুক রাফির উপর বর্বরতার দায়ে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে।
সম্পাদক, সূর্যবার্তানিউজডটকম
সন্ধ্যা ৬টা ৪০ মিনিট, শনিবার।

Monday, April 1, 2019

নারীর আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার কতো দূরে? -সুমি খান

নারীর জীবন-০০১

আমাদের দেশে এখনো নারীর সম্মান এবং আত্মসম্মান যেন খোলামকুচি। কৈশোর পেরুতে না পেরুতেই যখন বিয়ে হয়ে যায়, সেটা প্রেমের বিয়ে হোক্ আর পরিবারের সিদ্ধান্তেই হোক্- সেই বিয়ে তার জীবনে যদি শান্তি এনে না দেয়, তখন পরিবারকে নিশ্চয়ই দায়িত্ব নিতে হবে মেয়েটির জীবনে কিছুটা অন্তত শান্তি আনার। তার জীবনে যদি অশান্তি ই অবধারিত সত্য হয়,সেই বিয়ে তার জীবনকে অশান্ত করে তুললে তাকে যে কোন অজুহাতে কেন বাধ্য করা হবে অস্থিতিশীল কোন বৈবাহিক সম্পর্কে জীবনভর বন্দী থাকতে? সন্তানদের সুস্থতার জন্যেই এখন বিশ্বের উন্নত দেশে ’সিঙ্গেল মাদার’ দের জন্যে রাষ্ট্র অনেক সুযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমাদের দেশেও সে ব্যাপারে ভাবতে হবে । বিয়ে এবং বৈবাহিক সম্পর্কের দায়িত্বশীলতা নিয়ে অনেকের মাঝে যে অজ্ঞতা এবং সংস্কার রয়ে গেছে, তার শিকার হয়ে অকালে হারিয়ে যাবে অনেক সম্ভাবনাময় জীবন। তালাকের হার বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, তালাককে এখন ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে হবে।তালাকেরযৌক্তিক কারণ না থাকলে সাধারণতঃ একজন নারী তালাকের আবেদন করেন না।

জেন্ডার সেন্সেটাইজেশানের যুগে বৈবাহিক সম্পর্ক নারী পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই আর। সমাজ বাস্তবতা অনেক আদি সংস্কারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে দিয়েছে। নারীর সাথে নারীর এবং পুরুষের সাথে পুরুষ বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। প্রকৃতিগতভাবে তারা ভিন্ন জেন্ডারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে অক্ষম। সেই বাস্তবতায় একজন নারী তার বৈবাহিক সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থানে  না থাকলে সেই নারীর মা -বাবা এবং পরিবারের আন্তরিক ভূমিকা মেয়েটির মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে নিঃসন্দেহে। যা খুব কমই দেখা যায়। এ কারণে পরিবারের  দায়িত্বশীল ভূমিকার অভাবে অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যায়।

সন্তানের কারণে অনেক সম্পর্কের ভাঙ্গন সাময়িক ভাবে ঠেকে থাকলেও নারীর দায়িত্বশীল ভূমিকাকে দিনের পর দিন দুর্বলতা মনে করে,যে পুরুষ, তার সাথে ‘জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন’ মনে করার মতো অবাস্তব জগতে নারী রা অবস্থান করে না। নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, “সে যুগ হয়েছে বাসী-যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো নারীরা আছিলো দাসী!” তাই নারীরা এখন দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবার স্পর্ধা দেখাতে পারছে। পরিবার এবং অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ভূমিকা অনেক ক্ষেত্রে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধন দৃঢ় রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। তবু যে সম্পর্ক রাখতে হলে নারীকে তার আত্মসম্মান হারাতে হয়, সেই সম্পর্ক ঘুচাতে বাধ্য হয় আজকের নারী। আর এ সমাজে তালাকপ্রাপ্তা নারীর প্রতি তার পরিবারের করুণা আর বঞ্চনা যে কতোটা দুঃসহ জীবন যাপনে তাকে বাধ্য করে , তা অনেক নারীই জানেন। তবু মানুষের মতো করে বাঁচবার প্রত্যয়ে বঞ্চিত অপমানিত জীবন থেকে মুক্তি চায় আজকের নারী।

আর এ কারণে ঢাকা শহরে এখন প্রতি ঘন্টায় একজন তালাক দিচ্ছে ( প্রথম আলো-২৭ আগষ্ট, ২০১৮) এ বাস্তবতায় অনেকেই ডিভোর্স কে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেন না। সেটা তাদের সমস্যা। সমাজ এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আমাদের আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ষাটের দশকেই পারিবারিক বিচ্ছেদ বা ডিভোর্সের ঘটনা ঘটেছে ।তবু আমাদের পরিবার গুলোতে এখনো ডিভোর্স বা তালাকের ঘটনা সহজভাবে নিতে পারেন না অনেকে। কিন্তু কেন? পারিবারিক সংকটেে যদি পারস্পরিক সম্পর্ক সুরক্ষার চেষ্টা না থাকে, সেই পরিবারের মূল্য কী?  সেসব পরিবারে সন্তানদের জীবনেও অনেক অনিশ্চয়তা থাকে। এ কারণেই সম্পর্ক ভাঙ্গে, দিনের পর দিন শূণ্যতায় ডুবে যায় নিঃসঙ্গ একাকী নারী।

এক দিন সেই শূণ্য জীবনে যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় তার সঙ্কটে একাত্ম হয়ে কোন বন্ধু , সেটা যে কোন নারীর জীবনে পরম পাওয়া। তার পরিবারের জন্যেও তা পরম পাওয়া। গভীর সঙকট থেকে উত্তরণের পথে এই সুন্দর ক্ষণ খুব কম নারীর জীবনেই আসে। যে কোন পরিবারের জন্যেই বন্ধুর মতো প্রিয়জন পাওয়া অনেক বড়ো পাওয়া।এ নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমার মিতা এবং প্রিয় বন্ধু শাহনাজ সুমি, প্রিয় বন্ধু সঙ্গীতা নন্দী, প্রিয় মানুষ চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিক শামীম আখতার  এবং আমার শ্রদ্ধাভাজন রুমানা নাহিদ সোবহান, নাজনীন পাপ্পু এবং আমার মাসীমা কোলকাতার বালিগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হেডমিস্ট্রেস মমতা ঘোষ এর  সঙ্গে।

এঁদের সকলের বক্তব্য, নারীকে তার আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার থেকে চিরদিন বঞ্চিত রাখতে পারে না কোন সমাজ। মানসিক বা শারীরিক নিপীড়ন জীবনভর টেনে নিলে সেই নারী বড়ো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে- সেই যুগ  বাসী হয়ে গেছে। যদিও তালাক বা ডিভোর্সাস চাইলে নারীকে এখনো অনেক পরিবারে হেনস্থা হতে হয়; তবু নারী বেরিয়ে আসছে তার আপন ভাগ্য জয় করবার মানসে। আমার মাসীমা মমতা ঘোষ কোলকাতার বালিগঞ্জ থাকেন। তিনি বললেন, ”কোলকাতায় এখন ডিভোর্স এবং পুনর্বিবাহ  খুবই পরিচিত ঘটনা। আমার ছোট ভাইয়ের ক্যান্সার। এই অসুস্থ শরীরেই তার ছেলের সাথে ডিভোর্স হওয়া মেয়েকে সেই মেয়ে( প্রাক্তন পুত্রবধু)র পছন্দের ছেলের সাথে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে দিয়েছে।”

ঢাকাতেও এমন চিত্র সচরাচর দেখা যায় না বলা যায় না।তবে ঢাকার বাইরে এখনো ‘বিয়ে’ কে শান্তিপূর্ণ রাখতে কেউ পাশে না থাকলে ও বিয়েকে ‘জন্মজন্মান্তরের বন্ধন’  হিসাবে মানতে অনেক মেয়েকে বাধ্য করা হয়। সেই সংস্কার থেকে যতোদিন বেরিয়ে আসবে না, আমাদের সমাজ ততোদিন অন্ধকারেই রয়ে যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পারিবারিক শান্তি কখনোই প্রতিষ্ঠা হবে না।
 বিকেল ৫টা, পয়লা এপ্রিল, ২০১৯ সাল, বসুন্ধরা, ঢাকা।
লেখক-সম্পাদক - সূর্যবার্তানিউজ.কম

Wednesday, March 13, 2019

নারীর অধিকার ও নেতৃত্ব প্রশ্নে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে সমস্যাপূর্ণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে- আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস

 ৮ মার্চ ২০১৯
শান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার এবং টেকসই উন্নয়নে বৈশ্বিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে অপরিহার্য বিষয় হলো লিঙ্গসমতা ও নারীর অধিকার। আমরা কেবল ঐতিহাসিক অবিচার সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে এবং সবার অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে কথা বলে প্রতিষ্ঠানে আস্থা পুনঃস্থাপন ও সংহতি পুনর্গঠন করতে পারি এবং বহুমাত্রিকভাবে লাভবান হতে পারি।

সাম্প্রতিক দশকগুলোয় কিছু ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও নেতৃত্ব প্রশ্নে আমরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এসব অর্জন পুরো বা ধারাবাহিক অর্জনের তুলনায় নগন্য এবং এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা থেকে সমস্যাপূর্ণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এসেছে।
ক্ষমতার প্রশ্নে লিঙ্গসমতা একটি অপরিহার্য বিষয়। আমরা পুরুষশাসিত বিশ্বে পুরুষনিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতির মধ্যে বাস করি। নারীর অধিকারকে আমরা যখন সবার লক্ষ্য হিসেবে নিই, যা কি না সবাইকে লাভবান করতে পারে এমন একটি পথ, তখনই কেবল আমরা ভারসাম্যে পরিবর্তন দেখি।
নারীদের মধ্যে থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ানো অপরিহার্য। জাতিসংঘে আমি এই বিষয়টিকে ব্যক্তিগত ও জরুরি অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছি। বিশ্বজুড়ে আমাদের দলগুলোকে নেতৃত্ব দানকারীদের মধ্যে এখন লিঙ্গসমতা নিশ্চিত হয়েছে এবং জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা দলে এখন নারী সদস্যের সংখ্যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। আমরা এ ক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রাখব।

কিন্তু ক্ষমতা প্রাপ্তি ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের এখনো বড় ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, মাত্র ছয়টি দেশ কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষকে সমানাধিকার দেয়। এবং এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে অর্থনৈতিকখাতে লিঙ্গ পার্থক্য ঘুঁচিয়ে উঠতে এ বিশ্বের ১৭০ বছর সময় লাগবে।
জাতিয়তাবাদী, জনরঞ্জনবাদী ও কঠোরতা নীতিতে লিঙ্গ অসমতা যোগ করে, যা নারীর অধিকার খর্ব করে এবং সামাজিক পরিসেবা সীমিত করে। কিছু দেশে হত্যাকাণ্ডের সার্বিক হার কমলেও লিঙ্গজনিত কারণে বিদ্বেষপ্রসূত নারী হত্যার হার বাড়ছে। অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে আমরা পারিবারিক সহিংসতার বা নারীর জননাঙ্গ ছেদের বিরুদ্ধে আইনি সুরক্ষার ঘাটতি দেখতে পাই। আমরা জানি, নারীর অংশগ্রহণ শান্তিচুক্তিকে টেকসই করে, কিন্তু এমনকি সরকারও, যারা এ ক্ষেত্রে সোচ্চার কণ্ঠ তারাও কাজের ক্ষেত্রে নিজেদের কথার বাস্তবায়নে ব্যর্থ। ব্যক্তি ও পুরো সমাজকে আঘাত করার কৌশল হিসেবে সংঘাতে যৌন সহিংসতার পথ বেছে নেওয়া অব্যাহত রয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটের বিরুদ্ধে নারীর অধিকার, মর্যাদা ও নেতৃত্বকে সুরক্ষা দিতে ও এর পক্ষে প্রচারণার ক্ষেত্রে আমাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করতে হবে। দশকের পর দশক ধরে যে বিষয়টি বিজয়ী হয়ে এসেছে, আমাদের তাকে আর জয়ের সুযোগ দেওয়া উচিত নয় এবং এ ক্ষেত্রে সার্বিক, দ্রুত ও আমুল পরিবর্তনের ওপর আমাদের অবশ্যই জোর দিতে হবে।

এ বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘সমান চিন্তা, বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণ, পরিবর্তনের জন্য উদ্ভাবন’, যা সেই সব পরিকাঠামো, ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে চিহ্নিত করে, যেগুলো গড়ে উঠেছে পুরুষ নির্ধারিত সংস্কৃতির আলোকেই। আমাদের এই বিশ্বটাকে পুনঃকল্পনা ও পুনর্নির্মাণের জন্য আমাদের একটি উদ্ভাবনী পথ খুঁজে বের করা প্রয়োজন, যা সবার জন্যই সমান কার্যকর হবে। নগরায়ন নকশা, পরিবহন ও জনপ্রশাসনের মতো ক্ষেত্রে নারী সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা এসব খাতে নারীর প্রবেশের সুযোগ বৃদ্ধি, হয়রানি ও সহিংসতা প্রতিহত এবং সবার জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে পারেন।
এই বিষয়টি ডিজিটাল ভবিষ্যতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যা আমাদের ওপরই নির্ভরশীল। উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিতে নির্মাতার বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গণিত ও নকশা প্রণয়ন খাতে নারীর অপ্রতুল প্রতিনিধিত্ব ও নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি সবার জন্যই উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত।
গত মাসে ইথিওপিয়ায় আমি ‘আফ্রিকান গার্লস ক্যান কোড’ নামের একটি উদ্যোগের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়েছি। এই উদ্যোগ ডিজিটাল জগতে লিঙ্গ পার্থক্য ঘোচাতে এবং প্রযুক্তি দুনিয়ায় আগামীর নেতৃত্বকে প্রশিক্ষণ দিতে কাজ করে। ওই মেয়েরা নিজেদের প্রকল্পে যে শক্তি আর উদ্যম প্রদর্শন করেছে, তাতে আমি অভিভূত। এ ধরনের কর্মসূচি কেবল দক্ষ জনশক্তিই গড়ে তোলে না, এগুলো মেয়েদের লক্ষ্য ও স্বপ্নকে সীমিত করা ধরাবাধা ছককেও চ্যালেঞ্জ জানায়।
এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে, আসুন আমরা নিশ্চিত করি যে নারী ও কিশোরীরাও আমাদের সবার জীবনের ওপর প্রভাব ফেলা নীতি, পরিষেবা ও অবকাঠামোর আকার দিতে পারে। এবং আসুন যে নারী ও কিশোরীরা সবার জন্য সুন্দর পৃথিবী গড়তে বাধা ভাঙছে, তাদের সমর্থন জানাই।

সংকট মুক্তির পথে নারীর পাশে থাকুক তার মা, পরিবার এবং সমাজ-সুমি খান

  আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হলো বিশ্বব্যাপী । March 8 ,2019- #BalanceforBetter প্রতিপাদ্য নিয়ে এবার নারী দিবস পালিত হলো। একটু ভালোর জন্যে জীবন জীবিকা নিয়ে ব্যালেন্স করে চলতে শিখতে হয় আমাদের।
 অনেকটা নীরবেই পার করেছি এবারের নারী দিবস। আমার কৈশোর থেকে নারী দিবসের প্রাক্কালে পত্র পত্রিকায় লেখা দিয়েছি। সকালবেলা মা’কে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্যে দিয়ে শুরু হতো নারী দিবস। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে এ দিবস পালনের রীতি ছিল । এবারে একটু দেরিতেই নারী দিবস বিষয়ে লিখতে বসলাম। নারীর ক্ষমতায়ন বেড়েছে মনে করেন অনেকে। আপাতদৃষ্টিতে তেমন মনে হলে ও বাস্তবে তা হয়েছে বলে মনে করেন না সমাজবিশ্লেষকেরাও।তবু নারীর অধিকারের লড়াইয়ের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং গোৗরবোজ্জ্বল। 

এই দিবসটি উদযাপনের নেপথ্যে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরিবৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে গুলি চললে নিহত হন অনেক নারীশ্রমিক।সরকারী লাঠিয়াল বাহিনীর দমন-পীড়ন চলে মিছিল কারী প্রতিবাদী নারীশ্রমিকদের উপর।
 ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হয়। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন। এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয়- ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে 'নারীদের সম-অধিকার দিবস' হিসেবে দিনটি পালিত হবে।
দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল। বাংলাদেশে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই এই দিবসটি পালিত হতে শুরু করে। অতঃপর ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি - নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত করার অভীপ্সা নিয়ে।
বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তন্মধ্যে - আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া,আজারবাইজান, বেলারুশ, বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, কিউবা,জর্জিয়া, গিনি-বিসাউ,ইরিত্রিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, লাওস, মলদোভা,মঙ্গোলিয়া,মন্টেনিগ্রো, রাশিয়া,তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান,উগান্ডা,ইউক্রেন,উজবেকিস্তান,ভিয়েতনাম এবং জাম্বিয়া।এছাড়া, চীন, মেসিডোনিয়া, মাদাগাস্কার,নেপালে শুধুমাত্র নারীরাই সরকারী ছুটির দিনভোগ করেন। আমাদের দেশে সর্বক্ষেত্রে নারী দিবস পালিত হলেও এখনো নারীর অধিকার প্রশ্নে পরিবার এবং সমাজ আন্তরিক ভূমিকা পালনে যথেষ্ট পিছিয়ে রয়েছে ।
নারী দিবসে বাণী দিলেন দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে তৃণমূল নেতৃত্বের অনেকে। বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গুলোও তাদের বাণিজ্য করতে ছাড়ে নি । মীনা বাজার এর মেসেজ এলো নারী দিবসে তাদের পণ্যমূল্যে ছাড় দেবার প্রলোভন দেখিয়ে। 
পরিবার এবং সমাজে নারী তার প্রাপ্য সম্মান থেকে এখনো বঞ্চিত । এ কারণে নারী দিবসে ঔদার‌্য দেখাতে যারা বাণী দিলেন, তাদের নিজেদের বোধ ও বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা আছে কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। নারীর মাতৃত্ব যাদের কাছে দুর্বলতা , তাদের শঠতা ,নীচতা আর হঠকারীতার কাছে কেন বিকিয়ে যায় জীবনের দায়িত্ব! নারী তার পরিবারেই বঞ্চিত হয় প্রাপ্য সম্মান থেকে।কবে এর অবসান হবে? বিবাহিত নারীর প্রতি স্বামী কর্তৃক সহিংসতা-সংক্রান্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের রিপোর্টে এ সহিংসতার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা ২০১৫ সালে কমে হয়েছে ৮০ শতাংশ। আবার পুলিশ রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা-বিষয়ক মামলা রুজুর হার বেড়ে চলেছে। যেমন: ২০১০ সালে সারা দেশে এ বিষয়ক মামলা রুজু হয়েছিল মোট ১৭ হাজার ৭৫২টি, সেখানে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২২০টি। এই দুটি উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে একদিকে নারীর প্রতি সহিংসতার হার কমছে, আবার এ ধরনের সহিংস ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের হার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। অর্থাৎ নারী আইনের পথে তার বঞ্চনা এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজে নিচ্ছে। জয় হোক নারী অধিকারের। আইনী পথে প্রতিকার খুঁজে নেবার পর ও পরিবার নারীকে তার জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে এমন দৃষ্টান্ত খুবই হতাশাব্যঞ্জক !
২০১৯ সালের নারী দিবসের অঙ্গিকার হোক এ ধরণের সামাজিক সমস্যা থেকে মুক্ত করতে হবে সমাজকে। নারীর প্রতিটি সংকটে পাশে থাকুক তার জন্মদাত্রী মা এবং পরিবার ; সংকট থেকে উত্তরণের পথে একাত্ম হোক । 
নারী মুক্তি মানব মুক্তির পথ খুলে দেয়। এ কারণেই নারী দিবস ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য’  সমান চিন্তা, বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণ, পরিবর্তনের জন্য উদ্ভাবন', যা সেই সব পরিকাঠামো, ব্যবস্থা ও অবকাঠামোকে চিহ্নিত করে, যেগুলো গড়ে উঠেছে পুরুষ নির্ধারিত সংস্কৃতির আলোকেই। পুরুষ শাসিত সমাজে বেড়ে ওঠা নারী এখনো বিব্রত হয় কন্যা সন্তানের অধিকারের লড়াইয়ে একাত্ম হতে। পুরুষ নির্ধারিত সংস্কৃতির আলোকে বন্দী নারী নিজের অজান্তে অথবা সচেতন ভাবেই ডুবে যায় অন্ধকারের অতল গর্ভে!তবে কি  কন্যা সন্তান এখনো নিরাপদ নয় জন্মদাত্রী মায়ের ছায়াতে থেকেও?
   মায়ের ছায়া যদি ঢাকা পড়ে যায় পুরুষতান্ত্রিকতার দাপুটে  সংস্কৃতির আলোছায়ার খেলায়, অসহায় কন্যার বেঁচে থাকার অধিকার লুঠ হয়ে যায়!
আইনি সুরক্ষায় ক্ষেত্রবিশেষে নারী কোনরকমে রক্ষা পেলে ও পুরুষ নির্ধারিত এবং পরিচালিত সংস্কৃতির প্রতি অন্ধ পরিবারের দায়িত্বহীন বিরূপ অবস্থান সংকটময় করে তোলে নারীর জীবন ও ভবিষ্যৎ।
 সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেৎকিনের জয় হোক! সফল হোক আন্তর্জাতিক নারী দিবস!
 সুমি খান: সম্পাদক, সূর‌্যবার্তানিউজডটকম
১৩ মার্চ, ২০১৯, ঢাকা