Friday, September 13, 2013

মিনি পৃথিবী -আমেরিকা নিয়ে এক ডজন : মুহম্মদ জাফর ইকবাল



আমার ছয়জন ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে আমেরিকা চলে যাচ্ছে। একজন চাকরি করতে, অন্যরা পি.এইচ.ডি. করতে। এরা সবাই এখন আমার সহকর্মী। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাকে জীবন হিসেবে বেছে নিলে পি.এইচ.ডি. করতে হয়। যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই ভালো। আমি নিজেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে ঠিক এই সময়টাতে পি.এইচ.ডি. করতে আমেরিকা গিয়েছিলাম। আমার এই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেছে নেওয়ার আগে কোথায় কী ধরণের প্রোগ্রাম, কোন প্রফেসর কী গবেষণা করেন, তাদের র‌্যাংকিং কী রকম এসব নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছে। আমার মনে আছে, আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক করেছিলাম তার প্যাডের কাগজটি দেখে (না, আমি মোটেও বানিয়ে বলছি না)।

যাবার আগে আমার ছাত্রছাত্রীরা সবাইকে নিয়ে বিশাল একটা পার্টি দিয়েছে। আমি আমেরিকাতে আঠারো বছর ছিলাম, এরপরেও অনেকবার যেতে হয়েছে, তাই পার্টি শেষে সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী যাবার আগে সেই দেশটি নিয়ে কোনো বাস্তব উপদেশ শুনতে চাও? যে উপদেশ বইপত্র-ইন্টারনেট কোথাও পাবে না? তারা সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনতে রাজি হলো।
আমি তাদেরকে তখন এক ডজন তথ্য এবং উপদেশ দিয়েছিলাম, সেগুলো ছিল এরকম :

০১.
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (বা সহজ কথায় আমেরিকা) পুরো পৃথিবীকে দেখে স্বার্থপরের মতো। কিন্তু তারা নিজের দেশের জন্যে সাংঘাতিকভাবে নিঃস্বার্থ। (একাত্তরে দেশটি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল কিন্তু তাদের দেশের মানুষ ছিল আমাদের পক্ষে)।
এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে যে সব দেশে হানাহানি খুনোখনি যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে সব জায়গায় সূক্ষ্মভাবে হলেও আমেরিকার একটা যোগাযোগ আছে। তবে দেশটি যেহেতু নিজের দেশের মানুষকে ভালোভাবে দেখেশুনে রাখে, তাই থাকার জন্যে সেটি চমৎকার একটা জায়গা। সারা পৃথিবী থেকে সব দেশের মানুষ সেখানে গিয়ে এটাকে একটা মিনি পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছে। এই দেশে কেউই বিদেশি নয়, তাই থাকার জন্যে, লেখাপড়া বা গবেষণা করার জন্যে আমেরিকার কোনো তুলনা নেই।

০২.
আমেরিকার সাধারণ মানুষেরা গোমড়ামুখী নয়, তারা খুব হাসিখুশি। পথে ঘাটে সুন্দরী মেয়েরা খামোখা মিষ্টি হাসি দিলেই তারা প্রেমে পড়ে গেছে ভাবার কোনো কারণ নেই।

০৩.
পশ্চিমা দেশের মানুষেরা নাম নিয়ে মোটেও সৃজনশীল নয়। তারা ধরেই নেয়, সবার নামের দুটো অংশ থাকবে। প্রথম অংশটা হচ্ছে ঘনিষ্টদের ডাকার জন্য এবং শেষ অংশটা আনুষ্ঠানিক পারিবারিক নাম। পারিবারিক নাম যে নামের প্রথমে থাকতে পারে (শেখ মুজিবুর রহমান) সেটা তারা জানে না। খেয়ালি বাবা হলে যে পারিবারিক নাম নাও থাকতে পারে (বড় ভাই হুমায়ূন আহমেদ, মেজো ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ছোট ভাই আহসান হাবীব) সেটাও তারা জানে না। একটু ঘনিষ্ঠ হলেই নামের প্রথম অংশ দিয়ে ডাকা শুরু করে বলে আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষেরা আমেরিকা পৌঁছানোর কিছু দিনের ভেতরে আবিষ্কার করে সবাই তাদেরকে মোহাম্মদ বলে ডাকছে! তাই ঘনিষ্ঠদের কাছে কে কী নামে পরিচিত হতে চায়, সেটা একেবারে প্রথম দিনে পরিষ্কার করে খোলাখুলি বরে দেওয়া ভালো। আমেরিকায় নামের আগে মোহাম্মদের সংক্ষিপ্ত রূপ MD লেখা খুবই বিপজ্জনক, তারা সেটাকে ডাক্তারি ডিগ্রি মনে করে সবসময়ই নামের পিছনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।

০৪.
যখন প্রথম প্রথম কেউ আমেরিকা যায়, তখন তাদের স্কলারশিপ বা বেতনের চেক পায় ডলারে। কিন্তু তারা যখন খরচ করতে যায়, তারা সেটা ডলারে খরচ করতে পারে না, তারা খরচ করে টাকায়। নিজের অজান্তেই কোনো কিছুর দাম দেখামাত্র মনে মনে ৮০ দিয়ে গুণ করে ভিমড়ি খেতে শুরু করে। এক কাপ কফির দাম একশ থেকে তিনশ টাকা, সিনেমার টিকেট আটশ থেকে হাজার টাকা, আইসক্রিমের কোন দুইশ থেকে পাঁচশ টাকা, গানের সিডি প্রায় হাজার টাকা, একটা বই দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মধ্যবিত্ত সন্তানের পরিবারের জন্য সেখানে কেনাকাটা করা রীতিমত কঠিন একটা ব্যাপার। (তবে বড় লোকের ছানাপোনারা যারা এই দেশে বনানী গুলশানের হাইফাই দোকানপাট, রেস্টুরেন্টে ঘোরাফেরা কিংবা খানাপিনা করে অভ্যস্ত তাদের জন্য ব্যাপারটা সহজ, এই দেশে তারা মোটামুটি আমেরিকান দামেই কেনাকাটা বা খানাপিনা করে।) কাজেই অন্য সবার প্রথম কাজ হচ্ছে কোনো কিছু কেনার আগে মনে মনে আশি দিয়ে গুণ করে ফেলার অভ্যাসটুকু ঝেড়ে ফেলা।

আমেরিকায় কেনাকাটার আরেকটা বিষয় হচ্ছে ‘টিপস’, এর বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে বখশিশ। কিন্তু বখশিশ শব্দটায় তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননার ছাপ রয়েছে। টিপস শব্দটিতে তাচ্ছিল্য কিংবা অবমাননা নেই। আমেরিকার মূলধারায় প্রায় সব তরুণ-তরুণী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের কাজ করে বড় হয়েছে। তখন তাদের বেতন বলতে গেলে ছিলই না এবং খদ্দেরদের টিপসটাই ছিল তাদের বেতন। সে দেশের রেস্টুরেন্টের ওয়েটার, নাপিত বা ক্যাব ড্রাইভারকে টিপস দিতে হয়। হতচ্ছাড়া কিপটে মানুষদের হাত গলে ১০% টিপসও বের হতে চায় না, দরাজদিল মানুষেরা দেয় ২০% আর মাঝামাঝি পরিমাণ হচ্ছে ১৫%।
কাজেই বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে কোথাও খেলে গেলে মেন‍্যতে খাবারের দামটা দেখে আগেভাগেই তার সাথে ১৫% থেকে ২০% যোগ করে রাখাটা জরুরি।

০৫.
আমরা হাত দিয়ে ডাল-ভাত-সবজি-মাছ-মাংস মাখিয়ে মাখিয়ে খাই। আমেরিকা গিয়েও বাসার ভেতরে নিজে রান্না করে সবকিছু হাত দিয়ে খাওয়া যাবে। বাইরে হ্যামবার্গার, স্যান্ডউইচ কিংবা পিৎজা (উচ্চারণটা পিজ্জা নয়, পিৎজা) হাত দিয়ে খেতে পারলেও বেশিরভাগ খাবার ছুরি-কাটা ব্যবহার করে খেতে হবে। আমাদের এই অঞ্চলে খাবার জন্য চামচ দেওয়া হয়। ইউরোপ আমেরিকায় কিন্তু ডাইনিং টেবিলে চামচ নেই, শুধু ছুরি আর কাটা। কোন হাতে ছুরি, কোন হাতে কাটা ধরতে হয় সেরকম নানা ধরণের নিয়ম কানুন রয়েছে। সেই নিয়ম আবার ইউরোপে একরকম, আমেরিকায় অন্যরকম। কিন্তু মূল বিষয়টা খুব সহজ। বেশিরভাগ মানুষ ডান হাতে কাজ করে এবং কাটাকাটি করতে একটু জোর লাগে, তাই ছুরিটা থাকবে ডান হাতে (এবং খাওয়ার প্রক্রিয়াতে সেটা কখনো মুখে ঢোকানো যাবে না, প্রয়োজনে আমি ডাইনিং টেবিলে অন্যের ছুরি ব্যবহার করতে দেখেছি।) এটাই নিয়ম। আমেরিকাতে কাটার জন্য কোনো নিয়ম নেই। যারা ডান হাতে কাজ করে অভ্যস্ত তারা ছুরি দিয়ে কাটাকাটি শেষ করে প্লেটে ছুরিটা রেখে ডান হাতে কাটাকা তুলে নিয়ে খায়। শুনেছি বিশুদ্ধ এরিস্টোক্রেট (বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভ্রান্ত। শব্দটি এরিস্টোক্রেসি পুরোটা ফুটে উঠে না, তাই আসল শব্দটাই ব্যবহার করতে হলো!) মানুষেরা মরে গেলেও ডান হাতে মুখে খাবার তুলে না। এই নিয়মগুলো কে করেছে এবং কেন এই নিয়মেই খেতে হবে, অন্য নিয়মে কেন খাওয়া যাবে না, আমি তার উত্তর জানি না। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে অনেক আমেরিকানরা কিন্তু চপ স্টিক (দুই টুকরো কাঠি) দিয়ে খেতে পারে। আমার ধারণা একবার চপ স্টিক দিয়ে খেতে শিখে গেলে খাওয়ার জন্য এটা খুব চমৎকার একটা পদ্ধতি।

আমার কিছু আমেরিকান বন্ধু আমাদের দেখাদেখি হাতে খেতে গিয়ে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তারা আঙুল দিয়ে খাবার মাখিয়ে মুখ পযন্ত নিয়ে গেলেও মুখে সেই খাবার ঢোকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছে। পাঁচটা আঙুল মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে সেখানে খাবারটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে- কাজটা মোটামুটি অসম্ভব। যারা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি, তাদেরকে বলে দেওয়া যায় আমরা কিন্তু মুখের ভেতর আঙুল ঢোকাই না, বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠেলে খাবারটা মুখে ঢুকিয়ে দেই। অত্যন্ত দক্ষ একটা পদ্ধতি।

০৬.
খাবারের কথা বলতে হলেই পানীয়ের ব্যাপারটা তার সাথে সাথে চলে আসে। আমেরিকায় ট্যাপেয় পানি বিশুদ্ধ, তাই পানি কিনে খাবার প্রয়োজন নেই। শুনেছি নিউ ইয়র্কের মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে বলে বিশাল আকারের সফট ড্রিংক বেআইনি করে দেওয়া হয়েছে! তবে এ্যালকোহল জাতীয় পানীয় (সোজা বাংলায় মদ) নিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা যায়। যারা এটা খেতে চায় না, আমেরিকানরা কখনোই তাদেরকে সেটা খেতে জোরাজুরি করবে না। তবে মদ খাওয়া বাঙালিদের কথা আলাদা, তারা নিজেরা সেটা খায় বলে অন্যদের খাওয়ানোর জন্য বাড়াবাড়িতে ব্যস্ত থাকে। বাঙালিদের আসরে তারা অন্য বাঙালিদের জোর করে, তাদের চাপ দেয় এবং না খেলে তাকে নিয়ে টিটকারি-ঠাট্টা তামাশা করে। এর কারণটা কী, আমি এখনো বের করতে পারিনি।

০৭.
খাবার এবং পানীয়ের কথা বলা হলেই এর পরবর্তী ধাপ হিসেবে টয়লেটের কথা বলা উচিত। লোকচক্ষুর আড়ালে এর খুটিনাটি নিয়ে কথা বলা যেতে পারে কিন্তু ছাপার অক্ষরে কিছু লিখে ফেলাটা শোভন হবে না। এই ভয়ঙ্কর বিষয়টা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে, আমরা যেভাবে শিখেছি!

০৮.
ডাইনিং টেবিল আর টয়লেটের পরে নিশ্চয়ই বাথরুমের ব্যাপারটা আসার কথা। নিজের বাসায় নিরিবিলি বাথরুমের মাঝে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু আমেরিকার গণ বাথরুমের মতো ভয়ঙ্কর আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই। আমাকে আগে থেকে কেউ সতর্ক করে দেয়নি, তাই প্রথমবার যখন আমার ডর্মিটরির গণবাথরুমে একজন আমার সামনে জামা-কাপড় খুলে পুরোপুরি ন্যাংটো হয়ে গিয়েছিল, সেই আতঙ্কের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না! এরপর অনেকদিন পার হয়েছে, আমি অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়েছি কিন্তু গণ-বাথরুমে উদাস মুখে শরীরে একটা সূতা ছাড়া সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেই দৃশ্যে আমি কোনোদিন অভ্যস্ত হতে পারিনি। এই জন্মে সেটা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না।ছেলেরা ছেলেদের সামনে এবং মেয়েরা মেয়েদের সামনে জামা-কাপড় পুরোপুরি খুলে ফেলতে কোনো লজ্জা অনুভব করে না, এই ব্যাপারটা কীভাবে সম্ভব হতে পারে আমি কোনোদিন বুঝতে পারব না!

০৯.
আমেরিকার দৈনন্দিন জীবনে পোশাকের ব্যাপারটা সবচেয়ে সহজ, সেটা নিয়ে কেউই মাথা ঘামায় না। যার যা খুশি পরতে পারে, তাই যে যেটা পরে আরাম পায় সেটাই পরে। টি-শার্ট আর জিনস পরে পুরো জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। (হাওয়াইয়ে আমার পরিচিত একজন বাংলাদেশের অধ্যাপক বিরক্ত হয়ে গ্রীষ্মকালে ক্লাস নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন কারণ ছাত্রীরা বিকিনি পরে ক্লাসে চলে আসে। তবে হাওয়াইয়ের কথা আলাদা, মূল ভূখণ্ডে এত বাড়াবাড়ি নেই!) একজন সহকর্মী হঠাৎ করে মারা যাওয়ার পর তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াতে যাওয়ার সময় স্যুট পরে যাওয়া ছাড়া অন্য কখনো আমার স্যুট-টাই পরার সুযোগ হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না! আনুষ্ঠানিক পোশাক পরতে হয় সেরকম জায়গা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু আমার আঠারো বছরের প্রবাস জীবনে সেরকম জায়গায় খুব বেশি যেতে হয়নি। (কী আনন্দের কথা, দেশে ফেরার পর বাকি আঠারো বছরেও আমায় সেরকম জাযগায় যেতে হচ্ছে না।)

১০.
আমাদের দেশে পান খাওয়ার একটি ব্যাপার আছে, তার সাথে জড়িত আছে পানের পিক। পান চিবুতে চিবুতে এদিক-সেদিক পিচিক করে পানের পিক ফেলাটা প্রায় কালচারের অংশ হয়ে গেছে। (কেউ কী আমাদের সদর হাসপাতালগুলোর দেয়ালের কোনাগুলো দেখেছে? মনে হয় সেগুলো তৈরিই হয়েছে পানের পিক ফেলার জন্য!) শুধু পানের পিক নয়, চিপসের প্যাকেট, ঠোঙা, পানির খালি বোতল, চুইংগামের কাগজ, সিগারেটের গোড়া যেখানে-সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়াকে কেউ অন্যায় মনে করে না। বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্টটা হাতে নিয়ে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশে যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠার আগে এই অভ্যাসগুরো বাক্সবন্দি করে দেশে রেখে যেতে হয়। আমেরিকার কোনো রাস্তায় অন্যমনস্কভাবে একটা ঠোঙা ছুঁড়ে ফেলার পর যদি কোনো থুরথুরে বুড়ি সেটা তুলে হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঠিক জায়গায় ফেলতে বলে তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। (দোহাই লাগে, এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হলে কেউ যেন নিজের দেশের পরিচয় দিয়ে দেশের বেইজ্জতি না করে।)

একটা বড়সরো ঢেকুর তোলাটা আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। (আমি শুনেছি কোনো কোনো কালচারাল অনুষ্ঠানে খাওয়া শেষে অতিথিরা ঢেকুর না তুললে সেটাকে অপমান হিসেবে ধরা হয়।) তবে পশ্চিমা দেশে প্রকাশ্য জায়গায় ঢেকুর তোলাটা বন্ধ রাখতে হবে। হাঁচি, কাশি, ঢেকুর এরকম গর্হিত ব্যাপার যদি ঘটেই যায়, তাহলে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে ক্ষমা চাইলে সবাই সেই অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে এই বাক্যাংশটি ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

এই সাথে আরেকটা বাক্যাংশ শিখে নেওয়া ভালো। সেটা হচ্ছে- থ্যাংক ইউ। কোন একটা অজ্ঞাত কারণে আমরা যদি কারও প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ অনুভব করি, তারপরও সেটা মুখ ফুটে বলি না। আমেরিকা গেলে এটা মুখ ফুটে বলা শিখে নিতে হবে। বাক্যংশটি চমৎকার, যে বলে এবং যাকে বলে দু’জনেই এটা থেকে আনন্দ পেতে পারে।

১১.
আমেরিকাতে তরুণ-তরুণীরা (এবং বুড়ো-বুড়িরাও) তাদের ভালোবাসা যথেষ্ট খোলামেলাভাবে প্রকাশ করে। দু’জন তরুণ-তরুণী হাত ধরাধরি করে কিংবা জড়াজড়ি করে হাঁটছে এটা খুবই পরিচিত একটা দৃশ্য। কিন্তু দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের হাত ধরে হাঁটছে এটা মোটেও পরিচিত দৃশ্য নয়। দু’জন তরুণ (কিংবা দু’জন তরুণী) পরস্পরের খুব ঘনিষ্ট বন্ধু হতে পারে কিন্তু কখনোই তারা একে অন্যের হাত ধরে হাঁটবে না। কারণ তাহলে অন্যরা সেটাকে বিশেষ এক ধরণের সম্পর্ক হিসেবে ধরে নেবে! (কোনো লেখায় আমার নাম থাকলে বাচ্চা-কাচ্চারা সেটা পড়ে ফেলে বলে খবর পেয়েছি –তাই এই বিষয়টাকে আর বিস্তৃত করা গেল না!)

১২.
আমার এক ডজন তথ্য এবং উপদেশের শেষটিতে চলে এসেছি। আসলে এখানে যে কথাটি বলতে চেয়েছি, সেটা বলার জন্য উপরের কথাগুলো একটি ভনিতা মাত্র! উপরের ভূমিকাটি শেষ করে এবারে আমি আসল কথাটিতে চলে আসতে পারি।

আমাদের দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও সেগুলোতে সত্যিকার অর্থে গবেষণা শুরু হয়নি (শিক্ষা এবং গবেষণার জন্য সরকার যে পরিমাণ টাকা খরচ করে, সেটা একটা কৌতুকের মতো)।
তাই এই দেশের উৎসাহী ছেলেমেয়েরা প্রতি বছর বাইরে পি.এইচ.ডি. করতে যায়। এদের অনেকে এত উৎসাহী, এত সৃজনশীল, এত প্রতিভাবান যে, তাদের একটা ছোট অংশও যদি দেশে ফিরে আসতো তাহলে দেশে মোটামুটি একটা বিপ্লব ঘটে যেত। কিন্তু তারা আসলে দেশে ফিরে আসে না। আমি আশায় আশায় থাকি, যে কোনোদিন এই দেশের সরকার একটি দুটি ছোট বিষয় নিয়মের মাঝে নিয়ে আসবে এবং আমাদের এই উদ্যমী সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা দেশে ফিরে আসতে শুরু করবে। যতদিন তারা দেশে ফিরে না আসছে, আমার খুব ইচ্ছে তারা অত্যন্ত এই দেশটির কথা তাদের বুকের ভেতরে লালন করুক, এর বেশি আমার কিছু চাইবার নেই।

আমাদের দেশ থেকে যারা লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়ে সেখানে থেকে যায়, তাদেরকে আসলে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ কখনো ভুলতে পারে না যে, তারা এই দরিদ্র দেশটির মূল্যবান সম্পদ ব্যবহার করে লেখাপড়া করেছে। প্রতিদানে তারা দেশকে কিছু দেয়নি। দরিদ্র দেশে প্রায় বিনামূল্যে পাওয়া শিক্ষাটুকু ব্যবহার করে আমেরিকাকে (বা সেরকম কোনো একটা দেশকে) সেবা করে যাচ্ছে। সেজন্য তাদের ভেতর একটা অপরাধ বোধ কাজ করে, তারা সবসময়ই দেশের ঋণটুকু শোধ করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করে।

আরেক ভাগ মানুষ এই অপরাধ বোধ থেকে বের হওয়ার জন্য অত্যন্ত বিচিত্র একটা উপায় খুঁজে বের করেছে। সেটা হচ্ছে- সবকিছুর জন্য নিজের দেশটিকেই দায়ী করা। তারা প্রতি মুহূর্তে দেশকে গালাগাল দেয়। তারা বড় গলায় সবাইকে জানিয়ে দেয়, এই পোড়া দেশে জ্ঞান বিজ্ঞান গবেষণোর সুযোগ নেই, তাদের মেধা কিংবা প্রতিভা ব্যবহারের সুযোগ নেই, এই দেশে জন্ম হওয়াটাই অনেক বড় ভুল হয়েছিল। এখন আমেরিকাতে আসন গেড়ে সেই ভুল সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। নিজের দেশটি কীভাবে রসাতলে যাচ্ছে তার সমস্ত পরিসংখ্যান তাদের নখদর্পণে। দেশের অবিবেচক মানুষ কীভাবে রাজনীতি করে, হরতাল দিয়ে, সন্ত্রাস করে দুর্নীতি করে পুরো দেশটাকে ডুবিয়ে দিচ্ছে, সেটা তারা শুধু নিজেদের মাঝে নয়, বাইরের সবার সাথেও আলোচনা করে সময় কাটায়।

আমার যে ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকা লেখাপড়া করতে যাচ্ছে, তাদের এই স্বার্থপর অংশ থেকে সতর্ক থাকতে বলেছি। সম্ভব হলে একশ হাত দূরে থাকতে উপদেশ দিয়েছি। পৃথিবীতে যত রকম অনুভূতি আছে, তার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি হচ্ছে ভালোবাসা। আর পৃথিবীতে যা কিছুকে ভালোবাসা সম্ভব, তার মাঝে সবচেয়ে সেরা জিনিসটি হচ্ছে মাতৃভূমি। মাতৃভূমিটি যখন সবকিছুতে আদর্শ হয়ে উঠবে শুধু তখন থাকে ভালোবাসব আর যখন সেটা দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণায় জর্জরিত হবে তখন তাকে ভালোবাসব না, সেটা হতে পারে না। যে সব তেভাগারা নিজের দেশকে ভালোবাসার সেই মধুর অনুভূতি কখনো অনুভব করেনি, আমি আজকাল তাদের জন্য করুণাও অনুভব করি না।

আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পি.এইচ.ডি করতে গিয়েছিলাম, তখন আমি ছিলাম সেখানকার একমাত্র বাংলাদেশি (দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে যে ছাত্রীটি এসেছিল, ঝটপট তাকেই আমি বিয়ে করে ফেলেছিলাম!)।
এখন সেই অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমেরিকার যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক বাঙালি আছে, খাঁটি বাঙালি।

মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসী হওয়ার পর বাংলাদেশের সেই মানুষগুলোই হয়ে উঠে পরিবারের মানুষও, হয়ে উঠে আপনজন। সুখে-দুঃখে তারা পাশে থাকে, যখন দেশকে তীব্রভাবে মনে পড়ে তখন এই দেশের মানুষগুলোই তাদের সান্ত্বনা দেয়।

তখন কিন্তু একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সুখে-দুঃখে সার্বক্ষণিকভাবে শুধু বাংলাদেশের মানুষকে নিয়েই সময় কাটাবে, নাকি পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষগুলোর সাথেও একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে? যারা শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের সঙ্গেই গল্প-গুজব, আড্ডা, রাজনীতি কিংবা অনেক সময় দলাদলি করে সময় কাটায়, তারা কিন্তু অনেক বিশাল একটা ক্যানভাসে নিজের জীবনটাকে বিস্তৃত করার একটা চমৎকার সুযোগ হারায়। একটা দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে একটা পৃথিবীর গণ্ডির মাঝে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ কিন্তু অনেক বড় সুযোগ। কেউ যখন প্রথমবার আবিষ্কার করে গায়ের রং, মুখের ভাষা, ধর্ম, কালচার সম্পূর্ণ ভিন্ন হলেও সবাই যে হুবহু একই রকম মানুষ, সেটি অসাধারণ একটি অনুভূতি।

কাজেই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বারবার করে বলেছি, তারা যেন নিজের দেশের মানুষের পাশাপাশি আমেরিকার মানুষদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সম্পর্ক গড়ে তোলে। ভিন্ন কালচারের বৈচিত্রের সৌর্ন্দয্যটা যেন উপভোগ করে। তারা যেন হাইকিং করে, জগিং করে, ক্যাম্পিং করে, হাজার হাজার মাইল ড্রাইভে করে ঘুরে বেড়ায়, গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে বনেট খুলে ঠিক করে ফেলতে শিখে, তারা যেন তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে, সমুদ্রের নিচে স্কুবা ড্রাইভিং করে, ছবি আঁকতে শিখে, গান গাইতে শিখে, মিউজিয়ামে যায়, অপেরা দেখে, কনসার্টে যায় এক কথায় যে বৈচিত্রময় কাজগুলো কখনো করার সুযোগ পায়নি, সেইগুলো করে জীবনটাকে উপভোগ করে। (কেউ কী বিশ্বাস করবে আমার মতো একজন মানুষ পর্বতারোহণের ট্রেনিং নিয়ে আইস এক্স আর ক্লাইমিং রোপ হাতে তুষারে ঢাকা পাহাড়ে উঠে বরফের ওপর ক্যাম্প করে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমিয়েছি? পর্বতের চূড়ায় উঠে উল্লাসিত হয়েছি?)

কোনো কিছু থেকে কী সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে? আগে ছিল না, এখন আছে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র কাজী নাফিসের ঘটনাটি হচ্ছে তার উদাহরণ। এই দেশের যুদ্ধাপরাধীদের চেলাচামুণ্ডারা সেই দেশে আজকাল খুবই সক্রিয়। আমেরিকার সকল সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে তারা শুধু নিজেরা থাকে না, তাদের আগে পিছনের কয়েক প্রজন্মকে সেই দেশে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু দেশটিকে তারা মনে করে কাফেরদের দেশ। ভিন্ন ধর্মের জন্য অবজ্ঞা দেখিয়ে যখন কেউ কাফেরদের দেশে থাকার কলাকৌশল শেখাতে এগিয়ে আসবে, তাদের থেকে সাবধান। ভিন্ন ধর্ম আর ভিন্ন কালচার মানে খারাপ ধর্ম আর খারাপ কালচার নয়। ভিন্ন মানে বৈচিত্র আর বৈচিত্র হচ্ছে সৌন্দর্য্য। এটা যত তাড়াতাড়ি জানা যায়, ততই ভালো। যারা জানে না, তারা নতুন পৃথিবীর মানুষ নয়। তাদের থেকে সাবধান।

আর সেই দেশে দীর্ঘ দিন থেকে লেখাপড়া শেষ করে জীবনকে উপভোগ করে কখনো যদি দেশের জন্য বুক টনটন করে তখন কী করতে হবে?

তখন তারা আবার এই দেশটাতে ফিরে আসতে পারবে। মা যেমন করে তার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে দেশ মাতৃকাও ঠিক সেরকম করে তার সন্তানের জন্য গভীর ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে।

আমি বাড়িয়ে বলছি না –আমি এটা জানি।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। priyo.com

Thursday, September 12, 2013

সম্পাদকরা না বুঝেই বিবৃতি দিয়েছেন : তথ্যমন্ত্রী


মাহমুদুর রহমানের গ্রেফতার ও আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা নিয়ে সরকারের কার্যক্রম খতিয়ে না দেখে, না বুঝে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। ভবিষ্যতে না জেনে মাহমুদুর রহমানের পক্ষে 'ওকালতি' না করার ব্যাপারেও সম্পাদকদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
আমার দেশ পত্রিকা, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ প্রসঙ্গে গত শনিবার দেশের ১৬টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক একটি বিবৃতি দেন। ওই বিবৃতির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন।
ইনু বলেন, 'ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, অশান্তি
তৈরিতে উস্কানি দেওয়া, সাইবার হ্যাকিং কি অপরাধ নয়? এ ধরনের অপরাধীরা কি আইনের ঊধর্ে্ব থাকবে?'
'আমার দেশ' প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, 'সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যেমন অসীম, দায়িত্বশীলতাও তেমনি অসীম। আমার দেশ পত্রিকা ধারাবাহিকভাবে সেই দায়িত্বশীলতাকে গুরুত্ব দেয়নি। পত্রিকা ও পত্রিকাটির সম্পাদক 'হ্যাকিং' বা চুরি করা এবং মিথ্যা-উস্কানিমূলক সংবাদ ও ছবি ছেপে দেশে নৈরাজ্য ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে, উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে পত্রিকাটি। এসব কাজ ফৌজদারি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনবিরোধী অপরাধ। মন্ত্রী বলেন, সুনির্দিষ্ট অপরাধে দায়ের করা মামলার ভিত্তিতেই আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের সমালোচনা এবং ভিন্ন মতাদর্শী হওয়ার কারণে আমার দেশের সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়নি।
মন্ত্রী দাবি করেন, এই সরকারের আমলে সংবাদমাধ্যম সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য কখনও কাউকে বাধা দিচ্ছে না সরকার।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দৈনিক 'আমার দেশ', দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, এর সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সম্পর্ক নেই। তাই মাহমুদুর রহমানের মতো কলঙ্কজনক ব্যক্তির পক্ষে সাফাই গাওয়া সংবাদপত্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এতে গণমাধ্যমকর্মীদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
আমার দেশের ছাপাখানা বন্ধ প্রসঙ্গে ইনু বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকলেও পত্রিকাটি ছাপাতে আইনগত কোনো বাধা নেই এবং বৈধ অনুমতি নিয়ে অন্য ছাপাখানায় তা ছাপাতে পারে।
মন্ত্রী বলেন, 'তথ্যপ্রযুক্তি আইন অনুসারে পত্রিকাটির ছাপাখানায় তল্লাশি চালানো হয় এবং সেখানে অপরাধ সংঘটিত করার যন্ত্রপাতি ও হ্যাকিংয়ের প্রমাণাদি জব্দ করা হয়েছে এবং ছাপাখানা তালাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিচারকাজের স্বার্থে যতক্ষণ পর্যন্ত তদন্ত শেষ না হবে, ততক্ষণ পত্রিকার ছাপাখানা বন্ধ থাকবে।'
মাহমুদুর রহমান তার মাকে নিয়েও জালিয়াতি করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'অন্য ছাপাখানা থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের যে নিয়ম রয়েছে দৈনিক আমার দেশ তা পালন করেনি। যে কারণে দৈনিক সংগ্রামের ছাপাখানা আল-ফালাহর বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মাহমুদুর রহমানের মাকে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান দেখিয়ে সত্য গোপন করে সংগ্রাম পত্রিকার ছাপাখানা থেকে তারা পত্রিকা প্রকাশ করেছে।'
তথ্যমন্ত্রী বলেন, দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের বিরুদ্ধে সরকার কোনো মামলা করেনি। তাদের কারণ দর্শানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তারা চিঠির জবাব দিয়েছে। জবাব সন্তোষজনক হলে চ্যানেল দুটি আবার সম্প্রচারে যেতে পারবে।
১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের বিস্ময়
আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের বিবৃতিতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল সম্মিলিত সাংস্কৃৃতিক জোটের নির্বাহী সদস্য হানিফ খান স্বাক্ষরিত এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সাম্প্রায়িক সম্প্রীতি, প্রগতি ও মানবাধিকারের কথা বলা হলেও শুধু পেশাগত ঐক্যের কারণে এসব আদর্শে বিরোধিতাকারী, রাষ্ট্রীয় আইন ও শান্তি ভঙ্গের উস্কানিদাতা মাহমুদুর রহমানের পক্ষে দেশের কয়েকজন বরেণ্য সম্পাদকের বিবৃতি প্রদানে আমরা বিস্মিত, হতবাক ও মর্মাহত হয়েছি। বিবৃতিতে শুধু পেশাগত ঐক্য নয়_ মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, প্রগতি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের দৃঢ় অবস্থান প্রত্যাশা করা হয়। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক অনুপম সেন, চিত্রশিল্পী হাশেম খান, কবি নির্মলেন্দু গুণ, নাট্যকার মামুনুর রশীদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ, নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান, শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, গোলাম কুদ্দুছ ও মুহাম্মদ সামাদ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের বিস্ময়
মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করে ১৬ সম্পাদকের প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বিস্ময় ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম। রোববার এক বিবৃতিতে ফোরাম নেতৃবৃন্দ মাহমুদুর রহমানকে 'সংবাদপত্রের গণশত্রু' আখ্যা দিয়ে বলেন, আমরা বিস্মিত, মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) কেএম সফিউল্লাহ বীরউত্তম, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. কামরুল ইসলাম খান রোববার এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পবিত্র কাবা শরিফ এবং মৃত্যুদ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চাঁদে দৃশ্যমান_ এরকম সংবাদ ও ছবি প্রকাশ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে দেশকে সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার হীনউদ্দেশ্যে এ পত্রিকাটি ক্রমাগত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ পরিবেশন করে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা ও অগি্নসংযোগে নিরীহ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করে। আমরা মনে করি, পরিকল্পিতভাবে সামাজিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী এমন একজন সম্পাদককে গ্রেফতার ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করা যে কোনো দায়িত্বশীল সরকারের অবশ্য করণীয়।
তারা বলেন, ১৬ সম্পাদকের মধ্যে প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন সম্পাদকের সঙ্গে কতিপয় প্রগতিবিরোধী ও ধর্মীয় মৌলবাদী রাজনীতির পৃষ্ঠপোষক সংবাদপত্রের সম্পাদকের নাম দেখে আমরা মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ। আমরা আশা করব, দেশপ্রেমিক সম্পাদকরা এ ব্যাপারে তাদের সুবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত নেবেন।

সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি- মনজুরুল আহসান বুলবুল



গত ১৮ই মে দেয়া ১৫ জন সম্পাদকের বিবৃতি ‘সম্ভবত কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করেছে বলে বিবৃতিদাতা সম্পাদকরাও মনে করছেন। সে কারণেই কৈফিয়ত না দিলেও বিবৃতি দেয়ার কারণটি আবার ব্যাখ্যা করে বলতে হচ্ছে।

বলে রাখি; সম্মানিত সম্পাদকগণ যে বিবৃতি দিয়েছেন; গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী একজন সাংবাদিক হিসেবে তা সমর্থন করি। যারা মনে করেন মাহমুদুর রহমান সম্পাদক নন তাদের সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করি। দেশের প্রচলিত আইন যেমন সম্পাদক হওয়ার কোন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়নি, আবার কাউকে বারিতও করেনি। মাহমুদুর রহমানকে কেউ ‘‘হঠাৎ সম্পাদক” বলে সন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু তিনি একজন সম্পাদক বটে। সরকার, সচেতন সম্পাদকমণ্ডলী বা সাংবাদিকদের ইউনিয়ন কেউ এখনও এমন একটি বিধি-আইন-নীতিতে একমত হতে পারেননি যে একটি গণমাধ্যমের সম্পাদক হওয়ার মাপকাঠি কি। প্রভাব থাকলে সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের লাইসেন্স পাওয়া যায়, মালিক তো হওয়া যায়ই, প্রিন্টার্স লাইনে নাম লিখে সম্পাদকও হওয়া যায়। বলতে খচ্ খচ্ করলেও সত্যি হচ্ছে, ডিক্লারেশনপ্রাপ্ত একটি সংবাদপত্রের প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম প্রকাশিত হচ্ছে তারা সকলেই সম্পাদক। তবে মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে বিবৃতি দিয়ে ১৫ জন সম্পাদক নতুন কোন বন্ধুর সন্ধান পেয়েছেন কিনা তা তারাই বলতে পারবেন কিন্তু এই পঞ্চদশের অনেকেই যে তাদের অনেক পুরনো বন্ধুদের বিশ্বাসের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়েছেন সে তো নানাভাবেই দৃশ্যমান।

কেন এ বিভ্রান্তি? সাধারণের প্রশ্ন ও পর্যবেক্ষণগুলো এরকম:
১. কেন ১৫ জন সম্পাদক, কেন আরও বেশি নয়? যে ১৫ জন সম্পাদক বিবৃতি দিয়েছেন তাদের মতোই আরও যে সম্পাদকদের আমরা সম্মান করি তারা কেন এই বিবৃতিতে সই করলেন না? মানেটি হচ্ছে: কিছু সম্পাদক আছেন যারা এই ১৫ জনের মতকে ধারণ করেন না; কাজেই তারা এই পঞ্চদশের সঙ্গে নেই।

২. বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মালিক-সম্পাদকদের পুরনো সংগঠন বাংলাদেশ সংবাদপত্র পরিষদ- বিএসপি। কিন্তু কিছুদিন আগে একটি সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছে; নিউজ পেপার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ- নোয়াব। এই সংগঠন আমন্ত্রণমূলক, সম্মানিত কয়েকজন মালিক সম্পাদক এই সংগঠনটি গড়ে তুলেছেন; তারা যাদের আমন্ত্রণ জানাবেন তারাই কেবল এই সংগঠনের সদস্য হতে পারবেন। সাধারণভাবে সকল মালিক বা সম্পাদক তাদের সদস্য হতে পারেন না। কিন্তু মজার বিষয়টি হচ্ছে; এই বিবৃতিতে নোয়াব এবং অ-নোয়াব একাকার হয়েছে। অর্থাৎ নোয়াব যে সম্পাদকদের তাদের সদস্য হওয়ার যোগ্য মনে করেন না; এই বিবৃতিতে তারাই হয়েছেন নোয়াবের সদস্যদের সহযোদ্ধা। অন্যদিকে নোয়াব-এর তিনজন সদস্য এই বিবৃতিতে সই করেন নি। মানুষ বিভ্রান্ত হবে না কেন?
৩. বিবৃতিদাতাদের অন্তত একজন সম্পাদক বিবৃতিদাতা অপর দু’জন সম্পাদক সম্পর্কে সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘন করার দায়ে প্রেস কাউন্সিলে মামলা করেছেন, রায়ও তার পক্ষেই গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাংবাদিকতার নীতিমালা লঙ্ঘনকারী দুই সম্পাদক এই বিবৃতিতে এক কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারী সম্পাদকের সঙ্গে। মামলার ফরিয়াদি ও প্রতিপক্ষ একই কাতারে। বিস্ময় এখানেও।

৪. বিবৃতিদাতা সম্পাদকদের দু’জন এমন একটি পত্রিকার সাবেক ও বর্তমান সম্পাদক যে পত্রিকা থেকে ভারতীয় অর্থপুষ্ট সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল কিছুদিন আগে। সেই তালিকায় বিবৃতিদাতা একজন প্রভাবশালী সম্পাদক ভারতীয়দের কাছ থেকে কত টাকা নেন তা-ও উল্লেখ ছিল। নৈতিকতাহীন ও চরম দায়িত্বহীন সেই সংবাদপত্রের সঙ্গে অপূর্ব সম্মিলনী দেখা গেল দায়িত্বশীল ও উৎকৃষ্ট সাংবাদিকতার সেই সম্পাদককেও। হোঁচট এখানেও।

নানা বৈচিত্র্যের মধ্যেও বিবৃতিদাতাদের এই একতা একদিকে যেমন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে, তেমনি নানা প্রশ্নেরও সৃষ্টি করেছে। বিবৃতিদাতা একজন সম্মানিত সম্পাদক লিখছেন; মাহমুদুর রহমানকে অনেকগুলো অভিযোগে মাসখানেক ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছে যে অভিযোগগুলো আদালতে প্রমাণিত হয়নি। গূঢ়ার্থ হচ্ছে: আদালতে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে অভিযোগ থাকলেও কাউকে আটকে রাখা যাবে না। যদি এই যুক্তিতেই এখন বিজিএমইএ রানা প্লাজার আটক গার্মেন্ট মালিক বা প্রকৌশলীদের কোন সমিতি সেই ভবনের নকশা অনুমোদনকারী বর্তমানে আটক প্রকৌশলীদের মুক্তি দাবি করেন? কারণ এখনও তো তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি। বিবৃতিদাতাদের এই যুক্তি মেনে নিলে তো গোলাম আযম, নিজামী সবাইকে ছেড়ে দিতে হয়। আদালতে ‘গিলটি’ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত তো তারা ‘ইনোসেন্ট’ !

এ বিবৃতি নিয়ে মাননীয় তথ্যমন্ত্রী সম্মানিত সম্পাদকদের প্রজ্ঞার প্রতি যে প্রশ্ন তুলেছেন তারও প্রতিবাদ জানাই। বিবৃতিদাতা সম্পাদকগণ গত কয়েক দশক ধরে দেশ, উপমহাদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির নিবিড় পর্যবেক্ষক। কাজেই না জেনে-বুঝে তারা এই বিবৃতিতে সই করেছেন এমন সহজ সমীকরণ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন এই বিবৃতি দিয়েছেন তার পক্ষেও যেমন এই সম্পাদকদের দৃঢ় যুক্তি রয়েছে, যদি তারা বিবৃতি না দিতেন তাহলেও তারা সফলভাবেই সেখানেও যৌক্তিক অবস্থান তুলে ধরতে পারতেন। যে সম্পাদকরা বিবৃতিতে সই করেননি তারাও নিশ্চয়ই যৌক্তিক কারণেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন, সরকারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী হিসেবে সকল বিষয়ে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে যথাসময়ে প্রেস নোট কেন দেয়া হচ্ছে না? স্বয়ং মন্ত্রীর প্রেস ব্রিফিং তো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিবৃতিতে পরিণত হয়। সরকারি প্রেস নোট বিষয় ভিত্তিক সরকারি ব্যাখ্যা তুলে ধরে; হতে পারে সরকারি প্রেস নোট ছলনাময়ীর প্রেমের মতোই মিথ্যা কিন্তু সরকারের অবস্থান স্পষ্টকরণের জন্য এই অন রেকর্ড সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রথাটি পৃথিবী জুড়েই স্বীকৃত। পদ্ধতিটি ভিন্ন হতে পারে।

তবে এত বৈপরীত্য, নানা বৈচিত্র্যের একতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ও বিভ্রান্তির মধ্যেও এই সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতিতে আমরা আশান্বিত হতেই পারি। কারণ সব কিছু ভুলে অভিভাবকের মতো তারা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে অধিকার তা রক্ষায় এগিয়ে এসেছেন। এই রকম অভিভাবক দেশের গণমাধ্যম জগতের দীর্ঘদিনের চাহিদা। একসময়ের প্রভাবশালী সাংবাদিক ইউনিয়ন এখন সেই ভূমিকা কতটা রাখতে পারছে সে প্রশ্ন উঠেছে অনেক দিন আগেই। অনেকে সাংবাদিক ইউনিয়নের ঐক্য নিয়ে আশাবাদী হন। কিন্তু এই ঐক্য তো শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার ঐক্যের মতোই কঠিন। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা যদি হন এক ইউনিয়নের নেতা আর শেখ হাসিনার টিকিট নিয়ে তার দলের এমপি প্রার্থী যদি আরেক ইউনিয়নের নেতা হন তা’হলে এই দুই ইউনিয়নের মধ্যে নেহায়েৎ অর্থনৈতিক দাবি ছাড়া আর কোথাও ঐক্যের জায়গা তো দেখি না। তার ওপর আবার এক শীর্ষ নেতা এখন লিখিতভাবে নসিহত করছেন যে, নারী সাংবাদিক ও সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের রিপোর্টারদের যেন স্পর্শকাতর বিষয়ে এসাইনমেন্ট দেয়া না হয়। তারপরেও রুটি-রুজির সংগ্রামে সাংবাদিক ইউনিয়নই তো আমাদের ভরসা। এর পাশাপাশি সম্মানিত সম্পাদকগণ যদি পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষায় এক হয়ে এগিয়ে আসেন তা তো আশারই কথা। কিন্তু হতাশা সব সম্পাদকও এখানেও এক হতে পারলেন না।

সে কারণেই আশাজাগানিয়া এই উদ্যোগ নিয়ে একটু হতাশা আছেই। সম্মানিত সম্পাদকদের বিবৃতি প্রসঙ্গে একজন সম্পাদকের ব্যাখ্যায় [দৈনিক সমকাল, ২৪শে মে ২০১৩] যে প্রেক্ষাপট ও বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে, ১৫ জনের বিবৃতিতে একটি প্যারাগ্রাফেও যদি সেই বর্ণনাটি তুলে ধরা হতো তা’হলেও বিবৃতিদাতারা এতটা প্রশ্নবিদ্ধ হতেন না একথা বলা যায়। জানি না দৈনিক সমকাল সম্পাদকের অবস্থানটি সকলেই সমর্থন করেন কিনা। বিবৃতি দেয়ার প্রেক্ষাপটটির ন্যূনতম বর্ণনা না থাকায় বিবৃতিটি দাতাগোষ্ঠী এবং দূর থেকে উদ্বিগ্ন মানবাধিকার রক্ষাকারী গোষ্ঠীর বিবৃতির মতোই মনে হয়েছে।
প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করেছিলেন সে সময়কার তরুণ শিক্ষার্থী পরে জগৎখ্যাত ইতিহাসবিদ, অক্সফোর্ডের শিক্ষক, বাংলাদেশেরই ‘বরিশালের পোলা’ তপন রায়চৌধুরী। তাঁর ‘বাঙালনামা’য় তিনি লিখেছেন: “... (সেই দাঙ্গার সময়কার বর্ণনা) একজন কোথা থেকে একটা চোথা খবরের কাগজ নিয়ে এল যার নাম আগে বিশেষ শুনিনি। লোমহর্ষক সব কাহিনীতে ভরা ওই কাগজটির বিক্রি নাকি তিন দিনে বেশ কয়েক হাজারে দাঁড়িয়েছিল। এবং তার অসাধারণ কল্পনাশক্তির অধিকারী সম্পাদকটি শুনেছি সমস্ত কাগজখানা নিজের বৈঠকখানা ঘরে বসে লিখতেন। বাইরে বের হওয়া তখন নিরাপদ ছিল না। আর দাঙ্গার আগে ওই কাগজটির যা বিক্রি তাতে সম্পাদক ছাড়া অন্য কোন কর্মচারী রাখার মতো সামর্থ্য বা প্রয়োজন হয়েছে এমন মনে হয় না। এখন ওই বিরল প্রতিভাটি সম্পূর্ণ নিজের মস্তিষ্ক থেকে কলকাতার কুরুক্ষেত্রের ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। ওই বজ্জাতের মনোভূমি কলকাতার রাস্তার চেয়ে দাঙ্গার জন্মস্থান হিসেবে সত্যের আঁকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রাতারাতি ওই চোথা পত্রিকাটি স্মৃতিশ্রুতির স্থান অধিকার করলো। শহরের সর্বত্র কি ঘটছে না ঘটছে তা ওই অশ্লীল নির্জলা মিথ্যা কথায় ভরা প্রকাশনাটি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে সবাই আলোচনা করতে লাগলো। যদি প্রশ্ন করা হতো এসব যে সত্যি তা তোমরা কি করে জানলে, তাহলে লোকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বাক্যালাপ বন্ধ করে দিতো। ... ওই বিষাক্ত পত্রিকাটির কপি এখন আর পাওয়া যায় না। নগণ্য একটি প্রকাশন মিথ্যা প্রচারের মারফত কত অনিষ্ট করতে পারে, বাঙালির দুর্ভাগ্যের বিবরণীতে সে ইতিহাস অলিখিত রয়ে গেল।” -বাঙালনামা, তপন রায়চৌধুরী, আনন্দ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, আগস্ট ২০০৭, পৃষ্ঠা ১৫২)

কোন মন্তব্য নেই, শুধু একটিই জিজ্ঞাসা। বিবৃতিদাতা সম্মানিত সম্পাদকবৃন্দ তপন রায়চৌধুরী বর্ণিত দৃশ্যপটের সঙ্গে সামপ্রতিক বাংলাদেশের কোন মিল খুঁজে পান কিনা? কোন চরিত্রের কোন খোঁজ পান কিনা? জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর বলে এই পরিস্থিতি ও চরিত্রগুলো সম্পর্কে বরেণ্য সম্পাদকদের মতামত এবং অবস্থান কি সে প্রশ্ন তো কেউ করতেই পারেন।

এই বাস্তবচিত্র মাথায় রেখেই তবুও আশাবাদী হতে চাই এ কারণে যে, সাংবাদিকতা পেশার অভিভাবকরা যখন একসঙ্গে মাঠে নেমেছেন তখন বোধ করি এই শিল্প ও পেশার জন্য কিছু একটা হবে। প্রত্যাশা; মালিক ও পেশাদার সম্পাদকের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে সম্পাদকগণ দেশের গণমাধ্যমের সঙ্কটের এই সময় দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা রাখবেন। তাদের কাছে এই প্রত্যাশা এ কারণেই যে, একজন সম্পাদককে সাংবাদিকরা জানেন পেশায় তাদের অভিভাবক হিসেবেই। নষ্ট সন্তান বিপদগ্রস্ত হলে তার মুক্তি চাওয়াই যথেষ্ট নয়, সন্তান যাতে ভ্রষ্ট না হয় তা দেখার দায়িত্বও অভিভাবকদের। সংবাদপত্রের ডিক্লারেশন বা টেলিভিশনের লাইসেন্স নেয়ার আবেদনে এক এক জন মালিক সরকারের কাছে ‘আপনার বিশ্বস্ত’ বলে সব শর্ত মেনে নেয়ার মুচলেকা দেবেন আর লাইসেন্সটি পাওয়ার পর পরই মাথায় স্বাধীনতার শিং গজাবে? যে পণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স নেয়া হলো দোকান খুলে- সেখানে লাইসেন্সের শর্ত ভেঙে ভিন্ন পণ্য বিক্রি করলে এবং তার পরিণতিতে দোকান বন্ধ হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে? একটু পেছনে দেখুন... বাংলাদেশে যে সব গণমাধ্যম বিপদগ্রস্ত হয়েছে তা হয়েছে শুধু মালিকদের অপরিণামদর্শিতার কারণেই। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কোন সাংবাদিকের পেশাগত কোন কারণে বাংলাদেশে কোন গণমাধ্যম বন্ধ হয়নি। সব জেনে শুনে, আইন ভাঙবেন মালিকরা আর বিপদগ্রস্ত হবেন পেশাজীবী সাংবাদিক কর্মচারীরা- এ যেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের ভাগ্যলিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতই সাহসী সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কোন গণমাধ্যম, সম্পাদক বা সাংবাদিক আক্রান্ত হলে সম্পাদক বা সাংবাদিকরা একযোগে প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু খুব অল্প ক্ষেত্রেই এমন বাস্তবতা পাওয়া গেছে।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা আর নৈতিকতার মাপকাঠি পৃথিবী জুড়েই আজ একটি দৃশ্যমান জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখন আলোচিত হচ্ছে কারা সাংবাদিক, কারা নন- সে প্রশ্ন নিয়ে। বিতর্ক হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর সনাতনী গণমাধ্যমের সম্পর্কটি কোথায় এসে মিলবে (স্মরণ করিয়ে দিতে চাই: বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দৃশ্যত ব্যাপক বিসতৃত, বিবৃতিদাতা বা মধ্যরাতের টকশো কাঁপানো অনেক সম্পাদকের সংবাদপত্রের প্রচার সংখ্যার চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অনেক যোগাযোগ কর্মীর অনুসারীদের সংখ্যা অনেক অনেকগুণ বেশি ও কার্যকর)।
সাংবাদিকতায় প্রযুক্তির অতিব্যবহার এই পেশার মানবিকতাকে কতটা প্রশ্নবিদ্ধ করছে, সংবাদের তাৎক্ষণিকতার প্রতিযোগিতা সাংবাদিকতা কত সত্যকে হত্যা করছে, সমাজে সাংবাদিকতার অতি প্রভাবের ক্ষমতা কোন কোন গণমাধ্যমকে কিভাবে দানবে পরিণত করছে, সমপাদকদের অতিমাত্রায় বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের চাপ রিপোর্টারকে বেশি বিপজ্জনক জায়গায় ঠেলে দিচ্ছে কিনা এ সব প্রসঙ্গ নিয়ে আলোড়িত এখনকার গণমাধ্যমের শিক্ষা ও গবেষণার জগৎ। গণমাধ্যমের এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে গণমাধ্যমকেই এবং তাতে নেতৃত্ব দেবেন অভিভাবক সম্পাদকরাই।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে অনেক অভিভাবককে নিয়েই প্রশ্ন তোলা যায়। এ কারণে কিছুকাল আগে একজন স্বনামখ্যাত সম্পাদক তার বক্তব্যে দাবি জানিয়েছিলেন সম্পাদকদেরই প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। কিন্তু অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ দেবে কে? তবুও শেষ পর্যন্ত অভিভাবকদের প্রতিই আস্থা রাখতে হবে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিবৃতি আমাদের সম্পাদকদের বিভক্তির চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি যে অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ- দেশের গণমাধ্যমের চেহারায় গুণগত পরিবর্তন আনতে সকল সম্পাদকের একসঙ্গে এগিয়ে আসা। সাংবাদিক ইউনিয়নের বিভক্তি এবং ইউনিয়নের কতিপয় শীর্ষ নেতার অতিমাত্রার রাজনৈতিক চেহারা যত হতাশাই ছড়াক ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেবে রুটি-রুজি আর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর পেশাদার সম্পাদকরা দেবেন পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের নেতৃত্ব। এই যৌথ উদ্যোগ দিয়েই অনেক সঙ্কট অতিক্রম করা যাবে।

সর্বশেষ খবর: সম্মানিত সম্পাদকগণ একটি সংগঠন গড়ে তুলেছেন। খুবই আশার কথা, এই সংগঠন নিশ্চয়ই সংবাদ মাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা, পেশাগত মানোন্নয়ন এবং সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখবে। কোন সম্পাদকের অপেশাদারিত্বের কারণে কারও জীবন ও সম্মান বিপন্ন হলে সেদিকটাও এখন দেখতে হবে এই পরিষদকে (অপেশাদারী সম্পাদকের কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যে তরুণরা বিপন্ন জীবন যাপন করছেন তারা নিশ্চয়ই কথা বলার একটি জায়গা পেলেন)।
এই সংগঠন যাতে কোন অপেশাদার ও সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি অনুসরণ করেন না এমন কোন সম্পাদকের আশ্রয়স্থল না হয়। তবে শেষতক মালিক-প্রকাশক-সম্পাদক আর পেশাদার সম্পাদকের দ্বন্দ্বটা রয়েই গেল। নবগঠিত সম্পাদক পরিষদের অনেক নেতাই ওয়েজবোর্ডে মালিক হিসেবেই প্রতিনিধিত্ব করছেন।

আবারও বলি: বিবৃতি দিয়ে ১৫ সম্পাদক কতটা অর্জন করেছেন তার মূল্যায়ন হয়তো একদিন হবে কিন্তু তাদের দীর্ঘদিনের পেশাগত জীবনের ধারাবাহিকতার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই যে হোঁচট খেয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বিবৃতিদাতা অনেক সম্পাদকই যেহেতু অভিভাবকতুল্য- সে জন্যই প্রত্যাশা করি তারা যেন হঠাৎ করে আমাদের কাছে অচেনা না হয়ে যান। অভিভাবকরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে পরিবারের নিষ্ঠাবান সদস্যরাও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন, সে জন্যই এই রচনা। আশা করি, এই রচনায় তারা বিরূপ হবেন না। এই ধৃষ্টতার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।

মনজুরুল আহসান বুলবুল, সাংবাদিক

Sunday, September 8, 2013

দুই দেশের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থেই চাই ছিটমহল বিনিময়-সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


http://www.banglanews24.com/categorizednews.php?newtype=32
৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক।

Saturday, September 7, 2013

আমাদের বিবেকভ্রষ্ট বুদ্ধিজীবি-দেলোয়ার হোসেন



অতীতের কথা বাদ দিলাম । বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকারের গৃহীত কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ , আহ্বান , অনুরোধকে বিএনপি কখনও শুধু পাত্তাই দেয়নি , উপরন্তু তাকে সব সময় বাকা চোখেই দেখে আসছে এবং সেসব ক্ষেত্রে কোমর বেঁধে তীব্র সমালোচনায় অবতীর্ণ হয়েছে । উদাহরণ হিসেবে সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংস্কার সহ গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য বিষয় রয়েছে । আওয়ামীলীগ যেখানেই হাত দেয় বিএনপি সেখানেই ষড়যন্ত্র, দুরভিসনধের গন্ধ খুঁজে পায় এবং আমলে নেয়ার অনুপোযুক্ত ও অচ্ছুত বলেই উপস্থাপিত বিষয়গুলোকে স্বভাব সুলভ নিয়মে কালিমালিপ্ত করে বসে । অর্থাৎ আওয়ামীলীগের কোন কিছুই ভাল না । এমনকি যে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেটাও তারা স্বীকার করে না , স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেও কোন ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে মুল্যায়ন করে না । তারা বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে জিয়াকেই স্বাধীনতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেস্টায় নিরন্তর লিপ্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরনের দিবসে পৈশাচিক জন্মোৎসব পালন করে সহজাত ঘৃণা ও তীব্র প্রতিহিংসার বহিপ্রকাশ ঘটিয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকেই । সুতরাং শত্রুর অবস্থানে থেকে মনে প্রাণে জিঘাংসায় ব্রতী হলে প্রতিপক্ষের কোন কিছুকেই ইতিবাচক বলে গ্রহণ করা যায় না । তাই বলা হয়, যারে দেখতে নারি , তার চলন বাঁকা । ঠিক একই অবস্থানে রয়েছে আমাদের বাংলাদেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ । তারাও আওয়ামীলীগের কোন ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রশংসা তো দূরে থাক, ফাঁকফোকর খুজে বের করে দলটিকে সর্বদাই আসামীর কাঠগড়ায় দাড় করাতে যেন সিদ্ধহস্ত। বিএনপির কলংকময় অতীত , নজিরবিহীন অপকর্ম নিয়ে তারা মোটেও টু শব্দটিও করেন না। শুধু কি তাই স্বাধীনতা কিংবা বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ এলে জাতির পিতার সম্বোধন দূরে থাক, এই বুদ্ধিজীবিদের অনেকেই বঙ্গবন্ধু নামটি মুখে উচ্চারন করতে কুন্ঠা বোধ এবং শেখ মুজিব সম্বোধনেই বেশি স্বস্তি বোধ করেন । তাদের ভয় থাকে একটাই যাতে গায়ে বিশেষ শিবিরের সিল না লেগে যায় । এছাড়া আওয়ামীলীগ বা সরকারের সমালোচনা এবং বিরোধী দলের অযৌক্তিক দাবির পক্ষে দ্রুত অবস্থান নিয়ে একজোট হয়ে সর্বত্র কথা বলে জনমতকে প্রভাবিত করার এদের একটা অপচেস্টা এখন মোটা দাগে চোখে পড়ার মত একটি নৈমিত্তিক বিষয় বা রুটিন ওয়ার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে । যদি দুই নেত্রীর মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠান এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল প্রসঙ্গে আলোকপাত করি তাহলে দেখা যাবে, হাজার মুনীর হাজার মত । তবে সব শেয়ালের এক রা এর মতই মুল কথা একটাই, বিরোধী দলের দাবিটিই যৌক্তিক । এ প্রসঙ্গে সংলাপ বিষয়ে একটি উদাহরন দেই । কদিন আগে চ্যানেল আই এ টক শো তৃতীয় মাত্রা দেখছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের একজন শিক্ষক, এক সময় যে বিভাগের ছাত্র আমি নিজেও ছিলাম তাই, যাকে নিয়ে গর্ব বোধ করছিলাম , সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি তার একটি মন্তব্য বা মুল্যায়নে আমি এতটাই হতাশ হই যে এই ধরনের বুদ্ধিজীবিদের কথা শোনার আগ্রহ এখন একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি । দুই নেত্রীর সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, যেহেতু খালেদা জিয়াকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাই তার মনের ভেতর ক্ষোভ এবং প্রতিহিংসা তুষের আগুনের মত জ্বলছে এবং তা সহজে নেভার মত নয় । আর অপরদিকে ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মত ঘটনাটি শেখ হাসিনারও সহজে ভোলার কথা নয় । তাই দুই নেত্রীর মুখ দেখাদেখি এবং সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রধাণ বাধাই হলো এটি । আমি আশ্চর্য হলাম ! কি চমৎকার সরলিকরন ! কি অদ্ভুত সমীকরন এইসব নমস্য বুদ্ধিজীবিদের । যে নেত্রী প্রতিপক্ষ নির্মূলে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ তার পার্টির জন্মলগ্ন থেকেই। জাতির জনকের হত্যার সাথে যে দলের পূর্বসূরী কান্ডারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং খুনীদের করেছে পুরস্কৃত এবং যে দল সেই খুনীচক্র এবং স্বাধীনতা বিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব , গনতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিপক্ষে তৎপর থেকে জাতির সব অর্জনগুলোকে নস্যাত করার কাজে লিপ্ত – সেই বিষয়গুলো তার বিবেচনা এবং মুল্যায়নে স্থান পায়নি এতটুকু । বিবেচনায় আসেনি এই দলের ঐতিহাসিক সুমহান কীর্তি এবং বর্তমানের যুগান্তকারী ইতিবাচক অর্জন ও তার সহনশীল রাজনীতি যার উল্টো পথে সব সময় চলেছে বিএনপি । বিএনপির এসব সুকীর্তির কথা তারা কখনই উল্লেখ করেন না । যত দোষ নন্দঘোষ, তার জন্যে প্রকৃষ্ট উদাহরণ একমাত্র আওয়ামীলীগই । কেবল মাত্র বাড়ি উচ্ছেদের ঘটনা দিয়েই বিএনপি নামক দলটির সকল পৈশাচিক অপকর্ম জায়েজ করে দিলেন এই বুদ্ধিজীবি তার মুল্যায়নে ! পাড়া-গ্রামে একটা প্রবচন আছে, কিসের মধ্যে কি পান্তা ভাতে ঘি । এই বুদ্ধিজীবির মূল্যায়নটাও হয়েছে ঠিক তেমনই।

এবার আসা যাক নির্বাচন প্রসঙ্গে । এই গুণী শিক্ষকের রয়েছে দেশে-বিদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করার একটি এনজিও সংস্থা । যিনি এ বিষয়ে একজন এক্সপার্ট । এ পর্যন্ত বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের আমলে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সিংহ ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধীদল বিএনপিই জয়লাভ করেছে। সর্বশেষ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে—যেখানে তারা শতভাগ সাফল্য অর্জন করেছে সেক্ষেত্রে এবং এর আগের প্রতিটি নির্বাচনে দেখা গেছে বিএনপি তার স্বভাবসুলভ বিকৃত মিথ্যাচার করে বলেছে, ব্যাপক কারচুপির নির্বাচনের নীল নকশা সরকার আগে থেকেই করে রেখেছে। ফলাফলও সরকার নির্ধারণ করে রেখেছে । কিন্তু বিএনপির সুরের সাথে সুর মিলিয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজও পক্ষপাতমূলক নেতিবাচক পূর্বাভাস ব্যক্ত করেছিল এবং সেনাবাহিনী মোতায়েন না করার বিষয়ে উভয় পক্ষ (বিএনপি এবং সুশীল) একযোগে যে মনগড়া আশংকা প্রচার করছিল তার কোনোটাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি । এমনকি জয়লাভের পরেও বিএনপি তার বদ খাসলত অনুযায়ী বার বারই বলেছে সরকার ব্যাপক কারচুপি করেও বিএনপির বিজয় ঠেকাতে পারেনি । সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন আসে , এইসব নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সুশীলবেশধারী বুদ্ধিজীবি এবং গায়ে সিলমারা শ্রেনীবদ্ধ সুশীলরা একবারও ভুল করে বলছেন না , বিএনপির আমলে বিপন্ন হওয়া প্রশাসন এবং সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে (যেমন, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ) সাংবিধানিক নিয়ম- শৃঙ্খলার প্রবর্তন এবং সেগুলোকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর এবং শক্তিশালীভাবে গড়ে তোলার যে কাজ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার করে যাচ্ছে তার ইতিবাচক ফল ও সুদুরপ্রসারী প্রভাবের কথা । এখনও তারা বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের পক্ষেই তুলছেন সোচ্চার আওয়াজ । অথচ এই বিএনপিই নজিরবিহীন অপকর্মের মধ্য দিয়ে ধ্বংস ও কালিমালিপ্ত করেছিল এই ব্যবস্থাকে । এটা বেমালুম ভুলে গিয়ে আবারও সেই অগণতান্ত্রিক ও পরিত্যক্ত ব্যবস্থাকেই পুনর্বহালের জন্যে প্রাণপাত করছেন আমাদের সুশীল গণতন্ত্রীরা । এই লেখা যখন লিখছি তখন টিভির খবরে ড, কামাল হোসেনের দাবি শুনছি , আরো দুই টার্মের জন্যে এই ব্যবস্থা বহাল রাখতে হবে । কি অদ্ভুত আমাদের পরম পুজনীয় সংবিধানের জন্মদাতা গণতন্ত্রীদের কথা । মুখেই গণতন্ত্রের কথা, আবার চিরাচরিত গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা মোতাবেক দেশ পরিচালনার নিয়ম প্রবর্তনে তাদের বিরোধিতা । সত্যিই সেলুকাস ! বিচিত্র এ দেশ, বিচিত্র তার বুদ্ধিজীবি ।

এখন আসি শেষ কথায় । ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার যদি শেষমেশ বিরোধী পক্ষের তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি মেনেও নেয় , সেক্ষেত্রেও মানি না, মানবো না রোগে আক্রান্ত বিএনপি বাধিয়ে বসবে আরেক ফ্যাকরা । তারা বহু আগেই ঘোষণা দিয়েছে , তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধাণ যিনি হবেন বা নিয়ম অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি খায়রুল হকের হবার কথা, তাকে তারা মানবেন না । কারণ তিনি নাকি আওয়ামীলীগের ঘুষ খাওয়া লোক । অর্থাৎ আওয়ামী ঘরানার আজ্ঞাবাহী লোক । বদ স্বভাবি বিএনপির এই অপবাদে সম্মানহানি বোধ করে বিচারপতি খায়রুল হক অবসরে যাবার আগেই স্বগতচিত্তে ঘোষণা দিয়ে বলেছেন তার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধাণ হবার কোনো খায়েশ কখনই ছিল না এবং সুযোগ এলেও তা তিনি গ্রহণ করবেন না । যিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের রায় দিয়ে গেছেন । সুতরাং আওয়ামীলীগের জন্যে বিএনপি হয়েছে শাঁখের করাত । যাইতেও কাটে, আসতেও কাটে । অতএব উপায় নেই । শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামীলীগ নির্ধারিত নিজস্ব অবস্থানেই অনড় থাকুক । সারা বিশ্ব দেখুক বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ দলীয় সরকারের অধীনে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য , সুষ্ঠু , শান্তিপূর্ণ ও অবাধ একটি নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব । যা সবার কাছেই হবে একটি উল্লেখযোগ্য অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত ।

স্টকহোল্ম, ২০১৩, ০৯,০৭

Thursday, September 5, 2013

দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বিনিময় : ভারতের গণমাধ্যম সোচ্চার:সুমি খান



৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী। এরা প্রত্যেকে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্নে বিশ্ববাসী এক। মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভি তে একটি টক শো তে উঠে আসে বাংলাদেশের সাথে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির বাস্তবায়ন এবং তিস্তা চুক্তি ।প্রশ্ন তোলা হয়, রাজনৈতিক হঠকারীতার কাছে খারতের পররাষ্ট্রনীতি নতজানু কিনা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে ১৯৭৫ সালে হত্যা করার কারণে ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। কারণ তৎকালীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়কার আর্দশ থেকে সরে গিয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনেকদিন চলেছে। ছিটমহলে পাকিস্তান আমলে ১৯৫১ ও ১৯৬১ সালে জনগণনা করা হয়েছিলো। এর দীর্ঘদিন পর মনমোহন- হাসিনার ২০১১ সালের চুক্তি ছিটবাসীদের আশাবাদী করেছে।
এই নিরীহ মানুষগুলোর জন্যে ও কথা বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের সচেতন নাগরিকদের। সার্বিক ভাবে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে এদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং নিরাপত্তাহীনতা ভারত বাংলাদেশ দুই দেশকেই চরম হুমকির মুখে রেখেছে। এই বাস্তবতা দুই দেশের নীতিনির্ধারক এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে।
ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী বাংলাদেশের নাগরিক হলেও বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে কোনো সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না । নেই তাঁদের ভোটার পরিচয়পত্র।একই চিত্র বাংলাদেশে থাকা ভারতের ছিটমহলেও। ছিটমহলবাসীর পরগাছা হিসেবে নিজেদের নাম-পরিচয় লুকিয়ে বাস করতে হচ্ছে ।
ভারতীয় ছিটমহল বা বাংলাদেশের ছিটমহলের প্রকৃত বসবাসকারীরা এখন আর নেই। বাংলাদেশি ছিটমহলে ভারতীয় আর ভারতীয় ছিটমহলে বাংলাদেশিরাই বর্তমানে বসবাস করেন। এটি একটি জটিল সমস্যা। ছিটমহল বিনিময় হলে ভারতের ১০ হাজার একর জমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুসারে জমি নেয়া যেতে পারে কিন্তু দেওয়া যায় না। এর জন্য সংবিধান সংশোধন করতে হবে। এখানেই তৃণমূল নেত্রী মমতা এবং ভারতীয় উগ্র মৌলবাদী সংগঠন বিজেপির আপত্তি।
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে এবং ভারতের ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি জেলার ভারত ভূখণ্ডে রয়েছে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল। এর মধ্যে ৪৮টি কোচবিহার জেলায়। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে রয়েছে ভারতের ১১১টি ছিটমহল। ১৯১১ সালের ১৪ থেকে ১৭ জুলাই পর্যন্ত অনুষ্ঠিত উভয় দেশের যৌথ আদমশুমারী অনুযায়ী, ভারতের ভূখণ্ডে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে রয়েছে ১৪ হাজার ২১৫ জন নাগরিক বাস করছেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ভারতের ১১১টি ছিটমহলে রয়েছে ৩৭ হাজার ৩৩৪ জন ভারতীয় নাগরিক ( নাগরিকত্ব না থাকলেও জন্মসূত্রে নাগরিক)।
আইন মোতাবেক ভারতের ভূখণ্ডে বসবাসকারী ৫১টি ছিটমহলের বাসিন্দা বাংলাদেশি আর বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারীরা ভারতীয় । ভারত-বাংলাদেশ –দুই দেশের নিরাপত্তা এবং জনস্বার্থেই ছিটমহল বাসীর নাগরিকত্ব দেবার সময় এসেছে।
আর কতোকাল প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হতে হবে নিরীহ মানুষকে? ছিটমহলের ‘নাইদেশের নাগরিক’দের মানবেতর জীবনের জন্যে দায়ী রাজনীতিকদের আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সময় এসে গেছে। ছিটমহল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষিত করা এবং তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবিতে বিশিষ্ট আইনজীবী অনির্বাণ দাস কোলকাতা হাইকোর্টে গত সোমবার ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ একটি জনস্বার্থ মামলা করেছেন ।
বাংলাদেশ সরকার ও ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময়ের জন্য চুক্তি সম্পাদন করতে রাজি থাকলেও বাদ সাধেন ভারতের আসাম রাজ্যের দুই বিজেপি সাংসদ আর পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল নেত্রী মমতার দাবি , এই চুক্তিতে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে।‘নিজেদের স্বার্থ’ বিসর্জন (?) দিয়ে কোনো বিনিময় চুক্তি হতে দেবেন না তিনি।মুখ থুবড়ে পড়ে ছিটমহল বিনিময়-প্রক্রিয়া।এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ছিটমহলজুড়ে। ছিটমহল বিনিময়ের দাবি আরো জোরালো হয়ে ওঠে ।
মমতা কদিন আগে হঠাৎ বলেন, “ছিটমহলবাসী চাইলে ছিটমহল বিনিময় হবে”। অথচ ১৯৯৪ সাল থেকে ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে ভারত ও বাংলাদেশের ছিটমহলবাসী অবস্থান ধর্মঘট ও অনশন সহ নানান আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। মমতা এসব না জানার ভান করলেন। মমতার এই বক্তব্যকে খণ্ডন করেছেন ছিটমহলবাসী।ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত আমাকে বলেছেন, ‘ছিটমহল বিনিময়ের দাবিতে দুই দেশেই আন্দোলন করছি। আমরা চাইছি, ছিটমহলবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিটমহল বিনিময় হোক। এতে ছিটমহলের বাসিন্দারা একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিক হয়ে বাস করতে পারবে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার ।’
সম্প্রতি ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতের আইনসভার উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় পেশ করতে দেয়া হয় নি। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি র আসামের দুই সাংসদ আপত্তি করেছে।বিলটি লোকসভায় উথ্থাপন করা যায়নি। এতে ক্ষুব্ধ হয় ছিটমহলবাসী। জ্বলছে তাঁদের মনে ক্ষোভের আগুন। তাঁরা ক্ষুব্ধ হন মমতার বিরুদ্ধে।
ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহসম্পাদক জানান, ছিটমহল বিনিময়ের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনী বিল যদি সংসদে না ওঠে, তবে তাঁরা মাঠে-ময়দানে লড়াইয়ের পাশাপাশি আইনি লড়াইয়ের পথে যাবেন। মামলা করবেন উচ্চ আদালতে।
নাগরিকত্ব না থাকার কারণে ছিটমহলের মেয়েদের বিয়ে হয় না। কোনো সন্তানসম্ভবা মা তার সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচি নেই। এ কারণে এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে এই বাসিন্দারা যা এড়াতে পারে না দু’দেশ ।
এই ছিটমহল বিনিময় না হওয়ার ফলে দুদেশের সরকার যে রাজস্ব বা বিভিন্ন প্রকারের কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার হিসেব কে করবে? এই সুযোগে একদল অসাধু লোক ছিটের বাইরের লোকেদের সাহায্যে ভয় দেখিয়ে জোর করে নামমাত্র মূল্যে ছিটমহলের নামে স্ট্যাম্প পেপার তৈরি করে জমি -বাড়ি রেজিস্ট্রি করাচ্ছে। এই খবর প্রথম বাংলানিউজে প্রকাশ হবার পর ছিটমহলের নিরীহ বাসিন্দাদের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়ে দেয়।
আগেই বলেছি, নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ নেই বলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা থাকছেন ভারতের ছিটমহলে ।পরদেশে পরগাছা হিসেবে বাস করছেন তারা । ছিটমহলের ঠিকানা বদলিয়ে ভারতের কোনো ঠিকানা ব্যবহার করে ছেলেমেয়েদের ভারতীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন,দিনমজুরের কাজ করতে হচ্ছে । ভারতের এলাকায় ভুয়া ঠিকানা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ।সন্তান প্রসবের সময় মায়েদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে ভারতের ঠিকানা দিয়ে ।
এমন ই মানবেতর জীবন যাপন করছে ছিটমহলের নিরীহ মানুষ গুলো। এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চান তারা। বাস করতে চান একটি নির্দিষ্ট দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে। সুযোগ-সুবিধাও চান সেই দেশের।বাংলাদেশ তাঁদের গ্রহণ না করলে তাঁরা ভারতের মাটিতেই থাকতে চান। তাই তাঁরা ছিটমহল বিনিময়ের দাবি তুলেছেন ।
আমার বিশ্বাস ,মানবতার প্রতি সম্মান করে যে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এই দাবির সাথে একাত্মতা জানাবেন। কারণ, ২০১৩ সালে এসে বিশ্বের কোন প্রান্তে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক থাকবে-এটা মেনে নেয়া যায় না।
ছিটমহল বিনিময়ের অযৌক্তিক বিরোধিতা ছিটমহলবাসীর জটিল সংকট নিরসনের প্রতিবন্ধক ।তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ ঠেকিয়ে দেবার কারণে মমতা-বিজেপি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই ছিটমহলবাসী ক্ষুব্ধ ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ছিটমহল বিনিময়ে দুই দেশ রাজি হলে ছিটমহল বিনিময়ের কয়েক দশকের আন্দোলন সফলতার পথ উন্মুক্ত হয়। সেই সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় ছিটমহল বিনিময় চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ নেয় উভয় দেশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হবার আমন্ত্রণ জানানো হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সফরের তিনদিন আগে মমতা হঠাৎ বাংলাদেশ সফর বাতিল করেন । আপত্তি তোলেন ছিটমহল বিনিময়ের বিরুদ্ধে। স্থগিত হয়ে যায় ছিটমহল বিনিময়ের প্রক্রিয়া।
তবে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, যাতে দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় এবং ছয় দশমিক এক কিলোমিটার অমীমাংসিত সীমানা চিহ্নিত হওয়ার কথা রয়েছে।
তবু তখন ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উভয় দেশের মধ্যে একটি প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়।
সম্প্রতি একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে জানা যায়, দৈর্ঘ্যে তিন কিলোমিটার আর প্রস্থে পৌনে তিন কিলোমিটার ভারতের বাত্রিগাছ ছিটমহল। এখানে বাংলাদেশের অন্তত ৫০০টি পরিবার বাস করে। ছিটমহলবাসী আজাদ হোসেন, জয়নাল মিয়া, মোহাম্মদ আলী, বকুল মিয়া ও কল্পনাথ রায় হতাশ , ক্ষুব্ধ স্বরে সাংবাদিকদের বলেছেন, “লুকোচুরি খেলে তো জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এভাবে আর বাঁচা যায় না।এবার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে তাঁদের বেঁচে থাকার জন্য দিতে হবে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগ”। হচ্ছে না। এবার এই মানবেতর জীবনযাপন থেকে মুক্তি চাইছেন তারা। আকুল আবেদন করেছেন ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কাছে। তারা যেন ছিটমহল বিনিময়ের দাবির পাশে এসে দাঁড়ান।
তিনবিঘা করিডোরে চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এবার ছিটমহল বিনিময় হবে। আইনি জটিলতার কারণে কখনো তা বাস্তবায়িত হয়নি।২০১০ সালে ভারতের জনগণনার সময় কোচবিহারের জেলাশাসক বলেছিলেন আমার জেলায় গণনা করতে গেলে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য লাগবে। কারণ বাংলাদেশী ছিটমহল এই জেলায় রয়েছে। তাদের প্রশ্ন তাহলে এই এলাকায় ভারতের সার্বভৌমত্ব কোথায় আছে? ছিটমহলবাসী প্রশ্ন তুলেন, গোয়া, সিকিম যদি ভারতের অর্ন্তভুক্ত হতে পারে তাহলে কেন ছিটমহল বিনিময় হচ্ছে না?
বাংলাদেশ এবং ভারত সরকার কে বিস্তারিত সর্বশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। সঠিক ভাবে জানতে হবে ছিটমহলের বাসিন্দারা কে কোথায় যেতে চান।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ছিটমহলগুলো ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক পাচারের কেন্দ্র । সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ, কোচবিহার জেলার বাংলাদেশি ছিটমহলে প্রায় ১৬ কোটি রুপির গাঁজা নষ্ট করা হয়েছে ২০১২ সালে। জেলাপ্রশাসক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, উদ্ধারকৃত গাঁজার অর্ধেক নষ্ট করা যায়নি। কেন সেসব রেখে দেয়া হয়েছে-বা কোথায় সেসব –তা বিস্তারিত আসেনি কোন সংবাদমাধ্যমে।
বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহলগুলোতে ৩৭ হাজার ৩২৯ জন বাস করেন। ছিটমহল বিনিময়ের পরে তার মধ্যে মাত্র ৭৪৩ জন ভারতে আসতে চান -এটা জরিপের তথ্য। ২০১২ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিটমহল সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় মনসুর আলি মিঞা বলেন, “আমি আজ যেভাবে এখানে এসেছি, তা রাষ্ট্রের ভাষায় অবৈধ। কারণ আমি খাতা-কলমে বাংলাদেশের বাসিন্দা। কিন্তু আমার বাংলাদেশের কোনো পরিচয়পত্র নেই। আমার জন্ম ব্রিটিশ ভারতে। বাংলাদেশে গিয়ে আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমি জন্মেছি ভারতে। ভারতেই মরতে চাই। একই ভাবে বাংলাদেশের ভেতরে ছিটের বাসিন্দারাও তাই চান। একজন মুসলিম হয়ে আমার ইচ্ছা ছিল হজ্বে যাওয়া। সেই অধিকার আমার নেই ।” তিনি প্রশ্ন করেন, “আমার মতো অনেকেই হজ্বে যাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কি মানবাধিকার হরণের মধ্যে পড়ে না?”
৩ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সম্প্রচারিত এক মুক্ত আলোচনায় বিজেপির মুখপাত্র তরুণ বিজয় স্বীকার করেন, ভারতের ‘জাতীয় স্বার্থেই’ বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন প্রয়োজন।বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবে ভারতীয় পার্লামেন্টের বিরোধী দল বিজেপি তাদের শক্ত অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছে মনে হচ্ছে।যদিও তৃণমূল কংগ্রেস ও আসাম গণ পরিষদ এখনো বিরোধিতা করে যাচ্ছে।
এই চুক্তি বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতের সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য পার্লামেন্টে বিল পাস করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন দরকার, যা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট সরকারের নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ তিন দফা বিল তোলার উদ্যোগ নিলেও দুইবার বিজেপি ও আসাম গণ পরিষদ এবং একবার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিরোধিতায় তা সম্ভব হয়নি। মমতার ভূমিকা জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে উল্লেখ করে মমতা বন্দোপাধ্যায় এবং তৃণমূলের তীব্র সমালোচনা করা হয় এই টক শো তে।
টিভি টক শোতে বিজয় বলেন, শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বর্তমান বাংলাদেশ সরকার নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ প্রশমনে সাড়া দিয়েছেন। এখন বাংলাদেশের মানুষকে ‘সঠিক বার্তাটি’ পৌঁছে দিতে’ ভারতেরও উচিৎ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে সই করা।
পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বরুণ গান্ধীও গত মাসে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে মত দেন।
তবে এনডিটিভির টক শোতে বিজয় আবারো বলেছেন, মনমোহন সিং নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের উচিৎ ছিল, বাংলাদেশের সঙ্গে স্থল সীমান্ত চুক্তি করার আগে বিরোধী দলের মতামত নেয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা এ চুক্তির বিষয়ে যে উদ্বেগের কথা বলে আসছেন, তাও কেন্দ্র সরকারের আমলে নেয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই বিজেপি নেতা।তবে তৃণমূল সাংসদ স্বাগত রায় এই চুক্তির চরম বিরোধিতা করে এই চুক্তির পক্ষাবলম্বীদের সমালোচনা করেন। এই টক শোতে তিনি দাবি করেন এই চুক্তি হলে ভারত ছিটমহলের ১১ হাজার একর জমি হারাবে। এটা কোনভাবেই হতে দেয়া যায় না। একই সাথে তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনা কে আবারো নির্বাচিত করার জন্যে অনেকে এই চুক্তি করতে চায়, যা ভারতের দায়িত্ব নয়। তার মতে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় যেই আসুক- তাদের সঙ্গেই দর কষাকষির জন্য প্রস্তুত হতে হবে ভারতকে।
কংগ্রেসের মন্ত্রী শশী থারুর ও বাংলাদেশে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বীণা সিক্রি এ চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতে জনমত গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো মত দেন।শশী থারুর বলেন, “ঢাকা আমাদের বড় বন্ধু। এখন আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতি অঙ্গীকার রাখতে না পারলে তা হবে একটি বিপর্যয়।”
বীণা সিক্রি বলেন, “ অসাম্প্রদায়িক এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী। ভারত যদি বিশ্বের কাছে গুরুত্ব আশা করে, তাহলে কোনো দেশের সঙ্গে করা চুক্তি বাস্তবায়নের সামর্থ্য তার থাকা উচিৎ।”স্থল সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম ভূমি হারাবে বলে যে অভিযোগ তৃণমূল ও আসাম গণ পরিষদ করে আসছে, তাও নাকচ করেন সাবেক এই রাষ্ট্রদূত।
শশী থারুর ও বীণা সিক্রির সঙ্গে একমত পোষণ করে প্রবীণ সাংবাদিক সুবীর ভৌমিক বলেন, পররাষ্ট্রনীতি যদি পাকিস্তানের মতো রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়-সেটা ভয়ংকর বিপর্যয়। ভারতের ভবিষ্যত এর পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যোগযোগের ওপর অনেকটা জড়িত। আর এ দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার সহযোগিতা দিয়ে আসছে।তার মতে, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্য দিয়েই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারে। আর সম্পর্ক উল্টে গেলে ক্ষতিও হবে একই মাত্রার। তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেন , খালেদা জিয়ারশাসনামলের শুরুতেই বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন বেড়ে যায়। বাংলাদেশে উলফার ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার সহ বাংলাদেশে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অবাধ তৎপরতা ভয়ংকর পর্যায়ে যায়। তারেক জিয়া দুবাইতে দাউদ ইব্রাহিমের সাথে দেখা করেন- জঙ্গী সংগঠকদের সাথে তার সম্পৃক্ততা ভারতীয় গোয়েন্দা তথ্যে উদ্ঘাটন হয়েছে । সেই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে হাসিনার শাসন প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারতের জন্যে নিরাপদ। কারণ , শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদ দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সুবীর ভৌমিক আরো বলেন, “১১ হাজার একর বা কতো জমি-সেটা অতো জরুরী নয়, যতোটা জরুরী এই মুহুর্তে দিল্লীর অনুধাবন করা খালেদা চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতের সাথে জোট করেন- যারা জঙ্গীবাদের সাথে যুক্ত। যারা সংখ্যালঘু নির্যাতন করে।”আলোচনার এই পর্যায়ে বিজেপি নেতা তরুণ বিজয় বলেন, “আমি সুবীর ভৌমিকের সঙ্গে একমত।”
আলোচকদের অধিকাংশই চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধনের পক্ষে মত দেয়ায় একপ্রকার কোনঠাসা স্বাগত রায় ‘কূটনৈতিক কৌশলের’ আশ্রয় নেন। তিনি বলেন, একজন মন্ত্রী হিসাবে শশী থারুরের এমন কিছু বলা উচিৎ নয়, যাতে মনে হয় যে দিল্লি ঢাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জবাবে স্বভাবসুলভ রসিকতার সুরে শশী বলেন, “কার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হবে- মিস্টার রায় এবং তার নেত্রী (মমতা) কি তা নিয়ন্ত্রণ করতে চান? তারা কি ভাবছেন যে ,কে আমার বন্ধু আর কে তা নয়- এটা বোঝার মতো বুদ্ধিও আমার নেই?”
এই টক শো দেখে ছিটমহল বাসীর মনে অন্তত আশা জাগবে তাদের দাবি এবার নীতিনির্ধারকদের নজরে আসবে। উচ্চ আদালত অথবা গণমাধ্যম – সকল প্রচেষ্টা সফল করে ছিটমহলবাসীর নাগরিকত্ব এবং মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকার সচেষ্ট হবে এমন আশা করছে ৫১ হাজার ৫৪৯ জন ‘নাই’ দেশের নাগরিক ছিটমহলবাসী।
sumikhan29bdj@gmail.com

রাষ্ট্র-পুনর্বার ভাবো, মৌলবাদীরাই তোমার ক্যান্সার:মারুফ রসূল


চারপাশে নানা কিছু চলছে। নানা সংবাদের বাতাবরণে মুখর এখন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। সন্দেহ নেই, এগুলো প্রয়োজনেই হচ্ছে।
‘প্রয়োজন’ শব্দটি বড়ই আপেক্ষিক, নানা স্তরে-উপস্তরে তার গ্রহণযোগ্যতার গ্রাফ উঠানামা করে। এখন সময়টি বড়ো নচ্ছাড়। স্বীকার করতেই হবে, তীব্র একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে গোটা জাতীয় জীবন।
বিশ্বায়নবাদীরা যদি ‘জাতীয় জীবন’কে অস্বীকার করতে চান, তবে তাদেরও বলি- আন্তর্জাতিক জীবনেও অস্থিরতা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। এই স্থির-অস্থিরের দৌড়োদৌড়িতে চাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক খবর, কিংবা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে না, যতোটা হওয়া উচিত ছিলো।
যৌনপল্লী উচ্ছেদের নানামুখী মহড়া আমরা লক্ষ্য করছি বেশ কয়েকদিন ধরে। হঠাৎ করে এমন একটি ঘটনা কেনো ঘটছে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওযা যাচ্ছে না, বা আমার মতো নগণ্য মানুষের মেধায় তা কুলোচ্ছে না।
তবে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ভয়ানক দুর্দিন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এটা কেবল এজন্য নয় যে, যৌনকর্মীদের আহত করে জোর করে উচ্ছেদের মাধ্যমে তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে, মাদারীপুরের যৌনপল্লী উচ্ছেদে কিন্তু অমান্য করা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ও। উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছে ‘ইসলামে কওম পরিষদ’ নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনটির জন্ম, বেড়ে ওঠা কিংবা দর্শন- নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু এরা যে রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করলো, হাইকোর্টের রায়কে অমান্য করলো, সে বিষয়ে আমার মাথাব্যাথা হবার ঢের কারণ আছে; কেননা, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনকে কে বা কারা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে, কোন দর্শনের ছুতোয় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করে কার্যক্রম পরিচালনা করে, তথাকথিত ‘বাংলা ভাই’ থেকে প্রায় সব ধরনের মৌলবাদী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর ইতিহাস দেখলেই তা বোঝা যায়।
এরা ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে, বিভ্রান্ত করছে সাধারণ মানুষকে এবং দিনের শেষে মানুষের অধিকারের বুকে পদাঘাত করে ন্যায় ও শান্তির মিথ্যা বুলি আওড়াচ্ছে। এরা মৌলবাদী, উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী; অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারাকাত যাদের অর্থনীতিকে একটি ত্রিভুজের সঙ্গে বিবেচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, ত্রিভুজের শীর্ষবিন্দুটি আর কেউ নয়, যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলাম ও তাদের পঙ্গপাল দোসররা।
মাদারীপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তাকে বিচ্ছিন্ন কিংবা সামান্য ঘটনা ভাবা হবে নিতান্ত একটি বোকামি। একটি দল, যাদের নাম ‘ইসলামে কওম পরিষদ’, তাদের কী এখতিয়ার আছে এ কাজটি করার? এরা কারা? এই যে মৌলবাদীদের আষ্ফালন, উদ্ধত আচরণ, এর মূলে কারণটা কী? এর কারণ খুব পরিষ্কার।
প্রথমত, রাষ্ট্র মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে, এবং সেটা করেছে সে ঐতিহাসিকভাবেই। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনারত রাজনৈতিক দলগুলো এসব মৌলবাদীদের প্রশ্রয় দিয়েছে কেবল ভোটের রাজনীতিতে টিকে যাবার জন্য। মাঝখান থেকে খেসারত দিয়েছে সমাজ; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নির্ভর একটি অসাম্প্রদায়িক, শোষণ-বৈষম্যমুক্ত সমাজের স্থলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি আতঙ্ক সমাজ, যেখানে জামায়াত-আতঙ্ক, শিবির-আতঙ্ক, হেফাজত-আতঙ্ক মানুষকে তাড়া করে বেড়ায়। শুরু থেকেই এদের দমনে রাষ্ট্রের সক্রিয় হওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু রাষ্ট্রের শীতনিদ্রা ভাঙে দেরিতে; আফসোস, মাদারীপুরে ততোক্ষণে লুট হয়ে যায় আমার বোনের সমস্ত সঞ্চয়।
এটা হয়তো সবাই একবাক্যেই মানবেন যে, কেউ যৌনকর্মী হয়ে জন্ম নেন না। আজ যাদের উপর অন্যায়ভাবে খড়গহস্ত চালিয়ে, মধ্যযুগীয় কায়দায় উচ্ছেদের বর্বরতা দেখানো হলো, তারা জন্মেছেন আমাদেরই দেশে, আমাদের কারো পরিবারেই। এরপর সমাজের চোরাগলিতে কতোটা পথ হারিয়ে আজ তারা জীবনের এ জটিল চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে বিশ্লেষণটা না হয় সমাজবিজ্ঞানীরাই করবেন। কিন্তু তাঁদের এ জীবনের জন্য রাষ্ট্র কী দায়ী নয়? রাষ্ট্র কী পারবে এই নারীদের চোখের জলের দায় এড়াতে? রাষ্ট্র ও সমাজের যুগপৎ প্রতারণায় প্রতারিত হয়ে যে নারীরা খুঁজে নিয়েছে নিজস্ব জীবনের ব্যাকরণ, নিজের বেঁচে থাকার অবলম্বন, তাকে কীসের ভিত্তিতে উচ্ছেদ করবে রাষ্ট্র? কার পাপ ঢাকতে? কার লাম্পট্য রাষ্ট্রকে বড়ো বেশি বিব্রত করে তুলেছে? কেনো এই প্রসঙ্গ এলে হেফাজতের নেতা আবদুল আউয়াল ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের মাঝে কোনো পার্থক্য থাকে না?
এসব উত্তর কে দেবে? বারো বছর আগে নারায়নগঞ্জে যাকে ‘পাপ’ বলে উচ্ছেদ করেছিলো রাষ্ট্র, বারো বছর পর মাদারীপুরেও তাকে ‘পাপ’ হিসেবেই দেখছে। অর্থাৎ, আহ্নিক গতি-বার্ষিক গতি বদলালেও রাষ্ট্রের কপট মানসিকতা বদলায়নি।
এবার কয়েকটি সোজা কথায় আসা যাক। সহজ কথা যেমন সহজে বলা যায় না, তেমনি সোজা কথাও সোজা করে বলা যায় না। যদি কোনো দল নিজেদের ‘ইসলামি’ দল বলে পরিচয় দেয়, তবে তার কাজ হলো ধর্ম প্রচার করা কিংবা ধর্মের যে অমোঘ বাণী, তা নিয়ে কাজ করা। কিন্তু বাংলাদেশে যারা ইসলামি দল বলে নিজেদের পরিচয় দেয়, তাদের মূল আকর্ষণটাই থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে একটি ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রণয়ন করা। একাত্তর-পূর্ব সময় থেকেই এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, এমনকি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তার মূলেও ছিলো এসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল।
মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সন্ত্রাসী বাহিনী ইসলামী ছাত্র সংঘ (বর্তমানে ইসলামী ছাত্র শিবির) ধর্মের নামে বাংলাদেশ বিরোধী বর্বরতা চালিয়েছে, পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে লাম্পট্যের কূটনীতি চালিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরও দেখা গেছে, যতোগুলো ধ্বংসযজ্ঞ, অমানবিকতা ও বিভৎস বর্বরতা ঘটেছে, তার অধিকাংশের মূলেই ছিলো কোনো না কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা ধর্মাশ্রিত দল। এখানেই মূল খটকা। ধর্ম শান্তি ও ন্যায়ের কথা বলে, কিন্তু সে-ই ধর্মের আওয়াজ তুলে যৌনপল্লী উচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটিয়ে, তাতে লুটপাট করে কী বোঝাতে চায় তারা? আমরা কয়েক মাস আগেই দেখেছি হেফাজতে ইসলাম নামে একটি মধ্যযুগীয় সংগঠন জামায়াত-বিএনপি’র প্রত্যক্ষ মদদে ঢাকার শাপলা চত্বরে কী অমানবিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তারপর ভাড়াটে প্রচারযন্ত্র দিয়ে তাকে জায়েজ করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।
এর আগে এদেরই কিছু মুর্খ পালের গোদা নারায়ণগঞ্জের যৌনপল্লী উচ্ছেদে জিহাদী ভূমিকা পালন করেছে। এগুলো কি আদৌ ধর্ম প্রচারে বা ধর্মের কোনো কারণে? যে সূফীবাদের হাত ধরে বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে, তাঁদের তো কখনও এমন ধ্বংসযজ্ঞ করতে দেখিনি। এই মদদপুষ্ট ইসলামি দলগুলো তবে কোন হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এই কাজে নেমেছে? তারা যাকে অন্যায় বলছে, সেটা আদৌ অন্যায় কি না, সেটার বিষয়ে কোনো আলোচনা কি হচ্ছে? হচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, এতো সাহস তারা কোথায় পায়? আমি সোজা বাংলায় যা বুঝি, তা হলো- রাষ্ট্রের নির্লজ্জ প্রশ্রয়ের কারণেই এরা এতোটা বাড় বেড়েছ। হাইকোর্ট যৌনপল্লী উচ্ছেদে সময় বেঁধে দিয়েছে, এটা কোনো সভ্যতার মাঝে পড়ে না; কারণ এই উচ্ছেদেই সব সমস্যা চুকেবুকে যাবে না। আর মাননীয় আদালত কী বলবেন- পুরুষের মগজের ভেতরে যে পাপ-লাম্পট্য নষ্ট পুঁজের মতো অবস্থান করছে, তার বিরুদ্ধে রায় দেবার কিংবা না ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার কোনো সময়সীমা বেঁধে দেয়া সম্ভব কি না?
মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদের বিষবৃক্ষগুলো চারপাশে ভয়ানকভাবে বেড়ে উঠছে। এদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানবিক বাঙলাদেশ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ না হয়, ভুঁইফোড় মৌলবাদীদের প্রতিহত না করে; যদি এখনও ভোটের হিসেবে নির্ধারণ করে তাদের মৌলবাদঘেঁষা ভবিষ্যৎ কর্মপরিধি, তবে একদিন নমিনেশন দেবার জন্য যোগ্য-আদর্শিক নেতা খুঁজে পাবেন না। শাহ এ এম এস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, আইভি রহমানের মতো নেতারা আমার এই বক্তব্যের ট্র্যাজিক উদাহরণ।
মারুফ রসূল: সাহিত্যিক ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী,

Sunday, September 1, 2013

এই লজ্জা কোথায় রাখি: মুহম্মদ জাফর ইকবাল


১.
কাক কাকের গোশত খায় না- কিন্তু এবারে মনে হয় একটু খেতেই হবে। আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে আমি সাধারণত অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করি না। কিন্তু এবারে মনে হয় করতেই হবে।

আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি। আমার মতোন শিক্ষকরা সেই ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে আটকে রেখেছেন। খবরে জেনেছি এই মুহূর্তে দয়া করে পনেরো দিনের জন্যে দম নেওয়া হচ্ছে। তারপর সম্ভবত আবার নব উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়া হবে।

আগেই বলে রাখি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর এবং তার শিক্ষকদের ভিতর কী সমস্যা সেটা আমি অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারছি না। শিক্ষকরা বলছেন তার বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। ভাইস চ্যান্সেলর বলছেন তদন্ত কমিটি করে সেই অভিযোগ যাচাই করা হোক। তারপরেও সেখানে শিক্ষকরা কেন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে আটকে রেখেছেন সেটা আমার মোটা বুদ্ধিতে ধরতে পারছি না। পত্রপত্রিকার লেখালেখি থেকে বোঝার চেষ্টা করছি কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।

আমাদের দেশে লেখালেখির একটা নতুন স্টাইল শুরু হয়েছে। সবারই একটা নিরপেক্ষতার ভান করতে হবে। তাই কেউ যদি গুরুতর অন্যায়ও করে সোজাসুজি স্পষ্ট করে কেউ লেখে না। ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে গা বাঁচিয়ে লেখে- যেন কেউ কিছু বলতে না পারে। আজকাল পত্রপত্রিকায় ইলেকট্রনিক ভার্সন রয়েছে। সেখানে কোনো লেখা ছাপা হলে তার লেজে পাঠক আবার ভুল বানান এবং অমার্জিত ভাষায় যা কিছু লিখতে পারে! সবাই ভয়ে ভয়ে লেখে, কার আর সত্যি কথা বলে গালমন্দ খেতে ভালো লাগে? আমি অবশ্যি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে দুর্বোধ্যভাবে কিছু বলার চেষ্টা করছি না- একেবারে সোজাসুজি বলছি, একজন ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে দিনের পর দিন আটকে রাখা খুব বড় একটা অন্যায় কাজ। কথাটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বলা যায়, মানুষটি একজন ভাইস চ্যান্সেলর না হয়ে যদি একজন জুনিয়র লেকচারার কিংবা একজন অপরিচিত ছাত্রও হতো, তাকেও একটা ঘরের মাঝে আটকে রাখা গুরুতর একটি অন্যায়।

স্বাধীন একটা দেশে কাউকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা ঘরে জোর করে আটকে রাখা যায় না। আমি আইনের মানুষ নই। কিন্তু আমার ধারণা দেশের আইনে এটা নিশ্চয়ই একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষকরা এ কাজটি করছেন আমার এ লেখাটি তাদের চোখে পড়বে কিনা আমি জানি না। যদি পড়ে তাহলে তাদের প্রতি আমার একটা ছোট অনুরোধ। ঘরে তাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই কমবয়সী ছেলেমেয়ে আছে। পনেরো দিন পর তারা আবার যখন তাদের ভাইস চ্যান্সেলরকে তার অফিসে অবরুদ্ধ করে ফেলবেন, তখন তারা রাতে বাসায় ফিরে গিয়ে তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে নিচের এই বাক্যালাপগুলো করবেন!

তারা তাদের ছেলেমেয়েদের বলবেন, ‘বাবা, আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একটা বিশাল কাজ করে এসেছি!’ ছেলেমেয়েরা তখন বলবে, ‘কী কাজ বাবা (কিংবা কী কাজ মা?)’ তখন তারা বলবেন, ‘আমাদের একজন ভাইস চ্যান্সেলর আছেন, তাকে আমরা দু’চোখে দেখতে পারিনা। তাই তাকে আমরা তার অফিসে আটকে রেখেছি। সেখান থেকে তাকে আমরা বের হতে দিই না।’

আমি ছোট বাচ্চাদের যেটুকু জানি তাতে আমার ধারণা তখন তারা চোখ বড় বড় করে বলবে, ‘বের হতে দাও না?’
‘হ্যাঁ, জেলখানায় যেরকম কেউ বের হতে পারে না, সেরকম। তাকে আমরা অফিস থেকে বের হতে দিই না। জেলখানার মতো আটকে রেখেছি।’

বাক্যালাপের এরকম পর্যায়ে শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করতে পারে, ‘তোমাদের ভাইস চ্যান্সেলরের ছেলেমেয়ে নেই? তারা কী বলে?’

‘তাদের আবার বলার কী আছে? একটা মেয়ে শুনেছি লেখাপড়া করতে বিদেশে গিয়েছে। তাকেও বিদায় জানাতে আমরা ভাইস চ্যান্সেলরকে এয়ারপোর্টে যেতে দেইনি।’

বাচ্চাগুলো তখন নিশ্চয়ই শুকনো মুখে তাদের বাবা কিংবা মায়ের মুখের দিকে তাকাবে, চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে, ‘সত্যি?’

শিক্ষকরা তখন বলবেন, ‘হ্যাঁ। উচিৎ শিক্ষা হচ্ছে। তোমরা যখন বড় হবে তখন তোমাদের যদি মানুষকে অপছন্দ হয় তাহলে তোমরাও তাকে এভাবে একটা ঘরে আটকে ফেলবে। বের হতে দেবে না!’

আমার ধারণা শিক্ষকদের ছেলেমেয়েরা আলোচনার এই পর্যায়ে এক ধরনের আহত এবং আতংকিত দৃষ্টিতে তাদের বাবা (কিংবা মা) এর দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমার খুব জানার ইচ্ছে এবং আমি খুবই কৃতজ্ঞ হতাম যদি এই শিক্ষকদের কেউ আমাকে জানাতেন এই ধরনের একটা কথোপকথনের পর তাদের ছেলেমেয়েরা কী বলেছে।

২.
পৃথিবীর যেকোনো দেশে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্ভবত সেই দেশের সবচেয়ে জ্ঞানী এবং গুণী মানুষ। সবচেয়ে বড় বুদ্ধিজীবী, সবচেয়ে বড় মুক্তবুদ্ধিতে বিশ্বাসী মানুষ এবং সম্ভবত জাতির সবচেয়ে বড় বিবেক। তাই সাধারণ মানুষ যখন দেখে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন দেশের নাগরিককে জেলখানার মতো একটা ঘরে আটকে রাখছে তখন তারা নিশ্চয়ই হতবাক হয়ে যায়। সবচেয়ে বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে এই পুরো প্রক্রিয়াটার নাম দেওয়া হচ্ছে ‘আন্দোলন’।

মনে হয় আন্দোলন বলা হলেই পুরো বিষয়টাকে ন্যায়সঙ্গত, প্রগতিশীল, সত্যের জন্যে সংগ্রাম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই দেখা গেল মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী সংগ্রামী সকল নেতৃবৃন্দকে আলোচনার জন্যে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ কোনো একজন মানুষকে জোর করে একটা ঘরে আটকে রাখা হলে কাউকেই কোনো ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়তে হয় না বরং দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাদের নিজের বাসায় ডেকে নিয়ে যান। সোজা কথায় এতো বড় একটা অনৈতিক এবং বেআইনি বিষয়কে রাষ্ট্রীয়ভাবে নৈতিক সমর্থন দেওয়া হয়।

এই দেশে বিষয়টা অবশ্য নতুন নয়। কাউকে জিম্মি করে কোনো একটা দাবি আদায় করে নেয়া এই দেশের সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। যারা ভদ্রতা করে এটা করে না তাদের মেরুদণ্ডহীন অপদার্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমি নিজের কানে এই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষককে বলতে শুনেছি, ‘এমনিতে কাজ হবে না, গিয়ে ঘেরাও কর, রাস্তাঘাটে কিছু ভাংচুর কর তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে।’
তাই দাবি আদায়ের জন্যে কাউকে জিম্মি করে ফেলা যে একটি বেআইনি কিংবা অত্যন্ত অমানবিক কাজ হতে পারে সেটা কেউ মনে পর্যন্ত করে না।

শুধু যে দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মহোদয় এই ধরনের বেআইনি কাজকে নিজের অজান্তেই গ্রহণযোগ্যতার সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছেন তা নয়, আমাদের দেশের পত্রপত্রিকাও তাদের কাজকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছেন। তারা দুই পক্ষকেই সমানভাবে নিজেদের বক্তব্য রাখতে দিচ্ছেন, পত্রিকার পাশাপাশি পৃষ্ঠায় তাদের বক্তব্য ছাপা হচ্ছে। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছি। সব কিছু যে বুঝতে পেরেছি সেটা দাবি করব না।

আমি বহুকাল থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আছি তাই একটা জিনিস জেনেছি, প্রকাশ্যে যে কথাগুলো বলা হয় সেগুলো সব সময় পুরো কথা নয়, আসল কথা নয়। প্রকাশ্য কথার পিছনে অপ্রকাশ্য কথা থাকে, গোপন এজেন্ডা থাকে অনেক সময় দেখা গেছে সেগুলোই মূল ব্যাপার। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অপরাধের ব্যাপারে কোনটা সত্যিকার কথা সেটা জানি না। তবে অভিযোগ থাকলে তদন্ত হবে শাস্তি হবে কিন্তু আগেই নিজেরা শাস্তি দিয়ে একজনকে তার মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হবে সেটি কোন দেশের বিচার?

পনেরো দিন পরে কী হবে আমরা জানি না। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার করে বলা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা খুব ভয়ংকর উদাহরণ তৈরি হল। কোনো একজন মানুষকে পছন্দ না হলে তাকে সরানোর জন্যে কয়েকজন (কিংবা অনেকজন) মানুষ একত্র হয়ে তাকে একটা ঘরে আটকে ফেলতে পারবেন- এর জন্যে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, দেশের আইন তাদের স্পর্শ করবে না। যেসব শিক্ষকরা অপছন্দের মানুষকে ঘরের ভেতর আটকে ফেলার কালচার চালু করলেন, তাদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে ভাইস চ্যান্সলর হবেন। ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব খুব কঠিন দায়িত্ব। নিশ্চিতভাবেই তখন তারা সবাইকে সমানভাবে খুশি করতে পারবেন না। তখন তাদেরকে যখন অন্য শিক্ষকেরা ঘরের মাঝে বন্দি করে ফেলবেন তখন তারা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন কী না জানার ইচ্ছে করে।

৩.
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তৈরি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া করানোর জন্যে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন মনে হয় সেটা কারো মনে নেই। অনেকেরই ধারণা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিটি বুঝি তার নিজের সুখ সুবিধার জন্যে। নিজেদের ‘অধিকার’ আদায় করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার বিষয়টি যদি পুরোপুরি চাপা পড়ে যায় তাতেও কেউ কিছু মনে করে না। ছাত্রছাত্রীদের কারণে, ধর্মঘট, মারামারি হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রয়েছে এরকম অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু শিক্ষকেরা তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ করে রেখেছেন সেরকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। উদাহরণটি খুব ভালো নয়, সারা দেশে আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর খুব বড় একটা গ্লানি নেমে এসেছে। এই গ্লানি থেকে আমরা খুব সহজে বের হয়ে আসতে পারব বলে মনে হয় না।

৪.
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আনোয়ার হোসেনকে আজ থেকে ছয় বছর আগে ঠিক এই রকম সময়ে মিলিটারি সরকার গ্রেফতার করেছিল। তার লেখা বইয়ে আমি পড়েছি চোখ বেঁধে তাকে নিয়মিতভাবে রিমান্ডে নেয়া হতো। তাই আমরা জানি তার জেল খাটার অভিজ্ঞতা এবং মিলিটারি অত্যাচার সহ্য করার ক্ষমতা বেশ ভালো রকমই আছে। আপাতত শিক্ষকদের চারদিনের রিমান্ড থেকে মুক্তি পেয়েছেন, পনেরো দিন পর যখন আবার শিক্ষকরা তাকে তাদের জেলখানা রিমান্ডে নিয়ে যাবেন আমি আশা করছি তিনি যেন ধৈর্য ধরে সেটা সহ্য করতে পারেন।

ছয় বছর আগে তাকে যখন মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তখন আমি আর আমার স্ত্রী তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সাহস দিতে তার বাসায় গিয়েছিলাম। পনেরো দিন পর যখন শিক্ষকরা আবার তাকে ঘরে আটকে ফেলবেন তখন হয়তো আমাদের আবার তার বাসায় গিয়ে স্ত্রী পুত্র কন্যাকে সাহস দেয়ার কথাÑ কিন্তু আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমি তাদেরকে এবার লজ্জায় মুখ দেখাতে পারব না।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
লেখক, অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

আর নয় প্রীতিদের অপ্রীতিকর চলে যাওয়া:মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান



মামুন বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করে ফেসবুকে আমার ওয়ালে লিখেছে, ‘ভাইয়া, আপনাকে খুব প্রয়োজন ছিল। অনেকবার কল করেছি। কিন্তু, ফোন বন্ধ পেয়েছি। প্লিজ, আমাকে কি একটা কল দেবেন?’

ছোট ভাই মামুনের কথাগুলো আকূতির মতো শুনালো। ও আমাকে ফোনে পাচ্ছে না। পুরো রমজান মাসে নাকি পায়নি। কথাটি পুরোপুরি সত্য। বিভিন্ন জায়গায় ইফতারের দাওয়াত এড়ানোর জন্যই মোবাইল বন্ধ রাখতাম। আব্বা, ড. অনুপম সেন স্যার, বড় ভাই ডা. মোস্তাফিজ, হেলাল স্যার, আসাদ স্যার, জাকিয়া, আবু হান্নান ভাই এবং আরও অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আমার ওজন বাড়া নিয়ে খুব চিন্তিত। রোজার পুরো মাসে সিয়ামের ফাঁকে ওজন কমানোর সুযোগ নিতে চেয়েছিলাম। কাজেই বেশিরভাগ সময় ফোন বন্ধ রাখতাম।

অতি প্রিয় ছোট ভাই মামুনকে সত্য স্বীকারোক্তি দিলাম তার ফেসবুকের ইনবক্সে। ও খুব দ্রুত রেসপন্স করলো। খুব আবেগ নিয়ে বললো, ‘ভাইয়া, আপনি নিশ্চয় প্রীতির ব্যাপারটা জানেন?’ বললাম, ‘আমি বাংলানিউজটুয়েন্টিফোরডটকমে পড়েছি’।
তাছাড়া তেহসিনের স্ট্যাটাসটা কয়েক লাইনের বেশি পড়তে পারিনি। ইদানিং নার্ভ দুর্বল হয়ে পড়েছে। অতো লোড নিতে পারছি না’।

মামুন ইনবক্সে লিখলো, ‘ভাইয়া, ওটা আমার স্ট্যাটাস ছিল। সবাইকে শেয়ার করার অনুরোধ করেছি। ঘটনার সময় আমি পাশে ছিলাম’।

মামুন আবেগী মানুষ। মানুষকে সম্মান দেয়। তীব্রভাবে ভালোবাসে। মামুন লিখে চলে, ‘ভাইয়া, রেলপথে পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিরুদ্ধে আমরা যুদ্ধ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে আরম্ভ করে দিয়েছি সাইবার যুদ্ধ। ‘রেলপথে আর কোনো দুর্ঘটনা নয় - প্রীতি দাশ হত্যার বিচার চাই’ এ দাবিতে ১৭ আগস্ট শনিবার সকাল দশটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধনও করবো আমরা সবাই মিলে। এখানে আমরা ড. অনুপম সেন স্যারের মতো একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষকে পেলে ভালো হতো। স্যার যদি আসেন, তবে আমাদের আয়োজনের মেসেজটা সমাজে ভালোভাবে পৌঁছাতো। ভাইয়া, দয়া করে স্যারকে একটু দাওয়াত দেন’।

আমি মামুনকে বললাম, ‘স্যার আসবেন, তুমি নিশ্চিত থাকো। আগামীকাল আমি কথা বলবো স্যারের সঙ্গে’।

প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললাম। কারণ, স্যারকে যতোটুকু জানি, সময় পেলে এবং শরীর সুস্থ থাকলে তিনি যেকোনো মহৎ কাজে এগিয়ে যান এবং উৎসাহ দেন। এটা তার মজ্জাগত।
আন্তরিক ধন্যবাদ জানালো মামুন। সেই সঙ্গে ফেসবুকের একটি গ্রুপ এবং ইভেন্ট শেয়ার করতে বললো। ও ইনবক্সে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে লিখছে, ‘http://www.facebook.com/groups/justiceforpritidas/ যদি সম্ভব হয় এই গ্রুপটা একটু শেয়ার করবেন... http://www.facebook.com/events/708028025890150/ এটি ইভেন্ট...’।

ক্লিক করে দেখলাম, দু’টিতেই কভার পিকচারে লেখা আছে... ‘এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়, এটা হত্যাকাণ্ড/এই হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই’।

হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, মামুন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টের প্রোফাইল ও কাভার ছবি পরিবর্তন করেছে। বোঝার চেষ্টা করলাম, বন্ধুপত্নীর অপ্রত্যাশিত মৃত্যু ওকে কতোটা শোকাহত করেছে। মামুনের সঙ্গে চ্যাট শেষ করে প্রীতির মৃত্যু নিয়ে দেওয়া ওর স্ট্যাটাসটা পড়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিলাম । ক্লিক করে ওর ওয়ালে ঢুকলাম।

নিঃশ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ও গড়িয়ে পড়া অশ্রু
মামুন লিখেছে, ‘প্রচণ্ড কষ্ট এবং ক্ষোভ থেকে লিখছি। গত পরশু চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিলাম আমি, জুয়েল, মিন্টু এবং প্রীতি বউদি। বউদি বসেছিলেন জানালার পাশে। মিন্টু তার পাশে। দেখা হওয়া মাত্রই বৌদি শুভেছা বিনিময় করেছিলেন আমার সঙ্গে। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমার বাচ্চা কেমন আছে, পরিবার কেমন আছে?’

‘মিন্টু ঘুমানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয় এবং এয়ারপোর্ট স্টেশনে দেখা হবে বলে জানায়। মিন্টুর কর্মস্থল ঢাকা। বউদিকে নিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকায় ভালো লাগে না বউদির। তারপরও সপ্তাহ দুয়েক থাকার ইচ্ছে আছে। নিতান্তই মন না টিকলে ১৪ তারিখেই ফিরে আসবেন। রাত আনুমাণিক সোয়া এগারোটা কিংবা এগারোটা বিশ মিনিটের দিকে ট্রেন ভাটিয়ারি ভাঙ্গা ব্রিজের কাছে পৌঁছায়। আমি জুয়েলের সঙ্গে গল্প করছিলাম’।

‘হঠাৎ ‘ঠাস’ করে একটা শব্দ শুনি। সঙ্গে সঙ্গে একটা পাথর চোখের সামনে ছিটকে পড়ল। কোচের মাঝখানে সামনা-সামনি আসনগুলোর মধ্যবর্তী ফ্লোরে নিষ্ঠুর পাথরটিকে পড়ে থাকতে দেখলাম। বউদি শুধু একটা আর্তনাদ করে নুইয়ে পড়েন। মিন্টু কি হয়েছে, কি হয়েছে বলে বউদিকে ধরে। বুঝতে পারি, পাথরটা বউদির মাথার বাম পাশে আঘাত করেছে। বউদির বাম গালে একটু লাল দাগ লক্ষ্য করি। মিন্টু মাথায় পানি ঢালে। সম্ভব সব রকমের চেষ্টা করা হয় বউদির জ্ঞান ফেরানোর জন্য’।

‘কিন্তু আমাদের এতো চেষ্টার পরেও বউদি কোনো কথা বলছিলেন না। চোখ দু’টো বন্ধ ছিল। চোখের কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। ২/৩ মিনিট পর পর হেঁচকি তুলছিলেন। নিঃশ্বাস নেওয়ার নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন’।

‘এতোটা খারাপ কিছু আমি তখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি চলে যাই ট্রেনের শেষ মাথায় কোনো ডাক্তার থাকলে আসতে বলার জন্য। আমি আশাহত হয়ে ফিরে আসি। এসে দেখি, বউদি অসাড় হয়ে পড়েছেন। মিন্টু বলছে, আমি পাল্স পাচ্ছি না। আমিও চেক করি, পাইনি। মনে করেছিলাম, অতিরিক্ত উত্তেজনার কারণে পাচ্ছি না। হয়তো মৃদু ভাবে আছে। আমি ধরতে পারছি না’।

হে প্রভু, তুমি বউদিকে নিও না
মামুন আরও লিখেছে, ‘সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সীতাকুণ্ড নেমে যাওয়ার। কোনোমতে মিন্টু, আমি মিলে বউদিকে ধরাধরি করে নামাই। জুয়েল সব ব্যাগ নামায়। বউদিকে বেঞ্চে শুইয়ে আমি দৌঁড়াই একটা ট্যাক্সি ঠিক করার জন্য। পথে একটা রিকশা পাই যাত্রীসহ। তাদেরকে অনুরোধ করলে তারা রিকশাটা ছেড়ে দেন। আমি মিন্টু বউদিকে নিয়ে মূল রাস্তায় পৌঁছে ট্যাক্সি নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল, সীতাকুণ্ডে পৌঁছাই’।

‘আল্লাহ্র কাছে শুধু কায়মনোবাক্যে একটা প্রার্থনা করছিলাম। হে আল্লাহ , হে প্রভু, আমি যদি একটাও ভালো কাজ করে থাকি, আমার যদি একটা এবাদতও তুমি কবুল করে থাকো, যদি একটাও ন্যায়বিচার করে থাকি, তবে তুমি প্রীতি বউদিকে নিও না। ফিরিয়ে দাও। এটা ওর যাওয়ার সময় নয়’।

অতিরিক্ত কষ্টে-আবেগে মামুন লিখেছে, ‘হয়তো প্রার্থনা করতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। হয়তো বা আমি এতোটাই পাষণ্ড, পাপী যে আল্লাহ শোনেননি। মিন্টু তখন শুধু বউদির হাত ধরে বসেছিল। আর কান্নাভেজা কণ্ঠে আকুতি জানাচ্ছিল, প্রিয়তমার কাছে- প্রীতি, ও প্রীতি... কথা বলো, কথা বলো। বউদি নিশ্চুপ- নির্বাক। দৃষ্টি যেন কোথায়! হয়তো অপার্থিব দৃষ্টি, আমি চিনতে পারছিলাম না’!

‘ডাক্তার পরীক্ষা করে যখন অক্সিজেন মাক্স লাগাচ্ছিলেন মিন্টু তখনো বউদির হাত ধরেছিল। আর বলছিল, আমি শক্ত আছি। ডাক্তার সাহেব, আপনি বলেন কি অবস্থা। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব যেন ডাক্তারের চোখে জমা হয়েছে। ডাক্তার শুধু আমাদের দিকে তাকাচ্ছিলেন আর কি যেন বলতে চেয়েও বলতে পারছিলেন না। ডাক্তার প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমাদেরকে হৃদয়বিদারক সংবাদটি দিলেন। প্রীতি বউদি আর নেই!

মিন্টুর চোখের পানি প্লাবিত করেছে পুরো পৃথিবীকে
মামুন ওর স্ট্যাটাসে আরো লিখেছে, ‘মিন্টু হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে। বলে, আমি ওর বাবা মাকে কি জবাব দেবো! এই মেয়েটা শুধু আমার সঙ্গে থাকার জন্য কি না করেছে। একটা বাবু, শুধু একটা বাবুর জন্য তার সে কি আকূতি! হায়রে ঢাকা! হায়রে চাকুরী! আমি কি জবাব দেবো!’

আমি পড়ছি আর দেখছি, মিন্টুর চোখের পানি মামুনের ওয়ালকে ছাপিয়ে সমস্ত ওয়েবপেজকে ভিজিয়ে পুরো পৃথিবীকে প্লাবিত করছে।

এক পর্যায়ে মামুন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। অসংখ্য ডট দিয়ে নিজের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করেছে। অনেকটা গ্যাপ দিয়ে মামুন আবার লিখছে, ‘না । আমরা কেউ ওকে সান্ত্বনা দেইনি। সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা কারো জানা ছিল না। আমরা তখনো আশাবাদী ছিলাম। ডাক্তারকে বলে বউদিকে নিয়ে আমরা চট্টগ্রাম মেডিকেলের দিকে রওনা দেই। পুরো যাত্রা পথে আমার বন্ধু বউদির হাত ধরে নির্বাক বসেছিল।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছার পর ডাক্তারের মুখে একই কথা শুনে সবার মাঝে নেমে আসে শোকাতুর নিস্তব্ধতা। আহাজারি করে ওঠেন বউদির মা, বাবা, ভাই, মিন্টুর বাবা-মাসহ উপস্থিত সকলে। আমি হতবাক। আমার বুক যেন ভেঙে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই একটা মানুষের জীবন কিভাবে শেষ হয়ে যায়!’

বিচার সবকিছু ফিরিয়ে দিতে পারে না
মামুন প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে লিখছে, ‘মামলা হয়েছে।পুলিশ চেষ্টা করছে আসামিদেরকে গ্রেফতার করার। হয়তো আসামি ধরা পড়বে। বিচার হবে’।

বিচারক মামুনকে হয়তো মানুষ মামুন প্রশ্ন করছে, ‘মিন্টু কি ফিরে পাবে তার প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীকে ? বউদির ভাইয়েরা কি ফিরে পাবেন তাদের একমাত্র বোনকে? মা-বাবা কি ফিরে পাবেন তাদের আদরের কন্যাকে? মিন্টুর বাবা-মা কি ফিরে পাবেন তাদের প্রিয় কন্যাসম পুত্রবধূকে?’

মামুনের কম্পিউটারের বাটনগুলো অবশেষে ভাষা খুঁজে পেয়েছে, ‘এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়। মানুষের জীবন কোনো ছেলেখেলা নয়। কারো নিছক খেয়ালের কারণে অন্য কারো জীবন প্রদীপ থেমে যেতে পারে না।

ইতোমধ্যেই পুলিশ সন্দেহভাজন একজনকে আটক করেছে। আমরা চাই, আর কারো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয়, কোনো ভাই যেন তার বোনকে, স্বামী যেন তার স্ত্রীকে, বাবা-মা যেন তার মেয়েকে, শ্বশুর-শাশুড়ি যেন তাদের আদরের বউমাকে না হারান। জীবন শুরু করার বা মেহেদির দাগ মুছে যাওয়ার আগেই যেন কারো জীবনে নেমে না আসে নির্বাক দুঃসহ নির্মম নির্জনতা। আমার বন্ধুর মতো কারো জীবন যেন শ্মশানের চিতার আগুনে দাউ দাউ করে না জ্বলে’।

রুখে দাঁড়াতে হবেই
মামুনের কি-বোর্ডে প্রতিবাদের কথা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলছে, ‘অপরাধীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমরা তৈরি করেছি এই গ্রুপ। বন্ধুরা, আপনারা সবাই আপনাদের বন্ধুদের এই গ্রুপের সদস্য করে আমাদের পাশে দাঁড়ান। আগামী শনিবার সকাল দশটায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আমরা সবাই সমবেত হবো এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে। সেখানে এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন, কালোব্যাজ ধারণ, সংবাদ সম্মেলন ও স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। বন্ধুরা, এই সামাজিক আন্দোলনে আমরা আপনাদের সহযোগিতা এবং সবান্ধব অংশগ্রহণ চাই। এই পোস্টটি সকল বন্ধুকে শেয়ার করার অনুরোধ করছি’।

আর নয় প্রীতিদের অপ্রীতিকর চলে যাওয়া
শুক্রবার দুপুর বারোটার দিকে সেন স্যারকে ফোন করলাম। কুশল বিনিময়ের পর স্যারকে মানববন্ধনের কথা বললাম খুব সংকোচের সঙ্গে। বললাম, ‘খুব কম সময়ে ফ্রি করে দেবো’। স্যার খুব দরদী গলায় বললেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই। যতোক্ষণ দরকার হয় থাকবো।’

ফেসবুকের চ্যাট অপশনে প্রিয় ভাই রমেনকে পেলাম। তার সঙ্গেও শেয়ার করলাম। তিনি ব্যাপারটি আগে থেকেই অবগত আছেন। আমি জানি, রমেন এই মহৎ কাজের জন্য যতোখানি সম্ভব করবেন। জহুর ভাই, বিশুদা, বাহার ভাই, শামসু ভাই, তপনদা, আরিফ ভাই, রিয়াজ ভাই, বুলবুল ভাই, সরওয়ার ভাই, সবুর ভাই, কমল, রেজা ভাই, পারভেজ ভাই, ফারুক ভাই, ফরিদ ভাই, উজ্জ্বল, নজরুল ভাই, মামুন ভাই, আসিফ ভাই, মিন্টুদা, ইমরান ভাই, বোন লিপি, বোন এমেলিয়া খানম এবং আরও অনেকের কথা মনে পড়ছে। তারাও নিশ্চয়ই জানেন। মানুষের অধিকার রক্ষায় এই ভালো মানুষগুলো ইতোমধ্যে সমাজে অসামান্য অবদান রেখেছেন।

সবকিছু মিলিয়ে মনে হচ্ছে, বীর চট্টলার সমস্ত মানব নিজেদেরকে ‘প্রীতি’র বন্ধনে আবদ্ধ করে স্লোগান তুলবেন, ‘রেলপথে আর কোনো দুর্ঘটনা নয়, প্রীতি দাশ হত্যার বিচার চাই’। বীর চট্টলার সন্তানেরা এই স্লোগান বাস্তবায়ন করেও দেখাবেন। আমরা আর প্রীতিদের অপ্রীতিকর মৃত্যু দেখতে চাই না।

মোহাম্মাদ মাহাবুবুর রহমান: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ সচিব (প্রেষণ), পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

Friday, August 30, 2013

জঙ্গীবাদের সমর্থনে বানোয়াট তালিকার প্রবর্তক - ঠগ আদিলুর রহমানকে কারা সমর্থন দিচ্ছেন?কী উদ্দেশ্যে? -সুমি খান


শাপলা চত্বরে তান্ডবকারী জঙ্গীদের সমর্থনে বানোয়াট তালিকার প্রবর্তক ঠগ প্রবঞ্চক আদিলুর রহমানকে কারা সমর্থন দিচ্ছেন?কী তাদের উদ্দেশ্য ?
আমাদের চাক্ষুষ ঘটনার অপব্যাখ্যা যারা করে তারা যদি আমাদের অন্ধ সমর্থ্ন পায়- ভেবে দেখতে হবে- আমরা কি আমাদের সন্তানদের মঙ্গল চাই কি-না। বুঝে নিতে হবে আমরা সুস্থ সমাজের পক্ষে নই। শুধু দেশেই নয়- এই শক্তি এখন সর্বগ্রাসী। জঙ্গী টুন্ডা -আনসারুল্লাহর প্রশিক্ষণের কারণে নাফিস এর মতো অসংখ্য মেধাবী সন্তান কুপথে ধাবিত হয়েছে। এর জন্যে অন্যতম দায়ী তাদের দীক্ষা গুরু তেঁতুল শফি-বাবুনগরীদের হত্যাযজ্ঞে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সমর্থন। আদিলুর রহমান এবং তার দীক্ষাগুরু মাহমুদুর রহমানের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জঙ্গীবাদকে প্রকাশ্য সমর্থন। আর এই সমথর্ন যদি যাদের অঙ্গুলি হেলনে এই বিশ্বরাজনীতি ওলোটপালোট হয়ে যাচ্ছে - সেই মার্কিন শক্তির হয়- সন্দেহের আর অবকাশ থাকে না- এদেশ কে কোন্ দিকে ফেলে দেয়া হচ্ছে! এখানেই আমাদের প্রতিবাদ-এখানেই অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছি আমরা!
৫মে শাপলা চত্বরে হেফাজতের জঙ্গীদের হামলায় নিহত পুলিশের রিকুইজিশন গাড়ির চালককেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় নিহত বলে অধিকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।'অধিকার' এর তালিকাভুক্ত ৫মে পুলিশের হামলায় নিহত বলে দাবি করা ৬১ জনের ১ জন সিদ্দিকুর । তিনি ছিলেন পল্টন থানা পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক। হেফাজত কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে তিনি নিহত হন । সিদ্দিকুর রহমানের মরদেহ গ্রহণকারী ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কাজী সেলিম সরওয়ার বলেন," সিদ্দিকুর একজন ড্রাইভার । পুলিশের রিকুইজিশন করা গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করেছিলেন ৫ মে। হেফাজত কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা চালালে তিনি ওই হামলায় পল্টন এলাকায় মারা যান। এরপর আমি শ্রমিক নেতা হিসেবে তার লাশ গ্রহণ করি। তারপর পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করি। "

রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে গত ৫ মে মধ্যরাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে '৬১ জন' হেফাজত কর্মী নিহত হওয়ার যে তালিকা মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার দিয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে ,সেই তালিকা অসঙ্গতিপূর্ণ। নারায়ণগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত ছয় ব্যক্তিকেও হেফাজতের বিরুদ্ধে শাপলা চত্বরে পুলিশের অভিযানে নিহত বলে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। অধিকারের তালিকায় থাকা তিন ব্যক্তি এখনও জীবিত। শুধু তা-ই নয়, তালিকায় পাঁচ ব্যক্তির নাম দু'দফায় লেখা হয়েছে। কোথাও তাদের নামের পূর্ণ অংশ, আবার কোথাও তাদের নামের অর্ধেক অংশ ও পদবি লিখে তালিকা বড়ো করা হয়েছে। মতিঝিলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার কামাল উদ্দিন খান । তাকেও শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলায় মৃত বলে ৫৭ নম্বরে তালিকাভুক্ত করা হয়। এই তালিকায় ক্রমিকনম্বরের ভুল সহ অসংখ্য অসঙ্গতি রয়েছে।
অধিকারের তালিকায় একটি ক্রমিক নম্বর ভুল হয়েছে। ক্রমিক নম্বর ৯-এর পর ১০ নম্বর বাদ দিয়ে ১১ করা হয়। তালিকার ৬ নম্বরে লেখা হয়েছে নাহিদ; লাশ গ্রহণকারী শাজাহান। নাহিদের বয়স লেখা হয় ২১ বছর। লালগঞ্জ বিল্ডিং গলি, ৭ নম্বর গলি, ঢাকা। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলা হয়। একই ব্যক্তির নাম ২১ নম্বর ক্রমিকে লেখা হয়েছে মো. নাহিদ শিকদার, বয়স ২২ বছর। এখানে তার ঠিকানা লেখা আছে_ পিতা-দেলোয়ার শিকদার, গ্রাম-পাতারহাট, থানা-মেহেন্দীগঞ্জ, জেলা-বরিশাল; বাসা-২৭৪ জয়কালী মন্দির। তার বিরুদ্ধে পল্টন থানায় মামলার কথা উল্লেখ করা হয়। তালিকার ১৮ নম্বর ক্রমিকে লেখা আছে মাওলানা সিহাবুদ্দিন, বয়স ৩৫ বছর। প্রভাষক গানীয়াতুল মাদ্রাসা, থানা-সীতাকুণ্ড, জেলা-চট্টগ্রাম। ২০ নম্বর ক্রমিকে লেখা হয়েছে মাওলানা শিহাব উদ্দিন, বয়স-৩২ বছর, শিক্ষক_ বগাচতর ফাজিল মাদ্রাসা, গ্রাম-ডোমখালী, ইউনিয়ন-সাহেরখালী, থানা-মিরসরাই, জেলা-চট্টগ্রাম। একইভাবে ২৩ নম্বর ক্রমিকে লেখা আছে মো. সাইদুল বারী, বয়স-১৭ বছর। পরিচয় লেখা হয় মোহাম্মদপুর বাইতুল ফজল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র, গ্রাম-ইউসুফদিয়া, থানা-গালতা, জেলা-ফরিদপুর। একই শিশুকে ৪২ নম্বর ক্রমিকে পরিচয় নিহত হিসেবে দেখিয়ে লেখা হয় হাফেজ সাইদুর রহমান। এখানে বয়স উল্লেখ করা হয়নি। পিতা-মৃত সিরাজুল ইসলাম। গ্রাম-ইউসুফদিয়া, থানা-সালথা, জেলা-ফরিদপুর। একইভাবে তালিকাভুক্ত মাওলানা আতাউল্লাহর নাম ১৬ ও ৫৮ নম্বর ক্রমিকে দু'দফায় লেখা হয়েছে। ১৬ নম্বরে তার নাম লেখা হয়েছে হাফেজ আতাউর রহমান। ৫৮ নম্বরে একই ব্যক্তির নাম লেখা হয় মাওলানা আতাউল্লাহ। এমনকি মতিঝিলের হেফাজতের তাণ্ডবের সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া কামাল উদ্দিনকে অধিকারের তালিকাভুক্ত করা হয়।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা 'অধিকার' সম্প্রতি দাবি করে, মতিঝিলে শাপলা চত্বরে ৫ মে রাতের অভিযানে ৬১ হেফাজত কর্মী নিহত হয়। এ তালিকা পাঁচটি দেশি-বিদেশি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা হয়। পুলিশ অধিকারের তালিকায় থাকা ৬১ ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধান করে এসব অসঙ্গতি পেয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তত্ত্বাবধানে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ অধিকারের তালিকার ব্যাপারে এই তদন্ত করে।

গত ১০ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ৬১ জনের নাম-ঠিকানা চেয়ে 'অধিকার'কে চিঠি দেওয়া হয়। অধিকার সরকারকে তালিকা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা জানায়, তদন্ত কমিশন গঠন করলে ওই তালিকা কমিশনের কাছে দেবে। এরপর তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ১০ আগস্ট রাতে অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেফতার করে ডিবি। এরপর জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা আদিলুর রহমানকে মুক্তি দিতে সরকারকে চাপ দেয়। শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে আড়াই হাজারের বেশি হেফাজত কর্মী নিহত হয়েছে বলে প্রথমে দাবি করে হেফাজত। এ ছাড়া শাপলা চত্বরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হয়।


পুলিশ জানিয়েছে, হেফাজতের তাণ্ডবের সময় নারায়ণগঞ্জে নিহত ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী পলাশ (ক্রমিক নম্বর ৫০), পথচারী সাদেক হোসেন, রুবেল, আবদুল হান্নান, মাহফুজ খানসহ ছয়জন ভিন্ন জায়গায় নিহত হয়েছে। সাদেক হোসেনের বাবা রইস মিয়া বলেন, আমার ছেলে ঝাড়ের পানির ফিল্টার দোকানে আনা-নেওয়ার কাজ করত। ৬ মে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের কাঁচপুরে ঝাড় আনতে গেলে হেফাজত-পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে। সেখানে সে মারা যায়। হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে আমার ছেলের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অধিকারের তালিকায় তাদের শাপলা চত্বরে নিহত বলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । এমনকি অধিকারের ৬১ জনের তালিকার ১৯ জনের কোনো অস্তিত্বই নেই। তারা হলেন_ মো. মাসুম বিল্লাহ, লুৎফুর রহমান, মাওলানা মোহাম্মদ হাসান, হাফেজ লোকমান হোসেন, আল-আমিন, মাওলানা জুবায়ের, মো. শফিউল্লাহ বাদল, বাবু গাজী, মো. সোহেল, সেকান্দার আলী, ফকির ইবনে মাইজুদ্দিন ফকির, মো. সুলতান, রাজীব, মাওলানা মুতীয়র রহমান, সাবি্বর, তাহের, সাইদ, জালাল আহমেদ ও সিরাজুল।অধিকারের প্রতিবেদনে তাদের অধিকাংশের নামের সামনে পূর্ণাঙ্গ কোনো ঠিকানা লেখা হয়নি। শুধু জেলার নাম লেখা হয়েছে।

অধিকারের প্রতিবেদনে নিহত বলে উল্লেখ করা তিনজনকে জীবিত পাওয়া গেছে।এদের মধ্যে সোহেল উজানী মাদ্রাসার ছাত্র। বাড়ি-চাঁদপুর। এ ছাড়া রাজশাহীর বাগমারার জাহিদুল ইসলাম সৌরভ ও কুমিল্লার জসিম উদ্দিন রয়েছেন।অধিকারের তালিকায় ৫৭ নম্বর ক্রমিকের জসিম উদ্দিন , ৪৯ নম্বর ক্রমিকের মুতীয়র রহমান ও ৩৬ নম্বর ক্রমিকের জাহিদুল ইসলাম সৌরভকে মৃত বলে দাবি করা হয়। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনায় যে ১৩ জন নিহত হয়েছে বলে সরকার স্বীকার করেছে, অধিকারের তালিকায় তাদের মধ্যে ৯ জনের নাম রয়েছে। পুলিশের ধারণা, তালিকাভুক্ত অন্যরা পৃথক ঘটনায় পৃথক স্থানে মারা যেতে পারেন। তাদের ব্যাপারেও অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

অধিকারের পরিচালক এসএসএম নাসির উদ্দিন এলানের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, অধিকারের কার্যালয় থেকে জব্দ করা ল্যাপটপ থেকে এ তালিকা পাওয়া গেছে।
অধিকারের 'কথিত' তালিকা

৫মে হেফাজতের সমাবেশে শাপলা চত্বরে যারা নিহত হয়েছে বলে দাবি করে অধিকার তালিকা দিয়েছে, তারা হলেন
১. দিনাজপুরের সিদ্দিকুর রহমান
২.দক্ষিণ পাইকপাড়ার একেএম রেহান আহসান
৩. যাত্রাবাড়ীর কাজী রকিবুল হক
৪.গাজীপুর কালীগঞ্জের মো. ইউনূস
৫. মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের দ্বীন ইসলাম
৬. ঢাকার লালগঞ্জের নাহিদ
৭. ফরিদপুরের কোতোয়ালির মো. আল-আমিন,
৮. ময়মনসিংহের ভালুকার মাওলানা আবদুল ওয়াহাব মোল্লা,
৯. ফরিদপুরের দুর্গাপুরের হাফেজ আল-আমিন ও ফরিদপুরের মধুখালীর হাফেজ সাদ্দাম,
১০. নারায়ণগঞ্জের কটনমিল জামে মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ মাসুম বিল্লাহ,
১১. ময়মনসিংহ ফুলপুর থানার সুতিয়াপাড়া গ্রামের লুৎফর রহমান,
১২. নরসিংদী দাইয়েরপার গ্রামের নজরুল ইসলাম,
১৩. যশোর রায়পাড়া গ্রামের হাফেজ মোয়াজ্জেমুল হক নান্নু,
১৪. ময়মনসিংহ ফুলপুর সুতিয়াপাড়া গ্রামের হাফেজ আতাউর রহমান,
১৫.ভোলা দৌলতখানের মুহাম্মদ আকবর ইবনে নজরুল ইসলাম
১৬. চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ডের গানীয়াতুল মাদ্রাসার প্রভাষক মাওলানা সিহাবুদ্দিন,
১৭. কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার তেলিগাংদিয়া গ্রামের শামসুল আলম,
১৮. চট্টগ্রামের মিরসরাই বগাচর ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা সিহাব উদ্দিন,
১৯. বরিশাল পাতারহাটের নাহিদ সিকদার
২০. বরিশাল ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনুস মোল্লা
২১. ফরিদপুরের গালতার মোহাম্মদপুর বাইতুল ফজল ইসলামিয়া মাদ্রাসার ছাত্র সাইদুল বারী
২২. নরসিংদী উত্তর বাখরনগর গ্রামের মোক্তার হোসেন
২৩. গাজীপুর শফিপুর হরিণাহাট গ্রামের মাওলানা শামসুল আলম
২৪. নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পাগারপার ফোরকানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ হাসান
২৫. নরসিংদীর মাটিরপাড়ার বকুলতলা গ্রামের হাফেজ মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান জুবায়ের
২৬. কুমিল্লার নাঙ্গলকোটের মাওলানা মাহমুদুল হাসান
২৭. নারায়ণগঞ্জের বাবুরাইলের হাফেজ লোকমান হোসেন
২৮. নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার রামারবাগের আল-আমিন
২৯. মুন্সীগঞ্জের বালুচরের সাপেরচর এলাকার মাওলানা জুবায়ের
৩০. গাজীপুরের কালীগঞ্জের দুরবাটি এলাকার শফিউল্লাহ বাদল
৩১. চাঁদপুরের কচুয়ার সেনবাড়ীর দায়চর গ্রামের হাবিবুল্লাহ মুন্সী
৩২. ময়মনসিংহের খলিফার পাড় মাশকান্দা পলিটেকনিক মোড় এলাকার সিরাজুল ইসলাম
৩৩. শরীয়তপুরের নড়িয়ার বাবু গাজী
৩৪. রাজশাহীর বাগমারার নিমাই কাশারীর জাহিদুল ইসলাম সৌরভ
৩৫. চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার ছাত্র আনোয়ার
৩৬. চট্টগ্রামের মেখল মাদ্রাসার ছাত্র শাহাদাত
৩৭. কুমিল্লার দাউদকান্দির সোহেল
৩৮. বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার শিববাদীর কাতলা এলাকার সেকান্দার আলী ফকির
৩৯. একই এলাকার ইবনে মাইজুদ্দিন ফকির
৪০. চাঁদপুরের শেখদী গ্রামের মাহফুজ খান
৪১. ফরিদপুরের সালথা থানার ইউসুফদিয়া গ্রামের হাফেজ সাইদুর রহমান
৪২. নোয়াখালীর মাওলানা আনোয়ার হোসেন
৪৩. বরিশালের মুলাদীর তায়েফা গ্রামের হারুনুর রশিদ
৪৪. রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কোনাবাড়ী এলাকার সুলতান
৪৫. ডেমরার কাজলা ভাঙ্গা এলাকার রাজীব
৪৬. নরসিংদীর রায়পুরার আদিয়াবাদ মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুল হান্নান
৪৭. চাঁদপুর উজানী মাদ্রাসার ছাত্র সোহেল
৪৮. কুমিল্লার মাওলানা মুতীয়র রহমান
৪৯. নারায়ণগঞ্জের মাদানীনগরের ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী পলাশ
৫০. ঢাকার ডেমরার বক্সনগরের সাদেক হোসেন
৫১.ঢাকার ডেমরার রুবেল
৫২. ঢাকার ডেমরার সাবি্বর
৫৩. ঢাকার ডেমরার তাহের
৫৪.ঢাকার ডেমরার আবু সাঈদ
৫৫.কুমিল্লার জসিম উদ্দিন
৫৬. ঢাকার মতিঝিলের জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির ম্যানেজার কামাল উদ্দিন খান
৫৭. গাজীপুরের টঙ্গীর মোদাফানা মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা আতাউল্লাহ
৫৮. পটুয়াখালীর ইব্রাহিম খলিল
৫৯.শরীয়তপুরের জালাল আহমেদ
৬০.কুমিল্লার সিরাজুল ইসলাম।

http://khoborbangla.com/

Thursday, August 29, 2013

আপনাকে ধন্যবাদ- হাসান মাহমুদ



৩১শে আগস্ট ৩০ মুক্তিসন (২০০০ সাল)(৪০ মুক্তিসন ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ৩১শে আগষ্টে আমি এটা পোষ্ট করি - হাসান মাহমুদ)

আবার এগিয়ে আসছে ভয়াল সেই ৩১শে আগষ্ট। আজ আবার আপনাকে হৃদয়ের গভীরতম স্পন্দন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, যেমন জানিয়েছি গত ২৫টি বছরের প্রতিটি ৩১শে আগষ্টে। জানাতে থাকব যতদিন বেঁচে আছি.
আপনাকে দেখেছি মাত্র কয়েক সেকেণ্ড। আপনিও আমাদের দেখছেন মাত্র কয়েক সেকেণ্ড, তাই নিশ্চয় আমাদের কথা আপনার মনে নেই। কিন্তু আপনি যদি ১৯৭৫ সালে ৩১শে আগষ্টে সন্ধ্যায় তেজগাঁ এয়ারপোর্টে (তখনও নুতন এয়ারপোর্ট হয়নি)কর্মরত ইমিগ্রেশন-বস্‌ হয়ে থাকেন, আপনাকে জানাতে চাই আপনাকে আমরা দু’জন কখনো ভুলিনি। পৃথিবীর যেখানেই থাকি এই দিনে আমরা ফোনে সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতিচারণ করি আর আপনার উদ্দেশ্যে বলি - ‘‘আপনাকে অনেক, - অনেক ধন্যবাদ’’।

প্রতিটি বিপ্লবের সরব ধ্বংসের পর আসে প্রতিবিপ্লবের নীরব ধ্বংস। এসেছিল বাংলাদেশেও, একাত্তরের পর। সবার হাতে অস্ত্র - ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তারুণ্য-শক্তি। মতের ভিন্নতা, জেদ, অনভিজ্ঞতা, লোভ আর প্রতিহিংসা-পরায়ণতায় আরো অনেক জীবন ধ্বংস হয়েছিল যা ইতিহাসে জায়গা পায়নি। আমার সদ্য পাওয়া চাকরীটা যায় যায় কারণ অফিসে যাওয়া-আসাও তখন কঠিন। মরিয়া হয়ে আমি আর মঞ্জু দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছি। আর্থিক গরীব দু’টি তরুণ – টাকা, যোগাযোগ, গন্তব্য কিছু ঠিক করা নেই - শুধু চেষ্টা চলে যাবার - অন্য কোথা, অন্য কোনখানে। বিস্তর মহাভারত পার হয়ে ফ্লাইট পাওয়া গেল ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫।
গন্তব্য দুবাই। জায়গাটা মধ্যপ্রাচ্যে এইটুকু শুধু জানি - ওখানে আমাদের কেউ নেই।

হিমালয় টলে গেল ভোর রাতে, সপরিবারে খুন হয়ে গেলেন জাতির পিতা। ফ্লাইট বাতিল।আবার অসহ্য অপেক্ষা। ৩১ আগষ্ট বিকেলে মঞ্জু ছুটে এল - দু ঘন্টা পরে ফ্লাইটের সিট পাওয়া গেছে, এখনি পৌঁছতে হবে এয়ারপোর্ট। বাবা-মা ভাইবোন কেউ জানল না, তড়িঘড়ি সামনে কাপড় যা ছিল আর এমএসসি'র সার্টিফিকেট স্যুটকেসে ভরে ছুট। ততক্ষণে সবাই ভেতরে ঢুকে গেছে - প্লেন ছাড়ে ছাড়ে । ইমিগ্রেশন-ক্লার্কের হাতে পাশপোর্ট টিকিট তুলে দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি। উত্তেজনায় কিছু হার্টবিট মিস হয়ে যাচ্ছে, চোখেমুখে খুব গরম লাগছে - পা দু’টো পাথরের মত ভারী। কারণ, - আমাদের পাশপোর্ট ‘‘খারাপ’’. আমাদের টিকিটও ‘‘খারাপ’’।

লোকটা পাশপোর্ট-টিকিট দুটো লম্বা সময় হাতে ধরে থাকল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। তারপর মরা মাছের চোখের মত ভাবলেশহীন চোখে আমাদের দিকে অপলক তাকাল, - চুপ করে তাকিয়েই থাকল। তার মানে তার অভিজ্ঞ চোখে আমরা ধরা পড়ে গেছি। আমরা জন্ম-ক্রিমিন্যাল নই, পারফেক্ট ক্রাইম করতে পারিনি। ভয় পাবার শক্তিও তখন আমাদের নেই। প্রচণ্ড মানসিক চাপে উত্তেজনায় প্রায় অজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভয়ে আতংকে মঞ্জু শক্ত করে চেপে ধরেছে আমার হাত।
ওদিকে প্লেন ছাড়ে ছাড়ে।


তখন আপনি এলেন, ইমিগ্রেশন চীফ। ঠিক এলেন না, গটগট করে ওদিকে কোথা থেকে কোথা যেন যাচ্ছিলেন। ক্লার্কটা কিউবিক্‌ল থেকে বেরিয়ে আপনার কাছে গেল, আপনি থমকে দাঁড়ালেন। সে আপনাকে পাশপোর্ট-টিকিট দেখিয়ে কি যেন ফিসফিস করল। আমরা তখন দু’টো স্থির মৃতদেহ দাঁড়িয়ে আছি। আপনি আমাদের দিকে ফিরে তাকালেন - আতংকে ত্রাসে পাথর আমরা আরো পাথর হয়ে গেলাম।

এই ৩৭ বছর পরেও হুবহু এখনো কানে বাজে আপনার জলদগম্ভীর কন্ঠস্বরে জীবনের বরাভয় - ‘‘লেট দেম ট্রাই দেয়ার লাক্‌’।

বলেই আপনি গট গট করে চলে গেলেন। লোকটা ফিরে এসে আমাদের পাশপোর্টে ষ্ট্যাম্প মেরে আমাদের বিদায় করল। ছুটে এসে প্লেনে উঠলাম, প্লেন আকাশে উঠল, বুক তখনো ধ্বকধ্বক করছে। আতংকে উত্তেজনায় মঞ্জুর তখন খুব জ্বর উঠে গেছে, আমার হাত ধরে সে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল - ‘‘এভাবে আমরা কোথায় যাচ্ছি? আমাদের কি হবে? আমাদের টাকা কই’’?? তখন খোলা বাজারে বিদেশী মুদ্রা বেআইনী ছিল, মঞ্জু কোত্থেকে একশ পাউণ্ড জোগাড় করে এক মাস্তান-চীফকে দিয়েছিল। কথা ছিল তার লোক প্লেনের মধ্যে আমাদের ওই টাকা দেবে। সে টাকা এলনা। তার মানে আমরা কপর্দকশুন্য।



পরের মহাভারত বলে আপনার সময় নেবনা কিন্তু দু’টো কথা বলতেই হবে। দুবাই-ইমিগ্রেশন ক্লার্কের চোখও অভিজ্ঞ ছিল, ধরা আমরা সেখানেও পড়েছিলাম। কিন্তু সেখানে সেই মাঝরাতে আপনার মত ইমিগ্রেশন চীফ ছিলনা যিনি দুটি অনভিজ্ঞ তরুণের সামনে জীবনের দরজা খুলে দেবেন। আমাদের পাশপোর্ট আটক হল, আমরাও আটক হলাম। কেউই বোধহয় জানেনা প্রতিটি বিমানবন্দরে ছোট্ট একটা জেলখানা থাকে। সারা রাত বন্দী থেকে পরদিন দুপুরে আমরা দুজন সেখান থেকে কিভাবে পালালাম সেকথা থাক, কি অবস্থায় পালালাম সেকথা বলে শেষ করি।

তখন আমাদের (১) পরণের কাপড় ছাড়া কোন কাপড়, স্যাণ্ডেল-টুথব্রাশ-রেজর-চিরুণী কিচ্ছু নেই কারণ স্যুটকেস চিরতরে কোথায় হারিয়ে গেছে, কোনদিনই আর সেগুলো ফিরে পাইনি. (২) কোন শিক্ষা-সার্টিফিকেট নেই, কারণ ওগুলো স্যুটকেসে ছিল, (৩) পকেটে একটা পয়সা নেই, (৪) কোন বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজন নেই, (৫) জায়গা চিনি না, (৬) ভাষা জানি না, (৭) ভিসা নেই, কারণ (৮) পাশপোর্টই নেই. আর, এই সবগুলোর চেয়ে আরো অনেক মারাত্মক - (৯)আগষ্টের মধ্যপ্রাচ্য, দোজখের গরম!!

কিন্তু আপনি জেনে রাখুন আপনার শুভেচ্ছা ব্যর্থ হয়নি। সবদিক দিয়ে ভয়াবহ অবস্থা থেকে শুরু করে সেই দুটি তরুণ দানবের শক্তিতে জীবন-যুদ্ধ করেছে এবং পরিপুর্ণ সফল হয়েছে। এখন তারা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দু’টো দেশের বৈধ নাগরিক। সাধারণ মানুষের যা চাইবার তা সবই তারা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয় তারা আপনার ঋণ শোধ করার চেষ্টাও করেছে- বেশ কিছু কিশোর-তরুণদের লাক্‌ ট্রাই করার সুযোগ করে দিয়েছে। যাদেরকে দিয়েছে তাদের অনেকেই আজ জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, - তারাও একদিন পরের প্রজন্মকে সুযোগ করে দেবে। সমাজ এভাবেই এগোয়, মানুষই মানুষের কাজে আসে।

আপনি যেখানেই থাকুন শান্তিতে থাকুন এই কামনা করে আবারো বলি - আপনাকে অজস্র ধন্যবাদ।