Wednesday, August 14, 2013

বঙ্গবন্ধুর ধর্মানুভূতি ও কিছু কথা :অধ্যক্ষ আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী




১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবস। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে শাহাদত বরণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। কালের চক্রে একুশটি বছর পার হয়েছে। কিন্তু অপবাদের চাকা এখনো থামেনি। মিটিং, মিছিলে, নির্বাচনে, এমনকি সিরাতুন্নবী সম্মেলনে চলছে অপপ্রচার। স্বার্থান্বেষী মহল যারা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায় বা ধর্মের বেসাতি করে রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকার অপপ্রয়াস চালায়, তারাই জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিবকে ভয় পায়। তাই মৃত ব্যক্তিকে নিয়েও এই টানা হেঁচড়া। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়া ফরমান জারি করেছিলেন, মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে রাজনীতি করা চলবে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছুদিন যেতে না যেতেই বেগম জিয়াকেও মৃত ব্যক্তির নামে রাজনীতি করতে হয়।

কি অপরাধ ছিলো এই রাখাল রাজার, এই মুকুটহীন সম্রাটের? যৌবন গেছে জেলে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন বেশ ক’বার। মাথা নোয়াননি। আপস করেননি পশ্চিমা শোষকের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপও তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তাইতো হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি আজ স্বাধীন। ইতিহাসের মহানায়ক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ একুশটি বছর সরকারিভাবে অনাদৃত, অবহেলিত, রেডিও টেলিভিশন থেকে নির্বাসিত তাঁরই সৃষ্টি স্বাধীন দেশে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাওয়া যাবে না, কি অদ্ভুত ফরমান। সত্যি বিচিত্র এদেশ সেলুকাস! মুক্তিযোদ্ধারা পথে পথে ক্ষমতার মসনদে রাজাকার।

বঙ্গবন্ধুর অপরাধ সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দ দু’টি সংযোজন করেছিলেন। যদিও তিনি বার বার বলেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। যার ধর্মে সে বিশ্বাসী হয়ে নিজ নিজ ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করার আহবান জানিয়েছিলেন। তাঁর এই সহজ সরল কথাগুলোকে অপব্যাখ্যা করে তাঁকে কেউ নাস্তিক, কেউ হিন্দু ঘেষা আবার কেউ ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর কোন অনুরাগ ছিলো না বলে অপপ্রচার চালায়। সরলপ্রাণ বাঙালি মুসলমানেরা অনেকাংশে বিভ্রান্তও হয়। এহেন হীন ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ও ধর্মানুভূতির সঠিক মূল্যায়ন করার বাস্তব চেষ্টা তেমন হয়নি। এর দায়ভার আপনার আমার সবার। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই। আজ সময় এসেছে জনমনের সেই সংশয় সন্দেহ দূর করার।

“লাকুম দ্বীনকুম অলিঅদিন।” “লা ইকরা ফিদ্দিন”।
এগুলোতো কোরআনেরই আয়াত। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা স্বয়ং স্রষ্টাই নিষিদ্ধ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসের দিকে তাকালেও আমরা দেখি, রসুলে করিম (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিযরত করেন, তখন তাঁর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই শুধু মুসলমান। মদিনায় যাঁরা ছিলেন তাঁরা সবাই ইহুদি, নাছারা। আল্লাহর সবচেয়ে পেয়ার নবী ইচ্ছা করলে সবাইকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে মদিনা শরীফে ইসলামি শাসন কায়েম করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি ইহুদি নাছারাদের ডেকে এক জায়গায় বসে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়ে মদিনা শরীফের জন্যে একটি বিশেষ শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। সেই চুক্তির নাম ‘মদিনাসনদ’-দুনিয়ার প্রথম লিখিত সংবিধান। এই সনদের প্রথম শর্তে মদিনার সকল অধিবাসীর ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে যার ধর্ম সে বিনা বাধায় পালন করার অধিকার দিয়েছিলেন। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টানদের মিলিত রক্ত স্রোতের মধ্যে দিয়ে যে দেশের জন্ম বঙ্গবন্ধু সেই দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটি সংযোজন করলে কেমন করে ইসলাম বিরোধী কাজ হয়, আমার বোধগম্য নয়।

আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একজন নগণ্য কর্মী হলেও তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো। তাঁকে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ লক্ষ্য করেছি। কর্মকাণ্ড দেখেছি এবং বক্তব্য শুনে আমার এই দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে যে, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান এবং মানব প্রেমিক। আল্লাহর প্রতি তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস না থাকলে ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাতে গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারতেন না। পারতেন না পাকিস্তানি কারাগারে অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাঙালির প্রাণের দাবি স্বাধীনতা প্রশ্নে অনঢ় থাকতে। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন-হায়াত, মউত, রিজিক ও দৌলত একমাত্র আল্লাহর হাতে। আল্লাহ না মারলে কেউ তাঁকে মারতে পারবে না তাইতো ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা না ভেবে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও প্রটোকল বেষ্টনীর বেড়াজাল ছিন্ন করে মানুষের মাঝে চলে যেতেন। সম্পূর্ণ নিরাপত্তাহীন অবস্থায় নিজ বাসভবনে অবস্থান করতেন। তাঁর ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল বলেইতো বাংলাদেশের সংবিধান পাস করিয়েছিলেন শবে-কদর রাতে। অনৈসলামিক ভেবেই তো মদ জুয়ার বিরুদ্ধে আইন করে নিষিদ্ধ করেছিলেন। কোরআন হাদিসের উপর গবেষণা করার জন্যেই তো বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের সৃষ্টি করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে কওমী মাদ্রাসাগুলো কোনদিন সরকারি সাহায্য পায়নি। ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যেইতো বঙ্গবন্ধু সরকারি বেসরকারি মাদ্রাসা নির্বিশেষে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এবং পৃথক মাদ্রাসা বোর্ড সৃষ্টি করে সকল মোদাররেসিন কে সরকারী কর্মচারীর মতো রেশন ভাতা দেওয়ার নীতি চালু করেছিলেন। তাবলীগের জামাতের লোকদের সুবিধার্থে কাকরাইল মসজিদটি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তুরাগ নদীর পাড়ে বিশ্ব এস্তেমার জন্য পাঁচশত একর জমি বন্দোবস্তি দিয়েছিলেন যিনি, তিনিইতো বঙ্গবন্ধু।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ। সৌদি সরকারের স্বীকৃতি নেই। ভাণ্ডারে বৈদেশিক মুদ্রারও দারুণ অভাব। হাজিদের যাতায়াতের জন্যে স্টিমার বা বিমান কিছুই ছিল না। বাঙালি মুসলমানদের হজ্বে যাবার দাবিও ওঠেনি। হজ্বের মৌসুম এলে শুধু ধর্মানুভূতির কারণেই লন্ডন থেকে একটি বিমান ভাড়া করে প্রতি হাজী থেকে ৪৭০০/= টাকা করে নিয়ে পাঁচ হাজার হাজীর হজ্ব প্রতিনিধিদলে নেতা করে আমাকেই সৌদি আরব পাঠিয়েছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষনা করলেও বাংলাদেশকে অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিস (ওআইসি)-এর সদস্য করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাশিয়াতে কোনদিন তাবলিগ জামাত যেতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৭৩ সালে রাশিয়াতে প্রথম তাবলীগ জামাত যাবার সুযোগ পায়। বায়তুল মোকাররম মসজিদটি খাস জমির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই জমিটুকু বায়তুল মোকাররম মসজিদের নামে বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ সালে ইহুদিরা যখন মিশর আক্রমন করে, এই বাংলাদেশ থেকেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বঙ্গবন্ধু প্রথম আওয়াজ করেছিলেন, “আরব ভাইরা, আমি জানতে পেরেছি, গত রাতে ইহুদিরা তোমাদের উপর আক্রমন করেছে। আমার নতুন স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশ। আমার কিছুই নেই। আমার আছে রক্ত। রক্ত নিয়ে যাও। আহত আরব ভাইদের বাঁচাও। আমার আছে চা, চা পাঠালাম। আর আছে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পাঠালাম। তারা তোমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ইহুদির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। আরব ভূমি মুক্ত রাখবে।” আজো তো সেই মুক্তিযোদ্ধা মাঝে মাঝে লাশ হয়ে ফিরে আসে বাংলার মাটিতে।

এছাড়াও দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে স্পষ্টত অনুধাবন করা যাবে, কি ছিল বঙ্গবন্ধুর মন মানসিকতা, কি ছিল তাঁর ধর্মানুভূতিতে? বাকশাল গঠিত হওয়ার পরেরদিন। ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫ সন্ধ্যা ৭টা। মন্ত্রিরা শপথ নিলেও দফতর বন্টন তখনো বাকি। কি একটা কাজে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করার জন্য গণভবনে গিয়েছি। দেখি, বঙ্গবন্ধু, সর্ব জনাব ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, কোরবান আলী, আবদুল মোমিন তালুকদারের সঙ্গে গল্প গুজবে মেতে আছেন। আমি আস্তে আস্তে করে দরজা ঠেলে ঢুকে সোফার একপাশ বসে তাঁদের কথা শুনেছিলাম। এমনি সময় বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিন একটি ফাইল হাতে ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাত হতে ফাইলটি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সেক্রেটারিয়েট টেবিলের পেছনের চেয়ারে গিয়ে বসলেন এবং ফাইলের উপর চোখ বুলাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখি, তিনি তাঁর পরিহিত মুজিব কোট থেকে একটি তজবিহ জপছেন এবং তজবিহ শেষ করে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম বলে ফাইল দস্তখত করে বললেন, “আল্লাহ এইবার হলেও তাঁদের সঠিক ভাবে কাজ করার তৌফিক দিন।” এই দৃশ্য আমার চোখে নতুন। তাই আনমনে একটি মুচকি হেসে ফেলেছিলাম। তিনি দেখে ঈষৎ রাগতস্বরে বললেন, “হাসলে কেনো? আফটার অল আই এম এ মুসলিম। আরবীতে একটি আয়াত পড়ে বাংলায় তর্জমা করে বললেন, লোক দেখানো ধর্ম পালন করা পূন্যের চেয়ে গুণাহ বেশি। আমি এমন কিছু করি না যা লোক দেখানো।” তখন আমি তো ভয়ে চুপসে গেছি। এক পর্যায়ে ফরাস উদ্দিন বললেন, স্যার আপনি কোরআন তেলাওয়াত করছেন যে আমি দেখেছি। কোথায় দেখেছো? কেমন করে দেখেছো, এই ধরনের প্রশ্ন অবতারণা তিনি করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তা না করেই পসঙ্গান্তরে চলে গেলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় সময় কোরআন তেলাওয়াত করতেন সেই কথা খোন্দকার মোশতাক সাহেবের (খুনি) মুখে একবার শুনেছিলাম। ১৯৭৮ সালে কক্সবাজারে বার্মিজ রিফিউজি আসলে রেডক্রমের অফিসারদের মুখেও শুনেছি। ঘূর্ণিঝড়ের সংকেত পড়লে তিনি জায়নামাজ বিছিয়ে বসে যেতেন, এবাদত করতেন, কোরআন তেলাওয়াত করতেন আর মাঝে মাঝে পার্শ্বে রক্ষিত টেলিফোন ধরে উপকূলীয় অঞ্চলের খবরাখবর নিতেন। তারই প্রমাণ আমি নিজে পেয়েছিলাম।

১৯৭৫ সালে আমি একদিন ঢাকায়। তার কয়েকদিন আগেই ঘূর্ণিঝড় কক্সবাজারে আঘাত হেনেছে। তিনি আমাকে দেখে ঘূর্ণিঝড়ের খবরাখবর নিলেন এবং হেসে বললেন তোমার ভাবী কি বলেছে জান? ‘এবার তোমার এবাদতে কোন কাজ হলো না।’ এর থেকে বোঝা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের রাতে তিনি যে এবাদতে করতেন। আমি তাঁকে জামায়াতে তারাবীর নামাজ আদায় করতেও দেখেছি। চৌদ্দশত বছর আগে রসুলে করিম (সঃ) মক্কা বিজয়ের পর কেরায়েশদের যেভাবে সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন, তারই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অপেক্ষাকৃত কম অপরাধী স্বাধীনতা বিরোধী আল বদর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের জন্যে তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করেছিলেন। এ ধরনের নজির চৌদ্দশত বছরের মধ্যে মুসলমানদের ইতিহাসে আছে কি? দুঃখজনক হলেও সত্য, যারাই তাঁর সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, তারাই বেশি তাঁর সমালোচনায় মুখর। স্বয়ং আল্লাহই বলেছেন অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে আল্লাহ ভালোবাসেন না।

যিনি সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দিয়ে, মুখবন্ধে বিছমিল্লাহির রহমানির রহিম লিখেছিলেন, তাঁর আমলে কি দেখেছি? মদ জুয়া আবার জায়েজ হয়েছে। জায়গায় জায়গায় আনন্দ মেলার আয়োজন করে হাউজি বাম্পার, প্রিন্সেস জরিনা সুন্দরী, প্রিন্সেস লাকি খানের নাচ দেখিয়েছেন আর যুব সমাজের চরিত্র হনন করেছেন। কওমী মাদ্রাসাগুলোকে সরকারি সাহায্য থেকে করেছিলেন বঞ্চিত।

কেউ কেউ বলতে পারেন, বঙ্গবন্ধু যদি এতই ইসলাম প্রেমিক হন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা যোগ করলেন কেনো? তারও জুতসই জওয়াব আছে। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা কি? শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগে পারিশ্রমিক দিতে হবে। সবার খাওয়া পরা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যেই বায়তুল মাল। অর্থ্যাৎ রাষ্ট্রীয় তহবিল। জাকাত ফেতরা প্রদানের নির্দেশ নামার লক্ষ্যই হচ্ছে সম্পদের সুষম বন্টন। আর সম্পদের সুষম বন্টনের কথাই বলেছে সমাজতন্ত্র। ইসলামী অর্থনীতি ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূল কথাই হচ্ছে, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর এবং মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা। দু’টির মধ্যে প্রক্রিয়াগত ভিন্নতা আছে, আদর্শ উদ্দেশ্য এক। ইসলামী অর্থনীতি আবর্তিত হয় আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আনুগত্য নিয়ে, আর সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয় বস্তু জগতের আইনের শাসনে। লক্ষ্য বিচার বিশ্লেষণে অর্থনৈতিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার সমাজতান্ত্রিক আবেদন রেখেছে এই পৃথিবীতে সর্বপ্রথম ইসলাম। সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্লমার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের জন্মতো অনেক অনেক পরের ঘটনা। বর্তমান জামানায় ক’জনই বা নীতিগতভাবে জাকাত দেয়? আল্লাহকে আমরা সবাই ভয় করি। সত্যিকার অর্থে যেমন ভয় করা উচিৎ, তেমন ভয় করে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করি কি? নিশ্চয় করে না বলেই মালিক শ্রমিককে ঠকায়। জিনিসে ভেজাল দেয়। মানুষকে অভুক্ত রেখে সম্পদের পাহাড় গড়ে। তাই প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রীয় আইনের। এই আইনের মাধ্যমেই বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়া নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি ঘোষনা করেছিলেন, “কোন দেশ থেকে আমার সমাজতন্ত্র জন্ম নেবে”।
তিনি শুধু একথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শুধু বস্তুজগত নিয়েই আবর্তিত হবে না। আধ্যাত্মিক ভাবধারা দিয়েও নিয়ন্ত্রিত হবে।

বিগত একুশটি বছর ধরে কারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত? একটু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, কিছু জমিদার-জোতদার, কিছু ধনিক-বণিক এবং কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্ম ব্যবসায়ী। কেনো তারা একুশ বছর পরেও তাকে ক্ষমা করতে পারছেন না? তার কারণ শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু কিছু আইন রচনা করেছিলেন, যেগুলো তাদের স্বার্থে আঘাত করেছিল। ভূমির সিলিং বসিয়ে একশত বিঘার ঊর্ধ্বের জমি সরকারিকরণ এবং সরকারি খাসজমি ধনিক শ্রেনীকে না দিয়ে ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে দেড় একর করে বিনা সালামিতে বিতরণের ব্যবস্থা করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় জমিদার জোতদার। পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত ব্যাংক বীমা কলকারখানা জাতীয়করণ করে শ্রমিক কর্মচারিদের অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা নিয়ে ধনিক বণিকের বিরাগ ভাজন হয়েছিলেন। ধর্ম ব্যবসায়িরা এতদিন ধর্মকে শোষন নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ধর্মের নামে পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যে আমার মা বোনের ইজ্জত লুটেছে। হত্যা করেছে লাখো বাঙালি। তাই বঙ্গবন্ধু ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে ক্ষীপ্ত হয়, স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আলবদর-রাজাকার। এই স্বার্থান্বেষী মহলের ভয়-মৃত মুজিব যদি আদর্শের মুজিব হয়ে বাংলার ঘরে ঘরে আবার আসে, তাদের আর রক্ষা নাই। তাই অপপ্রচার চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাটো করতে চায়। মানুষের মন থেকে তাঁকে দূরে রাখতে চায়। সেজন্যে ইতিহাস বিকৃতি। সেজন্যেই ধর্মের নামে হাত কাটে, রগ কাটে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির। আজ তারা ব্যর্থ। দীর্ঘদিন পরে হলেও বাংলার মানুষ বুঝেছে। তাই ১২ জুনের নির্বাচনে বাংলার বীর জনতা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, বঙ্গবন্ধু আদর্শের পক্ষে রায় দিয়েছে। সেই সুবাদে আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

বস্তুত বাংলাদেশটা স্বাধীন হয়েছে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ খ্রিস্টানের, মিলিত রক্ত দানে। ইসলাম নীতির ধর্ম। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইনসাফের ধর্ম। সেই ইনসাফই কায়েম করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ধর্মভীরু মানুষ চেয়েছিলেন, ধর্মান্ধ নয়।

স্মৃতি বড়ো মধুর। স্মৃতি বড়ো বেদনাদায়ক। সেই বেদনাদায়ক স্মৃতির কথাই বলছি। ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাত্র কটা দিন আগে। আমাকে গণভবনে দেখে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “সরওয়ার, এবার আমি হজ্বে যাব”।
তখন অনেক মন্ত্রী, গভর্নর তার পাশে। মন্ত্রী সোহরাব হোসেন বললেন, “এবার আমাকে পাঠান স্যার আমাকে পাঠান”।
প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “নারে না, তোদের অনেক সময় রয়েছে, আমার সময় ফুরিয়ে আসছে, এবার আমি হজ্বে যাব” সে কথাগুলো আজো আমার মনে বাজে। পঁচাত্তরের ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সে সুযোগ দান করেনি।


রেফারেন্স: সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে, লুৎফর চৌধুরী সম্পাদিত, পৃষ্ঠা ৫৩।

Wednesday, August 7, 2013

আমাদের ঈদ- সুমি খান


বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আমাদের ঈদ
১৯৭১ সাল। চট্টগ্রামের পশ্চিম পটিয়ার বরউঠান গ্রামের জমিদার এবং গভর্নমেন্ট প্লীডার মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁর মসজিদ ও স্কুলের মাঠে ঈদের নামাজ শুরু হয়েছে। মসজিদ পুকুরের সিঁড়িতে দুই শিশুকে গোসল করাচ্ছেন এক বিপ্লবী!
এক বছর ও তিন বছর বয়সী দুই শিশুকে গোসল করাতে গিয়ে বিপ্লবী বারবার বলে যাচ্ছেন-“ আহা! একটু তাড়াতাড়ি করো! আমি তো ঈদের নামাজটা মিস্ করলাম মনে হয় আজ!”
এই বিপ্লবী এবং মুক্তিযোদ্ধার নাম কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগো। পটিয়ার কেলিশহর জমিদার পরিবারের সন্তান তিনি । ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি–ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা দলের অন্যতম সংগঠক সাইফুদ্দিন খানের সূত্রে তার বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এবং এর আগে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনেক পরিবার।
একটা চিরকুটে স্বাক্ষর করে নাকি আব্বু ( সাইফুদ্দিন খান) অনেককে পাঠিয়ে দিতেন তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার জন্যে। এমন দুর্যোগের মাঝেও কনিষ্ঠ সন্তানের এমন ‘অন্যায় আব্দার’ এর ঝড় –অবলীলায় মেনে নিতেন তার বাবা মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ এবং বাড়ির অন্যরা।
সাইফুদ্দিন খানকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আলবদর রাজাকার বাহিনী। বাবার খোঁজে বাড়িতে রেইড দিয়ে গেছে পাকি সেনারা- “ কালাইয়া কাঁহা হ্যায়?” বাড়ির তরুণদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে গেছে। সিন্দুক লুট করে বাড়ির বৌ-ঝি দের হীরে আর সোনার গয়না লুট করে নিয়ে গেছে । পরে কিছু গয়না নাকি ফিরিয়েও দিয়ে গেছে শুনেছি।
আমার দাদু মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ কোলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজের আইন বিভাগের ছাত্র । দাদুমণি গ্রামে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট অনেক কিছুই করেছেন। শর্ত ছিল- কখনো যেন তার নামে কিছু করা না হয়।
তার বাবার নামে তিনি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাকে আমি দেখিনি। তবু বাবার কাছে শুনে জেনেছি কিছুটা। তার দীক্ষায় আমাদের শৈশব কেটেছে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে। একাত্তরে সবাই মিলে অসাম্প্রদায়িক ঈদ উদযাপন করেছেন-এমন ই স্মৃতিচারণ করতেন আমার বাবা-মা। দাদুমণি মৌলভী ফজলুর রহমান খাঁ সে বছরই মারা যান।
আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্ট নেতা কমরেড পূর্ণেন্দু কানুনগোকে ‘সেলিম ভাই’ নামে চেনে তখন সবাই। যে শিশুদের তিনি গোসল করাচ্ছিলেন, তাদের মধ্যে ছোট জন আমি। অনেক বড়ো হয়ে জেনেছি, আমার জীবনের আদর্শ -আমার সবচেয়ে প্রিয় সেলিম চাচ্চুর আসল নাম পূর্ণেন্দু কানুনগো।
ঈদের দিন সবার মাঝে চাচ্চু নিজের পরিচয় আড়াল করার জন্যে আমাকে আর ভাইয়াকে খুব ধীরে সুস্থে গোসল করাচ্ছিলেন আর তাড়া দিয়ে বলছিলেন, তার নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে! আব্বু- আম্মু খুব মজা পাচ্ছিলেন এসব দেখে! গ্রামের লোকজনও অনেক পরে জেনেছে চাচ্চুর আসল পরিচয়!
শৈশবের স্মৃতিতে মনে পড়ে, আমাদের বিশাল বাড়িতে সাত গ্রামের হিন্দু-মুসলিম- জেলেপাড়া সব ধরনের মানুষ আসতো । ঘরের গরুর দুধে তৈরি সেমাই , গুরাপিঠা আরো নানান নাশতা দিয়ে বড়ো জে-আম্মা, মেজ আম্মা, আম্মু অক্লান্ত আতিথেয়তা করছেন।
কতো মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছেন ঢেঁকি ঘর, রান্নাঘর, দেউড়ি ঘর, পূবের ঘর- সবখানে বড়ো আপা, বড়ো ভাইয়ারা আড্ডা দিচ্ছেন- কী মধুর সব স্মৃতি!
আমাদের বাপ্পু ডা. কামাল এ খান ছিলেন ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক –এক অসাধারণ মানবতাবাদী! চট্টগ্রাম বন্দর এর প্রধান চিকিৎসক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে বিশাল বাংলো ছিল তার । ঈদের চার/পাঁচ দিন আগে সেখান থেকে চার সাম্পানে করে আমরা বাড়ি যেতাম।
আমাদের পারিবারিক মাঝি ছিল। মতলব মাঝি ছিল তাদের প্রধান। দাদুমণির পর বাপ্পুর প্রখর ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ নেতৃত্ব পুরো পরিবারকে অসাম্প্রদায়িক রাখতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছিলো। আর ছোট ভাই হিসেবে আব্বু নিজের মতো করে নিভৃতে কাজ করে যেতেন গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে।
আরেকটি স্মৃতি খুব মনে পড়ে। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা অন্নদাচরণ দত্ত লেনে আমাদের তিন/চার পুরুষের ভিটে। যার অনেকটাই দখল হয়ে গেছে। ১৯৭৬ সালে বাবা আর মা তাদের ব্যাংকের চাকরির বেতন থেকে হোমলোন কেটে খুব সাধারণ একটি বাড়ি করেন এই জায়গায়। নিতান্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই যাকে বলে।
এই বাড়ির চিলেকোঠায় একটা ছোট্ট রুম করে বাবা বলেছিলেন, এই ঘরটি চিরজীবন আন্ডারগ্রাউন্ড বাম নেতাদের জন্যে। ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত ভাষা সৈনিক মওলানা আহমেদুর রহমান আজমী ছিলেন এই ঘরটিতে।
আজমী চাচ্চু খেতেন আমাদের সঙ্গে, ঘুমাতেন এই চিলেকোঠায়।
১৯৮৩ সালের দিকে সেই বাড়িটির গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া নেন ‘যুগান্তর’কর্মী ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী সীতানাথ দাস এর পুত্র স্কুল শিক্ষক রঞ্জন রশ্মি দাস। আমাদের অনেক শ্রদ্ধার অনেক প্রিয় ‘দাদা’। তার স্ত্রী সুচন্দা দাস দোলা- আমাদের চিরদিনের ভীষণ প্রিয় ‘দিদি’ চট্টগ্রাম বন্দরে চাকরি করতেন। তার প্রথম সন্তান টুম্পা তখন আড়াই বছরের ফুটফুটে এক মেয়ে। ১৯৮৪ সালে এ ঘরেই জন্ম নিলো দাদা এবং দিদির একমাত্র পুত্র জনি। আমাদের সবকিছুতে তাদের সম্পৃক্ততা আর অংশগ্রহণ অনিবার্য।
আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। কেন যেন সেবার আমাদের বাড়ি যাওয়া হয় নি। আব্বুর গ্যাস্ট্রোলজি প্রবলেমের কারণে বড়ো রকমের অপারেশন হয়েছিলো সেবার । তাই মনে হয় যেতে পারি নি আমরা বাড়িতে।
যে কারণে এতোগুলো বিষয়ের অবতারণা- ১৯৮৪ সালের ঈদের দিন দিদি আমাকে, আমার ছোটভাই অমিকে আর ভাইয়াকে ডাকলেন। ঈদের দিনের সেই সকালে কপালে লাল সিঁদুরের বড় ফোঁটা, পাটভাঙ্গা শাড়ি পরা সদ্যস্নাতা সুন্দর দিদিকে কী যে স্নিগ্ধ আর সুন্দর লাগছিলো দেখতে!
আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই দিদি কিছু টাকা গুঁজে দিলেন আমাদের হাতে! কতো টাকা সেটা মনে নেই। শুধু মনে আছে এই টাকা বা ‘বখশিশ’ এর মধ্যে কী পরম ভালোবাসা আর আন্তরিকতা ছিল দিদির! প্রশ্ন আসে মনে –কেন দিদি প্রতি বছর ঈদে আমাদের ‘বখশিশ’ দিতেন?
খুব সামান্য চাকরি করতেন। দাদা-দিদির টানাটানির সংসারে আমরা তিন ভাই-বোন কে? কেন দিদি প্রত্যেক বছর ঈদের বখশিশ দিতেন? দিদির চেহারায় একটা অসহায়ত্ব ছিল- লুকিয়ে টাকাটা দিয়ে যেন তার অতৃপ্তি রয়ে গেছে- যতোটা চাইছেন যেন পারেন নি!
আমার অনেক স্মৃতি দিদির প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে! অন্নদাচরণ দত্ত ছিলেন মাস্টার’দা সূর্যসেনের আইনজীবী। তার বাড়িটি দখল হয়ে নিশ্চিহ্ণ এখন। তার নামে করা রাস্তাটি এখন কাগজেপত্রে এ সি দত্ত লেন- সেই নাম ও মানুষের মুখে বিলীন। আদালত ভবন, কোতোয়ালী থানা, সিএমপি হেড কোয়ার্টার, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার, লালদীঘির সঙ্গে সংযুক্ত গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে বড়ো সুইপার কলোনির নামে পরিচিত হয়েছে গত ২৫ বছর । কী দুর্ভাগ্য আমাদের!
সেই রাস্তাটি দিয়ে হাঁটলেই দিদির কথা মনে পড়ে। আমাদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্কে সম্পৃক্ত দিদি হঠাৎ কবে যেন মারা গেছেন। আমরা জানতেও পারি নি। টুম্পা আর জনির বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গেছি । আর দিদির শূন্যতা অনুভব করে নিজের অজান্তেই বারবার চোখ ভরে গেছে জলে।
আরেকটা ঘটনা মনে পড়ছে। ১৯৮৪ সালে আব্বু চট্টগ্রাম মেডিকেলে অপারেশনের জন্য ভর্তি। কমরেড অনঙ্গ সেন আব্বুকে দেখতে গেছেন প্রতিদিনের মতো। আব্বুর পাশের বেডের বয়স্ক রোগী অনঙ্গ চাচ্চুর সঙ্গে খুব আড্ডা জমালেন। কারণ- লম্বা, সাদা দাড়ি নিয়ে চাচ্চু দেখতে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো।
চাচ্চু তো আরবী ভাষা, হাদিস কোরান সবই জানতেন। আড্ডা বেশ জমে গেলো। আব্বু খুব মজা পেলো- যখন মাগরেবের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনঙ্গ চাচ্চুকে পানি আর ইফতার সাধলেন সেই রোগী। চাচ্চু বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে অচেনা নিরীহ মানুষটির অনুরোধ রক্ষা করলেন।
এই তো আমাদের সমাজ! এই তো আমাদের সাধারণ মানুষ! ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে ভালোবাসা আর আন্তরিকতা যেখানে সবার আগে!! জয় হোক মানবতার! জয় হোক ভালোবাসার!

সুমি খান: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, sumikhan29bdj@gmail.com

Tuesday, August 6, 2013

৭২তম প্রয়াণ দিনেও অনিবার্য চিরদিনের রবীন্দ্রনাথ



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ৭২তম প্রয়াণ দিবস আজ বাইশে প্রাবণ। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে চিরপ্রস্থান করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ বাঙ্গালীর মন আর মননে চিরঅম্লান । মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ওপর দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষই পারে অসুরের উন্মত্ততাকে ধ্বংস করে পৃথিবীতে সুরের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে। তাই ‘সভ্যতার সঙ্কট’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেনÑ ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।’ ১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। কিন্তু ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে সেই উপাধি বর্জন করেন রবীন্দ্রনাথ।
সমাজের কল্যাণেও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সমাজকল্যাণের উপায় হিসেবে তিনি গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামের দরিদ্র জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলার পক্ষে মতপ্রকাশ করেন। এর পাশাপাশি সামাজিক বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের দর্শনচেতনায় ঈশ্বরের মূল হিসেবে মানব সংসারকেই নির্দিষ্ট করা হয়েছে। তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে কর্মী অর্থাৎ মানুষ ঈশ্বরের পুজোর কথা বলেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ চিরদিনের। চির নতুন তিনি। সবসময় প্রাসঙ্গিক। বাঙালীর চেতনার রঙ স্পষ্ট হয়েছিল রবির আলোয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে বহুমাত্রিক অবদানে সমৃদ্ধ করা এই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালীর প্রতিটি আবেগ আর সূক্ষ্ম অনুভূতিকে স্পর্শ করে আছেন। আজ ৭২তম মৃত্যুবার্ষিকীর দিনেও অনিবার্য তিনি। তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী।

হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর সাহিত্য। ১৯১৩ সালে ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। তাঁর এ প্রাপ্তি বাংলা সাহিত্যকে বিরল গৌরব এনে দেয়।
কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ জন্ম নেয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ কর্মের মাধ্যমে সূচনা করে গেছেন একটি কালের। একটি সংস্কৃতির। কৈশোর পেরোনোর আগেই বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বদলে দিতে শুরু করেন তিনি। ১৪ বছর বয়সে ব্রজবলী ভাষায় লিখেছেন ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী।

বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস ও ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসঙ্কলন প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সঙ্কলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় প্রকাশিত ও গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনা ৩২ খ-ে রবীন্দ্ররচনাবলী নামে প্রকাশিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কাব্যসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা চিত্ররূপময়তা, অধ্যাত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, বিশ্বপ্রেম, রোমান্টিক সৌন্দর্যচেতনা, ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। রবীন্দ্রনাথের গদ্যভাষাও কাব্যিক। ভারতের ধ্রুপদ ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তাঁর রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজ মতামত প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের গান বাংলা সঙ্গীত ভান্ডারকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করেছে।

বিপুল ঐশ্বর্য নিয়ে টিকে আছে রবীন্দ্রসঙ্গীত। এর আবেদন কোন দিন ফুরোবার নয়। বরং যত দিন যাচ্ছে ততই রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণী ও সুরের ইন্দ্রজালে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে বাঙালী। তাঁদের আবেগ অনুভূতি কবিগুরুর গানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জাতীয় সঙ্গীতেরও রচয়িতা তিনি। বহু প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রায় সত্তর বছর বয়সে নিয়মিত ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে অঙ্কিত তাঁর স্কেচ ও ছবির সংখ্যা আড়াই হাজারের বেশি। দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উৎসাহে ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে। এরপর সমগ্র ইউরোপেই কবির একাধিক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। তাঁর আঁকা ছবিতে আধুনিক বিমূর্তধর্মিতাই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ চার বছর ঘন ঘন অসুস্থতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে দু’বার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল কবিকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে গিয়েছিলেন। আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। তখন সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থ হওয়ার পর আর তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। প্রথম জীবনে ভানুসিংহের পদাবলীতে কবি লিখেছিলেন- মরণ রে,/ তুঁহু মম শ্যামসমান... মৃত্যু অমৃত করে দান। একইভাবে মৃত্যুকে জীবনের নিস্তাররূপে বর্ণনা করে তিনি উচ্চারণ করেন- প্রেম বলে যে যুগে যুগে, তোমার লাগি আছি জেগে, মরণ বলে আমি তোমার জীবনতরী বাই। জীবনের শেষ দিকে এসে কবি জীবনের প্রতি নিজের তৃষ্ণার কথা জানিয়ে লেখেন বিখ্যাত সেই পঙ্ক্তি- মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/ মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। বলাই বাহুল্য, মানবের মাঝে রবীন্দ্রনাথের বেঁচে থাকার স্বপ্ন শতভাগ পূর্ণতা পেয়েছে।
মহাপ্রয়াণ দিবসে আজ মঙ্গলবার বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সঙ্গীতের কিংবদন্তি পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করবে সারা বিশ্বের বাঙালী। তবে রমজানের কারণে এবার আনুষ্ঠানিকতা থাকবে কম।

Friday, August 2, 2013

নিঃসঙ্গ জামায়াত:সৈয়দ বশির


জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ঘোষণা করে হাই কোর্টের রায়ে দলটির সামনে আর তেমন পথ খোলা নেই। বিশেষত এই রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল সুপ্রিম কোর্ট খারিজ করে দিলে তাদের আর কিছুই করার থাকছে না।

নির্বাচন কমিশনকে এই রায় বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখতে দ্রুত রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দরকার জামায়াতের। তা না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সামনের কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না তারা।

এই দুঃসময়ে জামায়াত মূলত নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন।

পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য জামায়াত নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতার ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ করলেও আজ তারাও এই ইসলামী দলটির ব্যাপারে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘জামায়াত নিয়ে যা ঘটছে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’।

এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে নৃশংসতা হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না পাকিস্তানের বর্তমান সরকার। তাই জামায়াতকে তার নিয়তির ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন নওয়াজ শরীফের সরকার। তিনি নিজেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপারে খুব স্বাচ্ছন্দ্য নন, ১৯৯৯ সালে সেনাবাহিনীর হাতেই ক্ষমতাচ্যুৎ হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র থাকতে চাওয়ায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের পক্ষে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায় না তারা। কারণ এটা পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে খারাপ প্রচারণা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

নওয়াজ শরীফ হয়তো এখনো একাত্তরের ঘৃণ্য বর্বরতার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা ভাবছেন না। কারণ তাতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আবারো বৈরী মনোভাব তৈরি হতে পারে, যা তিনি সামাল দিতে সক্ষম নাও হতে পারেন। জামায়াতের পক্ষে কেন দাঁড়াবে! তারা বাংলাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় নয় এবং কখনো নিজেদের একার পক্ষে ক্ষমতায় আসারও সম্ভাবনা নেই। তাহলে পাকিস্তানকে অজনপ্রিয় করা কেন, জামায়াতের পক্ষে দাঁড়ালে যা তৈরি হতে পারে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার যথেষ্ট বিবেচনা বোধ সম্পন্ন নওয়াজ।

এবার আসা যাক জামায়াতের অভ্যন্তরীণ মিত্রদের বিষয়ে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ হিসেবে বিএনপি ও তার শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারেন।

কিন্তু বিএনপির জন্য এমন বড় কোনো কারণ নেই যে, তারা জামায়াতে সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং তার নিবন্ধনের জন্য লড়াই চালাবে।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সামরিক শাসন মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর থেকে নির্বাচনে জয় পেতে জামায়াতকে দরকার হয়েছে বিএনপির। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জামায়াতের বিতর্কিত অবস্থান বিএনপির জন্যও একটা বড় ধরনের বোঝা, যেহেতু এমন একটি দেশে তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে আছে যেখানে ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবারই ক্ষমতাসীনরা হেরেছে।
jamat-2
নিবন্ধন হারিয়ে জামায়াত যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তাহলে কী ঘটবে? জামায়াতের ভোটাররা কি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে! সম্ভবত কখনো তা হবে না। জামায়াতের ভোটারদের সামনে বিএনপিকে ভোট দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।

তাই ‘সরকার বিচার বিভাগকে প্রভাবিত’ করছে- এই সাধারণ সমালোচনার বাইরে জামায়াতের নিবন্ধনের জন্য বিএনপি বড় ধরনের কোনো হট্টগোল সৃষ্টি করবে না বলে ধারণা করা যায়। ব্যক্তিগতভাবে অনেক বিএনপি নেতা, বিশেষত যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা হয়তো জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে খুশি হয়েছেন। বিতির্কিত মিত্রকে ছাড়া বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের মতো করে লড়তে পারবে।

অন্য সব ইসলামপন্থী দল, যাদের সাধারণত জামায়াতের সহোদর হিসেবে দেখা যায় তাদের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া যাক। হেফাজতে ইসলামসহ তাদের অনেকে এতে সন্তুষ্ট হতে পারে। কারণ এতে জামায়াত এতোদিন কট্টরপন্থী ইসলামী রাজনীতির যে প্রতিনিধিত্ব করতো তার সেই সীমিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এই রাজনীতির পরিসর।

জামায়াত দৃশ্যের বাইরে চলে গেলে কট্টরপন্থী রাজনীতির জায়গা অন্যদের জন্য উন্মুক্ত হবে এবং তাদের এটাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে হেফাজতের মতো কিছু গ্রুপ এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে।

সত্যি বলতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নতুন প্রজন্মের কাছে জামায়াতের আসল চেহার উন্মুক্ত করেছে। গণমাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার খবর প্রকাশ হওয়ায় তা জাতির ঘৃণ্য ইতিহাসকে এই প্রজন্মের সামনে তুলে এনেছে। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা যে কোনো গর্বিত বাংলাদেশি তার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে রক্ষা করতে চাইবে। ইতিহাসের বিপরীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার জন্য দলটি কখনো এদেশের মানুষে হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবে না। এমনকি যারা কট্টরপন্থী ইসলামী রাজনীতির সমর্থক তারাও একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকাকে বাইরে রেখে ওই রাজনীতি করতে চায়। এদের মধ্যে জামায়াতের নতুন প্রজন্মও রয়েছে, যারা এমন একটি দল চান- সম্ভবত নতুন একটি- যাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ তাদের সঙ্গী হবে না।

এদিকে জামায়াত নিবন্ধন হারালে তাতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হবে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটানোর, যা কিছুটা থমকে পড়েছে সরকারের পক্ষ থেকে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনমনে যে বিতৃষ্ণা তৈরি হয় তা দূর করার গুরুত্বপূর্ণ পথ হতে পারে এই চেতনার জাগরণ।

তাই জামায়াত এখন নিজেকে নিঃসঙ্গ ও বন্ধুহীন অবস্থায় দেখছে। এই দলটি কি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে একটি সন্ত্রাসী দলে পরিণত হবে, দীর্ঘদিন ধরে যে আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে। এ প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারবে।

সৈয়দ বশির : সৈয়দ বশির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কলাম লেখক

সমকাল :: যেভাবে কবিতা এলো :: শামীম আজাদ

সমকাল :: যেভাবে কবিতা এলো ::

Tuesday, July 30, 2013

ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাঈয়ের দৈনন্দিন জীবন


আরিফ ইকবাল হোসেন

যে ভারতমাতা সদা ভুলের প্রতি দয়া ও মহানুভবতা দেখিয়ে বলেছেন ‘আমি দিব!’, ‘আমি দিব!’ সেখানে লক্ষ্মী বলেছিলেন, ‘আমি দিব না! আমি আমার ঝাঁসি ছেড়ে দিব না! কেউ আমার ঝাঁসি কেড়ে নিতে পারবে না; যার সাহস আছে সে চেষ্টা করতে পারে!’ঝাঁসির দুঃসাহসী রানী এ আহ্বানের মাধ্যমেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। ইংরেজদের বিতাড়িত করে ঝাঁসির রানী শুরু করেছিলেন তার রাজ্য শাসন। এ ইতিহাস আমাদের সবারই মোটামুটি জানা। কিন্তু লক্ষ্মীর দৈনন্দিন জীবনের কতটুকুই বা আমরা জানি। চলুন তাহলে জানা যাক।

জানা যায়, লক্ষ্মী বাঈ সকাল পাঁচটার সময় উঠে সুগন্ধি আতর দিয়ে স্নান করতেন। সাধারণত ধবধবে সাদা চান্দেরী শাড়ি পরে তার নিয়মিত প্রার্থনায় বসতেন। স্বামীর মৃত্যুর পরও মাথায় চুল রাখার অপরাধে জল ঢেলে প্রায়শ্চিত্ত করতেন; তুলসী পূজা করতেন তুলসীবেদিতে। তারপর দরবারের গায়করা যেখানে গান করতেন, সেখানে করতেন পার্থিব পূজা। পুরাণিরা পুরাণ পাঠ করা শুরু করতেন। তারপর সিরদাররা ও আশ্রিতরা এলে তিনি তাদের অভিবাদন জানাতেন।

সকালে যে সাড়ে সাতশ মানুষ তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসতেন তাদের মধ্যে একজনও উপস্থিত না থাকলে তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির ফলে পরের দিন তিনি তার না আসার কারণ জানতে ভুলতেন না। ভগবানের পূজা করার পর আহার করতেন। আহারের পর, এক ঘণ্টার বিশ্রাম নিতেন যদি না কোনো জরুরি কাজ থাকতো।

লক্ষ্মী বাঈ সকালের উপহার সামগ্রী তার সামনে আনার জন্য আদেশ করতেন যেগুলো রুপার থালার উপর রেশমি কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতো। যেগুলো তিনি পছন্দ করতেন তা গ্রহণ করতেন, বাকিগুলো কোঠিওয়ালাকে (উপহারশালার মন্ত্রী)- প্রজাদের মধ্যে বণ্টনের জন্যে দেওয়া হতো। সাধারণত তিনটের সময় পুরুষের পোশাকে তিনি দরবারে যেতেন। গাঢ় নীল রঙের জামা, পায়জামা ও মাথায় একটি সুন্দর পাগড়িসদৃশ টুপি পরতেন। কোমরে জড়িয়ে রাখতেন একটি নকশা করা দোপাট্টা, যার পাশে থাকত মূল্যবান রত্নখচিত তলোয়ার। এই বেশভূষায় তাকে গৌরীর মতো দেখাত।

মাঝে মাঝে তিনি নারীর পোশাকও পরতেন। তার স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি আর কখনো নথ অথবা সেরকম কোনো অলংকার পরেন নি। তার হাতে থাকতো হীরার বালা, গলায় মুক্তার ছোট মালা এবং কনিষ্ঠ আঙুলে একটি হীরার আংটি। তার চুলগুলো পিছনে বাঁধা থাকতো। সাদা অন্তর্বাসের সাথে তিনি একটি সাদা শাড়ি পরতেন। এভাবেই তিনি কখনও পুরুষবেশে, কখনও নারীবেশে দরবারে উপস্থিত হতেন।

দরবারে সমবেত ব্যক্তিরা কখনই তার সাক্ষাৎ পেত না। কেননা তার বসার কক্ষটি ছিল আলাদা এবং এটি দিয়ে শুধু দরবারের সভাকক্ষেই প্রবেশ করা যেত। স্বর্ণালঙ্কিত দরজাগুলো সুতি ছিট কাপড়ের সোনালি পর্দায় ঢাকা থাকতো। সেই রুমে তিনি নরম বালিশে ঠেস দিয়ে কোমল গদিতে বসতেন। দরজার বাইরে সবসময় দু’জন ভৃত্য রুপার গদা নিয়ে উপস্থিত থাকতো। রুমটির বিপরীতে লক্ষ্মণ রাও দিওয়ানজী গুরুত্বপূর্ণ কাগজ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তার পাশে বসতেন দরবারের রেজিস্ট্রার।

প্রখর বুদ্ধিমতী বাঈজি তার সামনে আনা যে কোনো বিষয় খুব দ্রুত উপলব্ধি করতে পারতেন এবং তার আদেশগুলো হতো স্বচ্ছ, নির্দিষ্ট ও চূড়ান্ত। মাঝে মাঝে তিনি নিজেই আইন প্রণয়ন করতেন। আইন প্রয়োগের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন এবং অধিকার ও অপরাধ সম্পর্কিত বিষয়ে যোগ্যতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। রানী ভক্তির সঙ্গে মহালক্ষ্মীর পূজো করতেন। প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার দেবীর মন্দিরে যেতেন যা পদ্ম ফুলে ভরা খালের পাড়ে অবস্থিত ছিল।

একদিন বাঈ মন্দির থেকে ফেরার পথে দক্ষিণ ফটক অতিক্রম করার সময় হাজার হাজার ভিক্ষুক তার পথ আটকে হাঙ্গামা বাধায়। তাই তিনি তার মন্ত্রী, লক্ষণ রাও পাণ্ডেকে এর কারণ অনুসন্ধান করতে বলেন। তাকে জানানো হলো যে মানুষগুলো খুবই দরিদ্র এবং অত্যধিক ঠাণ্ডায় কাবু, তাই তারা বাঈজীকে সদয়ভাবে তাদের অবস্থা বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছে।

বাঈজি এই দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য কষ্ট অনুভব করেন এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে আদেশ জারি করেন যে, চারদিন পর ভিক্ষুকদের একত্র করে তাদের প্রত্যেককে একটি মোটা জামা, একটি টুপি ও একটি সাদা বা কালো কম্বল দেওয়া হবে। তার পরের দিন শহরের সব দর্জিকে টুপি ও জামা তৈরির আদেশ দেওয়া হলো। নির্দিষ্ট দিনে ঘোষণা দেওয়া হলো রাজপ্রাসাদের সামনে সব ভিক্ষুকদের জড়ো হতে। দরিদ্র জনগণকেও এতে শামিল করা হলো। বাঈ সবাইকে কাপড় দিলেন এবং তারা খুশিমনে বিদায় নিলো।

নাথে খানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় যখন আহতদের শহরে আনা হলো তখন বাঈজি তাদের ক্ষতস্থানে পট্টি বাঁধার সময় জোর করে উপস্থিত ছিলেন। তার উপস্থিতি তাদের ব্যাথার উপশম ঘটালো এবং তাদের সুস্থতা কামনায় তার দয়া ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণে তারা নিজেদের ধন্য মনে করলো। রানী তাদের দুর্দশা দেখে পীড়িত হলেন, তাদের অলংকার ও মেডেল দিলেন, অভিনন্দন জানালেন এবং হতাশ হওয়ার পরিবর্তে সহানুভূতি দেখালেন আর মনে অনুভব করলেন, এরা রানীর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত থাকবে।

বাঈজীর মহিমা বর্ণনাতীত। বিশেষ বিশেষ দিনে তিনি কখনো পালকি আবার কখনো ঘোড়ার পিঠে চড়ে মহালক্ষ্মীর মন্দির দর্শনে যেতেন। পালকিতে যাওয়ার সময় সোনালি পর্দা এবং সোনালি ফিতা দিয়ে বাঁধা নকশী কাপড় দিয়ে ঢাকা থাকতো। যখন তিনি পুরুষ পোশাকে ঘোড়ার পিঠে যাত্রা করতেন, তখন তার পেছনে একটি সরু ও সুন্দর বাট্টি ভাসতো যা তাকে চমৎকারভাবে মানাতো।

সামরিক সঙ্গীত পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার জাতীয় পতাকা তার সামনে সামনে বহন করা হতো। দু’শ ইউরোপীয় পতাকা তাকে অনুসরণ করতো এবং একশ ঘোড়াচালক তার সামনে ও পাশে থাকতো। পালকির সঙ্গে আসতোত কারভারিস, মন্ত্রী, সামন্তপ্রভু ও ভাইয়া সাহেব উপসেনের মতো অন্য অফিসার। বাকিরা ঘোড়া নয়তো পায়ে হেঁটে তাকে অনুসরণ করতেন।

মাঝে মাঝে ফৌজদল যাত্রার সহগামী হতো। বাঈজি রাজপ্রাসাদ থেকে যাত্রা শুরুর সময় কেল্লার চৌঘাদা থেকে সুরেলা দেশপ্রেমের সঙ্গীত তৈরি করা হতো। দেশপ্রেমের আগুন সব সময় তার মনে জ্বলজ্বল করতো। আর তিনি যুদ্ধে তার দেশের সম্মান এবং শ্রেষ্ঠতার জন্য গর্ব বোধ করতেন। একটি দেশের জন্য সৌভাগ্যের বিষয় এমন প্রতিমা মেয়েকে রানী হিসেবে পাওয়া। এমন সৌভাগ্য ইংরেজদের কখনোই হয়নি। পাওয়া আলামতের ভিত্তিতে লক্ষ্মীর দৈনন্দিন জীবনের এতটুকুই জানা যায়।
লেখক: আরিফ ইকবাল হোসেন, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম


Monday, July 29, 2013

কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে- জামাতিরা সগর্জনে ছুটল কতল করতে--পাকিস্তানের বুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নি:সঙ্গ লড়লো আনোয়ার-মখদুম-হাশিম: তোমাদের লক্ষ সালাম- হাসান মাহমুদ


অজানা একাত্তর


একাত্তরের মার্চ-এপ্রিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের আকস্মিক আক্রমণে ছিন্নভিন্ন পূর্ব পাকিস্তান, ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর গণহত্যা-গণধর্ষণে রক্তে আর্তনাদে ভেসে যাচ্ছে দেশ। বহু মাইল স্রেফ পায়ে হেঁটে সীমানা পেরোচ্ছে লক্ষ লক্ষ আতংকিত গ্রামবাসী বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে। গ্রামবাংলার ধুলিধুসরিত পথে হাতে মাথায় ঘটি-বাটি নিয়ে গরু-ছাগলের রশি ধরে হাজার হাজার পথযাত্রীর ভীড়ে রাস্তায় বৃদ্ধার মৃত্যু রাস্তায় জন্মানো বাচ্চা। কে বিশ্বাস করবে সেই দাবানলের মধ্যে একাত্তরের এপ্রিলে রাজশাহীর ওপারে মুর্শিদাবাদ শরণার্থী শিবিরে এক কাপড়ে উপস্থিত এক পাঞ্জাবী তরুণ!চারদিকে তুমুল হৈ হৈ, ছুটে এসেছে ভারতীয় সৈন্যেরা। কি? না, আমার বাড়ী লাহোর কিন্তু আমি শরণার্থী, আমাকে খেতে দাও থাকতে দাও। ভাঙ্গা-বাংলায় কথা বলছে সে।

‘‘তারপরে কেটে গেছে কত শত কাল, তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল’’।
সাঁইত্রিশ বছর আগে ঘটনার ঘনঘটায় উন্মত্ত জীবন আজ গল্প হয়ে গেছে। বয়সের সব ঝড় বোধহয় এভাবেই থেমে যায় একদিন।

কটা বেড়াল-চোখ কাঁচা সোনা রঙ্গের সুঠাম সুদর্শন তরুণ আনোয়ার শাহেদ খান। যেন সিনেমার নায়ক। সাতষট্টি সালে ইÏটারউইং স্কলারশীপ নিয়ে লাহোর থেকে ফিজিক্স-এ অনার্স পড়তে এসেছিল, থাকত ফজলুল হক হলে। আমি তখন বায়োকেমিষ্ট্রিতে - ওই ফজলুল হক হলেই। কি করে যেন বন্ধুত্ব হল নিবিড়, নিবিড় থেকে নিবিড়তর। খেয়াল করতাম আমার কাছে কাছে থেকে অনুসন্ধিৎসু চোখে সে নিরীক্ষণ করছে আমাদের ওপরে পশ্চিমের নিপীড়ন আর শোষণ। আমি তখন ছাত্রলীগের চির-দুর্ভেদ্য দূর্গ ফজলুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং হল-সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক, উন্মত্ত দিন কাটছে রাস্তায় শ্লোগানে মিছিলে, বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ইতিহাস। কাছে থেকে থেকে দেখে দেখে আনোয়ার বুঝতে পারছে কেন আমাদের ছয় দফা, কেন ওদের এত উন্নতি আর আমাদের এত অবনতি। তার শের-শায়েরীর কাব্যিক মন ঠিকই ধরেছে ইসলামের নামে পাকিস্তানী রাজনীতির বিভৎস ঠকবাজী। তারপর সত্তরের নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে এল বিসুভিয়াসের বিস্ফোরণে। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউটে আমি আওয়ামী লীগের পোলিং এজেÏট, আমার সাথে উপস্থিত থেকে আনোয়ার স্বচক্ষে দেখল জনতার ভৈরব গর্জন। মৃদু হেসে পরিহাস করে বলল - ‘‘আব হাম্‌ আপকো অওর রোক্‌ নেহি সাক্‌তে’’ - আর আমরা আপনাদের ঠেকাতে পারব না।

তারপর সে স্বচক্ষে দেখল পঁচিশে মার্চের তা¨ব, জানল গণহত্যা, গণধর্ষণ। সময়ের জঠরে তখন জন্ম-যন্ত্রণায় নড়ে উঠছে পাকিস্তানের মাটিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিশ্বাস্য ভ্রূণ। পঁচিশে মার্চে বাজপাখীর আক্রমণে মুরগীর বাচ্চার মতন জাতি ছিটকে গেল চতুর্দিকে। সবাই ছুটল গ্রাম-জননীর সুবিশাল আশ্রয়ে, জননীও আগ্রহী হাত বাড়িয়ে কোটি সন্তানকে তুলে নিল তার সøেহ কোলে। কিন্তু আনোয়ার যাবে কোথায়? এখানে তো ওর কেউ নেই, দেশটা ওর চেনাও নেই। কেউ কেউ বলল আর্মির ব্যারাকে যেতে - ওটাই ওর নিরাপদ জায়গা। কিন্তু প্রাণের নিরাপত্তার চেয়েও সৈন্যদের প্রতি ঘৃণা তখন তার অনেক বেশী। আরেক বন্ধুর বাবা তখন রাজশাহীতে চাকরী করেন, সিলেটে বাড়ী। তার সাথে কোনমতে রাজশাহী পৌঁছুল আনোয়ার, তারপরে ঘাতক সৈন্যদলের ধাক্কায় সবাই সীমানা পেরিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে শরণার্থী শিবির। মে মাসে সেনাপ্রহরায় রাজশাহী ফেরা, সেনাপ্রহরায় ঢাকা এবং পরের মাসে সটান লাহোরে বাবা-মায়ের কোলে।

তারপর সে আমাদের পক্ষে হাতে তুলে নিল তার যুদ্ধের অস্ত্র, কলম। ইতিহাসে এই একটা অস্ত্র অসাধ্যসাধন করেছে বারবার। অত্যাচারীরা যে অস্ত্রকে সবচেয়ে বেশী ভয় করেছে তা হল এই, - কলম। আমাদের জীবন-মরণ মুক্তিযুদ্ধের অজানা অধ্যায় শুরু হল পাকিস্তানেও। ‘‘পদ্মা সুরখ হ্যায়’’ (রক্তাক্ত পদ্মা) নামে পশ্চিমা প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের পঁচিশ বছরের ঠকবাজী ও একাত্তরের গণহত্যা-গণধর্ষণের ওপর আনোয়ারের চাক্ষুষ নিবন্ধ ছাপা হচ্ছ্রে প্রতিদিন একসাথে লাহোরের দৈনিক মুসাওয়াত ও করাচীর দৈনিক ডন’-এর গুজরাটি সংস্করণে, ক্রমাগত তিরিশ দিন। হৈ হৈ পড়ে গেল দেশে। জামাতিরা ওকে কতল করার খোলাখুলি ঘোষণা দিয়ে দিল - সগর্জনে ছুটল ওকে কতল করতে। ছুটে এল সামরিক সরকারের পুলিশ আর গোয়েন্দা, নিজদেশে পরবাসী আনোয়ার লুকিয়ে গেল আন্ডারগ্রাউন্ডে।

আমাদের তবু দেশ ছিল গ্রাম ছিল, স্বাধীন বাংলা সরকার ছিল বেতার ছিল, চারদিকে সংগ্রামী জাতি আর মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি ছিল, আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল, শেষ সম্বল হিসেবে ভারতে আশ্রয় ছিল, ওর কি ছিল চতুর্দিকে অগণিত শত্রু ছাড়া? আকস্মিক আক্রান্ত হয়ে আমাদের তো যুদ্ধ ছাড়া উপায় ছিলনা, কিন্তু ওকে তো কেউ বাধ্য করেনি স্বজাতিরই বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে নামতে! এমনকি আমাদের সাথে ওর তো যোগাযোগও ছিলনা! তবু লড়ল আনোয়ার, পাকিস্তানের বুকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিঃসঙ্গ একা। হিংস্র সরকারের গণহত্যা-গণধর্ষণ তুলে ধরা, বাবা-মা ভাইবোন থেকে দুরে - চাকরী নেই উপার্জন নেই খাবার নেই থাকার জায়গা নেই - একে আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

এ হল লাহোর। আর করাচীর মখ্‌দুম?

একাত্তরের প্রথম দিকে জাহিদ মখদুম করাচীর প্রাণবন্ত তুখোড় ছাত্রনেতা। নির্বাচনে আমাদের বিজয়ের বিরুদ্ধে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র টের পেয়েই সে ছাত্রসমাজকে নিয়ে যুদ্ধে নামল। মিটিং মিছিলের শ্লোগান, দেয়ালে দেয়ালে হাজারো পোষ্টার, সংসদের সামনে বিক্ষোভ, চীৎকারে উত্তেজনায় কাঁপিয়ে তুলল করাচী। একের পর এক বিদ্রোহী নিবন্ধ লিখতে লাগল সিন্ধী দৈনিক ‘‘ইবারত’’-এ। দেশ-শাসন করার জন্য তোমাদের সৈন্যদলে নেয়া হয়নি, জনগণের পয়সায় হাতে অস্ত্র দেয়া হয় নি। নির্বাচনে পুর্ব পাকিস্তান জিতেছে, লক্ষ্মী ছেলের মতো তাদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্যারাকে ফিরে যাও। প্রমাদ গুনল ভুট্টো, প্রমাদ গুনল সরকার। এদিকে শুরু হয়ে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আক্রমণ, ধীরে ধীরে কাদায় পড়ছে নাপাক বাহিনী। ওদিকে সমন জারী হল গ্রেপ্তারের, পালাতে গিয়ে ধরা পড়ল মখদুম। তারপর লারকানা, জেকোবাবাদ, শুক্কুর আর হায়দ্রাবাদ কারাগারে তার শরীরের ওপর নেমে এল কেয়ামত। স্বীকার করো তুমি ভারতের গুপ্তচর, টাকাপয়সার লেনদেন আছে। স্বীকার করো তোমার সাথে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন যোগসুত্র আছে। লোহার রডের প্রহার, ইলেক্ট্রিক শক্‌, অন্ধকার সলিটারি কনফাইনমেÏেট ঘুমহীন, কখনো খাবারহীন পানিহীন বন্দী জাহিদ মখদুম। কতোদিন? মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়মাসের পরেও কিছুদিন। অথচ ‘‘ভুল করেছি’’-র মুচলেকা সই করলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হত - তার উঁচু সে মাথা সে কখনো নোয়ায় নি।

একেও আমি ‘‘পাকিস্তানের মাটীতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’’ বলব না তো কি বলব?

শুধু ওরাই নয়, খুঁজলে কাশ্মীরের হাশিম আর আশরাফ, করাচীর গোলাম মুহাম্মদ ল’ুন কিংবা মকবুল বাট-এর মতো অনেক নামই পাওয়া যাবে। একাত্তরে আমাদের সমর্থন করে চাকরী হারিয়েছেন উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা শাফা’য়াত হাসনায়েন। স্বাধীনতার পরে ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের কিংবদন্তী পুরুষ ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ - ক্ষমা চেয়ে গেছেন। ওদের লেখক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবি-সুশীল সমাজ অনেকবারই ক্ষমা চেয়েছে আমাদের কাছে। সেদিনও চাইলেন টরÏেটা আন্তর্জাতিক শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে ক্যানাডা লেখক-সংস্থার কর্তাব্যক্তি মুনীর সামী। বললেন, - ‘‘যে দানবের হাত পা’ ভেঙ্গে তোমরা বেরিয়ে গেছ সেই একই দানবের যাঁতাকলে আমরা এখনও পিষ্ট হচ্ছি। জানিনা পাকিস্তানের কপালে কি আছে’’।

‘‘মানুষের মন চায় মানুষেরই মন’’ - কবিগুরু। তাইতো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এতো দেয়া নেয়া, তাইতো বম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানী সালমা আগা, ‘‘শত্রুর দেশে’’ কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর সম্পর্কে সে দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন - ‘‘উন্‌কা গলে মে ভগওয়ান ঝরতা হ্যায়’’ (‘‘উনার কন্ঠে স্রষ্টা উৎসারিত হন’’ - লতা মুঙ্গেশকর) ।
তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যাÏট রোডের বাটা’র ম্যানেজার অডারল্যা¨ সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চট্যার্জী সুদুর নিকারাগুয়া’র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় এস-এল-আর হাতে, রবিশংকরের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসংগীত আর পশ্চিমা কর্ড, হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর মেঘ রাগিনীর সা-রে-মা-পা-ণি-র্সা আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙ্গালীনি সাবিনা ইয়াসমিন। আশ্চর্য্য নয় ? এত আগুনের মধ্যেও পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলী ডিরেক্টর অ্যামস্‌ গিতাই-এর ছবিতে অভিনয় করেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্যালেষ্টাইনী অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম ‘‘বৌদি’’ আর হিন্দু ‘‘মা’’য়ের সÞমরক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান।

এরই নাম মানবতার শক্তি, সংস্কৃতির শক্তি। তাই তো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর, এত ক্ষণস্থায়ী। এপারে এক ফোঁটা রক্তের পাশাপাশি ওপারে এক ফোঁটা অশ্রু গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্য - তা সে বার্লিনই হোক, ইংল্যা¨-আয়ার্ল্যা¨ই হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক, ইসরাইল-প্যালেষ্টাইনই হোক বা পাকিস্তান-বাংলাদেশই হোক। পিন্ডির অলিগলির ঠেলাগাড়ীতে ফল-সব্জী নিয়ে যে ঘর্মাক্ত লোকটা হাঁক দিয়ে বিক্রী করে বেড়ায় সে আমাদের শত্রু নয়। কোহাটের পাহাড়ে যে লোকটা পাথর ভাঙ্গে, যে নারীরা বাচ্চার হাত ধরে ঝিলাম-চেনাব-বিয়াস-সিন্ধু থেকে কাঁখে কলসীভরা পানি টানে তারা আমাদের শত্রু নয়। পাকিস্তানের মসজিদে নামাজে ব্রাশ ফায়ারে যারা রক্তাক্ত মরে পড়ে থাকে তাদের সাথে আমাদের নয়শ’ কুড়িটি বধ্যভুমির তফাৎ সামান্যই। আমাদের সবার শত্রু এক, এবং তারা কারা তা আমরা ভালো করেই জানি। এবং একাত্তরে তাদের পদলেহী ‘‘হাস্যমুখে দাস্যসুখে বিনীত জোড়কর, প্রভুর পদে সোহাগমদে দোদুল কলেবর’’ (কবিগুরু) বাংলাদেশী পিশাচরা কারা তা এদিকে আমরাও জানি ওদিকে আনোয়ার-মখদুমরাও জানে।

এ দানবকে পরাস্ত করা কঠিন, হিমালয়-বিজয় বা উত্তাল সমুদ্র-বিজয়ের মতই কঠিন। সুদুর নিউজিল্যান্ডের এডমন্ড হিলারি’র সাথে সুদুর নেপালের তেনজিং নোরপে’র মিলন ছাড়া এ দুর্গম হিমালয়-বিজয় অসম্ভব। সুদুর পর্তুগালের ভাস্কো-ডা গামা’র সাথে সুদুর ইয়েমেনী সমুদ্র-বিশারদ আবদুল মজিদের মিলন ছাড়া এ দুর্দান্ত সমুদ্র-বিজয় অসম্ভব। আজ যখন দানবের হাতে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মানবের সংগ্রামও তাই আন্তর্জাতিক না হয়ে উপায় নেই। তাই যখন আমাদের সাথে পাকিস্তানেও দাবী ওঠে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই তখন মনে পড়ে সেই একাত্তরেই কয়েকজন পাকিস্তানী বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল ওই পাকিস্তানের মাটিতেও, - ক’জন জানে!

অগ্নিবীণার দুর্দম বাদক! অসাধ্যসাধনের অদম্য সাধক!! বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পদক তোমাদের কপালে জোটেনি কিন্তু কোটি জনগণের তরফ থেকে তোমাদের লক্ষ সালাম।

- See more at: http://www.hasanmahmud.com/2012/index.php/all-articles/articles-in-bangla/literature/47-ojanaekattor#sthash.tQ9tfUvl.dpuf

Sunday, July 28, 2013

সৌদী বোগদাদীর উপস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গি সালাউলের টাকা ও ত্রাণ বিতরণ- সুমি খান




কক্সবাজার: কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নগদ টাকা ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন সম্প্রতি কারামুক্ত রোহিঙ্গা জঙ্গি হাফেজ সালাউল ইসলাম।

রোববার সকাল থেকে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালংস্থ রোহিঙ্গাদের মধ্যে এসব টাকা ও ত্রাণ বিতরণ করা হয়।

এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন, সৌদি নাগরিক আহমদ বোগদাদী ও তার ছেলে সাদ নিজামী, রোহিঙ্গা নেতা জালাল এবং মনজুর।

প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, সম্প্রতি কারামুক্ত রোহিঙ্গা জঙ্গি হাফেজ সালাউল ইসলামের অতিথি হিসেবে সৌদি নাগরিক আহমদ বোগদাদী গত কয়েকদিন আগে কক্সবাজার এসে কলাতলীর আবাসিক হোটেল ওশান প্যারাডাইসে অবস্থান করছেন।

রোববার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত তাকে সঙ্গে নিয়ে সালাউল ইসলাম অর্ধশত রোহিঙ্গা নারীদের মধ্যে নগদ সাত হাজার টাকা বিতরণ করেন। একই সঙ্গে প্রায় শতাধিক লোকজনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ত্রাণ বিতরণ করেন।

এদিকে, বিকেলে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ শেষে তারা কক্সবাজার শহরের মুহুরী পাড়ার জঙ্গি এলাকা হিসেবে পরিচিত হাফেজ সালাউলের মাদ্রাসায় বৈঠক করেন।

সূত্র আরো জানিয়েছে, অপর এক সৌদি নাগরিকের তত্ত্বাবধানে আরেকটি দল প্রায় তিন ট্রাক মালামাল কলাতলীর আরেক আবাসিক হোটেল হানিমুন রিসোর্টে মজুদ করে রেখেছে। সোমবার এসব ত্রাণ বিতরণ করা হবে। উল্লেখ্য, গত মার্চ মাসে টেকনাফের একটি মাদ্রাসায় গোপন বৈঠককালে পুলিশের হাতে আটক হন রোহিঙ্গা জঙ্গি সালাউল।
তার বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিন পেয়ে পুরোদমে জঙ্গি তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। রোববার ত্রাণ বিতরণকালে সৌদি নাগরিককে সেনাবাহিনীর অতিথি বলেও প্রচারণা চালাচ্ছেন সালাউল।এ ব্যাপারে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বাংলানিউজকে জানান, বিষয়টি তিনি অবহিত নন। খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। বাংলানিউজ

Tuesday, July 23, 2013

Abdullah Abu Sayeed explains the meaning of life and its abundance....

বাবা-মা এবং মামা বিশ্বজয়ী বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা নিলেন বিপ্লবী নিবেদিতা নাগ এবং নেপাল নাগের পুত্র সুজয় নাগ


চট্টগ্রাম: ‘একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের কলকাতার বাড়িটি ছিল ট্রানজিট ক্যাম্প। বাংলাদেশ থেকে দলে দলে লোকজন আসতেন। দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া ক্লান্তশ্রান্ত মানুষগুলোকে চিকিৎসা-শুশ্রূষা আর গন্তব্য ঠিক করে দিতেন বাবা-মা। বাবা বলতেন, যুদ্ধে যতটা বন্দুকের দরকার ততটা চিকিৎসাসেবা-ওষুধ দরকার।’
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সুহৃদ কমরেড নেপাল নাগ ও নিবেদিতা নাগের ছেলে এবং বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোসের ভাগিনা প্রকৌশলী সুজয় নাগ বাংলানিউজকে এসব কথা বলেন।
যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘তখন আমি জামশেদপুর থাকতাম। শনিবারে বাড়ি আসতাম। প্রতি সপ্তাহে এসে দেখতাম নতুন নতুন লোকজন। বাবা-মা বলতেন আগের সপ্তাহের লোকজন চলে যাওয়ার পর আরও দু-একটি দল ইতিমধ্যে চলে গেছে। খুব কাছে থেকে সেবামূলক কাজ দেখার, করার সুযোগ পেয়েছিলাম।’
শনিবার বাংলাদেশ সরকারের ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বাবা-মা ও মামার পক্ষে সম্মাননা স্মারক নিতে এসেছিলেন ছেলেসহ সুজয় নাগ। এরপর মায়ের স্মৃতিবিজড়িত চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে আসেন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা, পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইকবাল হোসেনের আমন্ত্রণে। তার কথায় উঠে আসে কিংবদন্তিতুল্য বাবা-মা’র আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনৈতিক জীবন, শৈশবের নানা অনিশ্চয়তা, যুদ্ধকালীন নানা ঘটনা, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি। শোনা যাক তার মুখেই-
শৈশবে আমার নাম ছিল সুজাউদ্দিন!
কমরেড নেপাল নাগ ও নিবেদিতা নাগের ছেলে হওয়ার কারণে আমাকেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে পরিচিত হতে হয়েছে। ঢাকার অনেক বন্ধু তখনও জানত না সুজাউদ্দিন নামে পরিচিত আমার আসল নাম সুজয় নাগ। তারা জানত আমি রহমান ভাই (নেপাল নাগ) ও রিজিয়া ভাবির (নিবেদিতা নাগ) ছেলে। বাবার বন্ধুরা আমাকে ডাকতেন ‘টিটো’।
‍বাবা ডাকতেন ‘মন্টু’।
অবশ্য বাবাও বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিলেন পার্টির কমরেড ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছে। কখনো শৈলেশ নাগ, কখনো পরেশদা।
বাবা-মা’র কারণে শৈশব কেটেছে আন্ডারগ্রাউন্ডে
১৯৪৫ সালে আমার জন্ম। কয়েকবছর পরই দেশ ভাগ হলো। বাবা-মা পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির কাজ করার দায়িত্ব নেন। ১৯৪৮ সালে সরকার পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে। দমবন্ধ অবস্থা। কখনো দাদুর বাড়ি কলকাতায়, কখনো মাদারীপুরে বা ফরিদপুরে মা’র ছোট কাকার বাড়িতে। বেশিরভাগ সময় কেটেছে ঢাকার আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনে কিংবা শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের তাঁতির বাড়িতে। একটি বিষয় বলতে দ্বিধা নেই, আমার মা একমাত্র জীবিত ভারতীয় ভাষাসৈনিক। তিনি ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে দুবার অনশন ধর্মঘট করেছিলেন। একবার ৩৮ দিন, আরেকবার ৪০ দিন।
আমি ছিলাম সেক্রিফাইসের ভিকটিম
বাংলাদেশসহ ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার-প্রসারে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বাবা। তাকে অহর্নিশ প্রেরণা ও সাহস জুগিয়ে তিলে তিলে নিঃশেষ হয়েছেন মা। কখনো বোরকা পরে মুসলিম সেজে মা পালিয়ে বেঁচেছেন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে। সঙ্গে আমিও। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাবা-মা’র অকৃত্রিম সহযোগিতাসহ সব ক্ষেত্রে আমি ছিলাম সেক্রিফাইসের ভিকটিম। একাত্তর কিন্তু একাত্তরে জন্মায়নি। একাত্তরের ভিত্তি বাহান্নে।
৭ দিন পরই বিদ্রোহ করেছিলাম
একপর্যায়ে ডেমরাতে এক তাঁতির বাড়িতে রাখা হয়েছিল আমাকে। তখন আমার বয়স ছিল ৪ বছর। যাতে হুলিয়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বাবা নদী পেরিয়ে মাঝেমধ্যে এসে দেখে যেতে পারেন। ১৯৪৯ সালে মা ছিলেন তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ। আমি কিন্তু ৭ দিন পরই বিদ্রোহ ঘোষণা করি, খাওয়ার কষ্ট, থাকার কষ্ট। ওই তাঁতির বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। আরেকবার আমি বাবার সঙ্গে মস্কো গেলাম, হোটেল থেকে বেরোতেই দিল না, রাজনীতিবিদের ছেলে বলেই।
কলমি শাক দেখে হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন মা
মা ছিলেন ঢাকা জেলা মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সম্পাদিকা। এর আগে চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ও চট্টগ্রাম নারী সমিতির (পরে আত্মরক্ষা সমিতি) সম্পাদিকা ছিলেন। চট্টগ্রামে মা থাকতেন তার দাদা জ্ঞানেন্দ্র লাল দত্তের কাছে। কিছু দিন পর ঢাকা শহরের মুসলিম গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হন। ১৯৪১ সালে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী মা, ছিলেন তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ। ইলিয়ট, শেকসপিয়র মুখস্থ বলতে পারতেন। সে যাই হোক একদিন গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে ছিলেন মা। পথে কলমি শাক দেখে গাড়ি থামালাম। কয়েক আঁটি নিলাম। অমনি মা হাউহাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর শান্ত হলে কারণ জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘সেই উত্তাল দিনগুলোর কথা মনে পড়েছিল। উনি (বাবা) ছিলেন পার্টির বিপ্লবী সদস্য। তখন সকালে ছোলা ভিজানো, দুপুরে কলমি শাক আর ভাত এবং রাতে ভাতের ফ্যান ও নুন খেতে হতো আমাদের। এভাবে চলত দিনের পর দিন। তোমার মনে পড়ে সেই‍ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে তাঁতির বাড়ি থেকে ফিরে আসার কথা।’
বাবা চেয়েছিলেন রাজনীতি করি
আমৃত্যু অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির স্বপ্ন দেখা বাবুজি (বাবা) চেয়েছিলেন আমি রাজনীতিতে যুক্ত হই। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আগেই বলেছি আমি বড় হয়েছিলাম আন্ডারগ্রাউন্ডে। ১৯৪৭ সালে থাকতাম কলকাতার বড়বাজারে এক পার্টি কমিউনে। মাড়োয়ারিদের মধ্যে মিশতাম বলে আমিও বাবুজি, মাইজি ডাকতে শিখেছিলাম বাবা-মাকে। অবশ্য আমার বোন মুন্নি ঢাকার পার্টি কমিউনে বড় হয়েছিল, সে বাবা-মাকে ডাকত আব্বা আম্মা।
যাই হোক, উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর একদিন বাবুজি বললেন, ‘তুমি কি রাজনীতি করতে চাও না আর কিছু ভাবছ?’ আমি বললাম, ‘রাজনীতি করব না।’ কারণ রাজনীতির জন্য বাবা-মা’কে দেখেছি অমানবিক কষ্ট, লাঞ্ছনা আর দুর্ভোগ পোহাতে। আমি শ্রদ্ধা করতাম, বাবার জন্য গর্ব হতো। কিন্তু ওই বন্ধুর পথ মাড়াতে চাইছিলাম না। আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এটা ঠিক ‘আমার সিদ্ধান্তে বাবা আপত্তি করেননি, পরে বুঝেছিলাম দুঃখ পেয়েছিলেন অথচ মুখে কিছুই বলেননি।
বাবার উপদেশ ছিল ‘সাহায্য করো, চিল হতে চেষ্টা করো’
বাবা আমাকে বলতেন, ‘যে সাহায্য চাইবে তাকে সাহায্য করবে। সাহায্য করতে ইচ্ছেশক্তি লাগে, পয়সা লাগে না। কখনো মনে করো না যে, যাকে সাহায্য করবে সে তোমায় মনে রাখবে। তাহলে কষ্ট পাবে।’
টাটা কোম্পানিতে চাকরিতে যোগ দেওয়ার জন্য ট্রেন ধরব। হাওড়া স্টেশনে গেলাম। ট্রেন ছাড়ার আগমুহূর্তে বাবা বললেন, ‘নতুন চাকরিতে যাচ্ছ। মনে রেখ কাকও পাখি আবার চিলও পাখি। কাক নিচে ওড়ে খাবার দেখলে সবাই মিলে ঠোকরায়। কোনোটা পায় কোনোটা পায় না। চিল অনেক উপরে ওড়ে। কিন্তু খাবার দেখলে নিচে এসে খাবার নিয়ে আবার উপরে চলে যায়। চাকরি জীবনে চিল হওয়ার চেষ্টা করো।’
মামা আইনস্টাইনের মতো না শিখেই অদ্ভুত ভায়োলিন বাজাতেন
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মামা সত্যেন্দ্রনাথ বোস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টি করেছিলেন। বিশেষ করে বিশ্বের বাঘা বাঘা বিজ্ঞানী, দার্শনিক, চিন্তাবিদ পর্যায়ের ব্যক্তিত্বদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। এসব আলোচনা থাক। অন্য প্রসঙ্গে যাই। আমার মামার কতগুলো অদ্ভুত গুণ ছিল। তিনি কোনোদিন ভায়োলিন বাজাতে শেখেননি, কিন্তু রোজ সকালে অসাধারণ বাজাতেন। আইনস্টাইনও ভায়োলিন বাজাতে শেখেননি, কিন্তু অনবদ্য বাজাতে পারতেন। এ দিক দিয়ে ‍দুজনের মিল ছিল। বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করত।
শওকত ওসমান’র ‘দরগা রোডের দরগা’
বাংলাভাষার লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাশিল্পী শওকত ওসমান আমার বাবা সম্পর্কে তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘নেপাল নাগ। শ্রমিক নেতা নেপাল নাগ। একদা নারায়ণগঞ্জের মুসলমান শ্রমিকদের মধ্যে রহমান ভাই নামে পরিচিত ছিলেন। বিধ্বস্ত শরীরে কলকাতায় আশ্রিত। রহমান ভাইয়ের দরগা রোডের দরগায় গিয়েছিলুম। মানত শুধতে নয়, বুকে অনেক তাগদ ফিরে পাওয়া গেল।’ শওকত ওসমানের ভাষায়, ‘বর্তমান বাংলাদেশে বহু মুক্তিমানব নেপালদার সৃষ্টি বলা চলে।’
চাকরিসূত্রে বাংলাদেশে ছিলাম ৯ বছর
১৯৭০ সাল থেকে ৪০ বছর ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট হাউসে (টাটা) কাজ করেছি। ৯ বছর ছিলাম চাকরিসূত্রে বাংলাদেশে। ২০০৮ সালে ফেরত গিয়েছিলাম। লক্ষ করেছি স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অনেক উন্নতি হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া দরকার তা হলো যানজট নিরসনের ব্যবস্থা। হয় গাড়ি কমাতে হবে নয়তো রাস্তা বড় করতে হবে, উন্নত পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আশাকরি, দেশপ্রেমী, যোগ্য নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুত কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, শনিবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করা বিদেশি বন্ধুদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানিত করার চতুর্থ পর্ব। এতে ৯টি দেশের ৬০ ব্যক্তি ও দুটি সংগঠনকে সম্মাননা জানানো হয়। এসব ব্যক্তি ও তাদের প্রতিনিধির হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলানিউজ
19 Dec 2012 12:32:51 PM Wednesday BdST

PEW জরীপ - বাংলাদেশের শরিয়াকরণ - ১০নং মহাবিপদ সংকেত? -হাসান মাহমুদ


PEW জরীপ - বাংলাদেশের শরিয়াকরণ - ১০নং মহাবিপদ সংকেত?

কোনো জরীপই এবসলিউট নয়, কিন্তু নিরপেক্ষ,বস্তুনিষ্ঠ ও একাডেমিক হিসেবে PEW-এর খ্যাতি আছে। গত সপ্তাহে PEW একটা জরীপ প্রকাশ করেছে, নাম The World’s Muslims: Religion, Politics andSociety (বিশ্বমুসলিম - ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ)।
এ জরীপের ওপর কিছু প্রশ্ন পাঠিয়েছি ওদেরকে, এলে সবাইকে জনাব। এতে বাংলাদেশও আছে, আমি প্রধান ৫টি প্রশ্নোত্তর দেখাচ্ছি:-

**প্রথম ৩টি জরীপ সাধারণ মুসলিমের মধ্যে:-



১.শারিয়া আইন হল আল্লাহ'র নাজিলকৃত আয়াত -সর্বোচ্চ - জর্ডন ৮১%, সর্বনিম্ন - আলবেনিয়া ২৪%, বাংলাদেশ ৬৫%, পাকিস্তান ৮১%

২.শারিয়া আইন একটাই, বিভিন্ন নয় বলে মনে করেন - সর্বোচ্চ - তাজিকিস্তান ৭০%, সর্বনিম্ন– তিউনিশিয়া ২০%, বাংলাদেশ ৫৭%, পাকিস্তান ৬১%

৩.নিজের দেশে শারিয়া আইন চান - সর্বোচ্চ - আফগানিস্তান ৯৯%, সর্বনিম্ন আজারবাইজান ০৮%, বাংলাদেশ ৮২%, পাকিস্তান ৮৪%



**পরের জরীপগুলো শুধুমাত্র শারিয়া সমর্থকদের মধ্যে:-



৪. ব্যাভিচারীকে প্রস্তরাঘাতে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন - সর্বোচ্চ- পাকিস্তান ৮৯%, সর্বনিম্ন- বসনিয়া ২১%

বাংলাদেশ ৫৫%

৫.মুরতাদ অর্থাৎ ইসলাম-ত্যাগীদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করেন - সর্বোচ্চ - আফগানিস্তান ৭৯%, সর্বনিম্ন - কাজাখস্তান ০৪%, বাংলাদেশ ৪৪%, পাকিস্তান ৭৬%



অনেকে বলবেন - "যা: বাংলাদেশ হবে শরিয়া রাষ্ট্র!! উন্মাদের প্রলাপ !!" একথা আমাকে ১৯৭৫ সালের দিকে বলেছিল পাকিস্তানীরা ও ইরানীরাও, আবুধাবীতে। পরে যখন গঠনতান্ত্রিকভাবে ওগুলো শারিয়া-দেশ হয়ে গেল ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে, ওরা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছে আর এখন মোল্লাতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার প্রাণান্ত চেষ্টায় রক্ত ঢেলে চলেছে। তাই ভুল যদি করতেই হয় চলুন আমরা দড়িকে সাপ মনে করার ভুল করি, সাপকে দড়ি ভাবার মত ব্লান্ডার না করি। আমাদের শরিয়া-করণ হচ্ছে রাজনীতি নিরপেক্ষ পদ্ধতিতে যা ওদের চেয় ভিন্ন। অর্থাৎ শারিয়া-পন্থীরা ক্ষমতায় থাকুক বা না থাকুক গত বহু বছর ধরে এই প্রক্রিয়ায় দেশ শারিয়ার দিকে এগিয়ে গেছে। আমরা পছন্দ করি বা না করি এর প্রচণ্ড প্রভাব এর মধ্যেই আমরা দেখছি। ক্রমাগত দুর্বল সরকারের ওক্রমবর্ধমান দুর্র্নীতির সুযোগে ধীরে ধীরে তাঁদের প্রস্তাবিত "ইসলামী" সমাধান জনগনের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। শারিয়া সম্বন্ধে জনগণ কিছু জানেই না। তবু বহু লোক শারিয়ার রক্ষাকর্তা হয়ে গেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার জামাত-বিরোধীও।



ছোটবেলায় দেখেছি রোজার মধ্যে হোটেলগুলো চাদর দিয়ে ঢাকা থাকত। অমুসলিমেরা তো বটেই কোন কোন মুসলমানও বাইরে খেত তাতে আকাশ ভেঙ্গে পড়ত না। এখন বাইরে কাউকে খেতে দেখলে সাধারণ মানুষের একাংশ হিংস্র হয়ে ওঠে। আমার এক বন্ধু বাসে করে যাচ্ছিল, সে দেখল গাড়িতে ভ্যাপসা গরমের দুপুরে এক যাত্রী পানি খেয়েছে বলে বাসের ড্রাইভার বাস থামিয়ে তাকে অপমান করে পথের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।
নানা-নানীর কোলে মানুষ, এখন ঢাকায় বসবাসকারী একজনের কন্যার প্রথম আকিকা-উৎসবের সাতদিন আগে গ্রামের বাড়ীতে নানা মারা গেলে সাধারণ মানুষ এসে দাবী করেছে শারিয়া মোতাবেক নানী চার মাস ঘরে থাকবে, নিজের নাতির বাসা হলেও ঢাকায় যেতে পারবে না।
পঙ্গু হয়ে কয়েক বছর শয্যাগত একজনের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ দাবী করেছে কাফফারা না দিলে তাঁর জানাজা হবে না কারণ তিনি এত বছর নামাজ পড়েন নি।
কোনো এক কলেজের শিক্ষক ছাত্রীদের বোরখা পড়তে বাধ্য করলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও হাইকোর্টকে এগিয়ে আসতে হয়,শিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর নির্দেশ দিয়ে বলেছে,কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাউকে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না - জনকন্ঠ ২৬শ আগস্ট ২০১২।
রংপুরে এক এস-আই ১৯জন মেয়েকে থানায় ধরে নিয়ে আসে বোরখানা পড়ে পার্কে গিয়েছিল বলে। সেখানেও কোর্টকে এগিয়ে এসে সেই পুলিশকে তলব করে ও এ ধরণের অপকর্মকে নিষিদ্ধ করে - জনকন্ঠ ০৩ মার্চ ২০১০।


এরকম অজস্র উদাহরণ প্রমাণ করে সাধারণ মানুষের মধ্যে শারিয়া আইন মেনে চলার উগ্র প্রবণতা ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে। কি কি পদ্ধতিতে এটা হচ্ছে সেদিকে এবার তাকানো যাক।



অসংখ্য মওলানা-মুফতি-মোল্লা নিয়ে দেশজুড়ে যে অনিয়ন্ত্রিত আলেম-সমাজ গড়ে উঠছে তাঁদের প্রায় সবাই নারী-নীতির বিরোধী। এঁদের যোগ্যতার কোন দৃশ্যমান মাপকাঠি নেই, জাতির বা সরকারের কাছে জবাবদিহিতাও নেই। এঁদের বেশীরভাগই আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার কিছুই জানেন না কিন্তু অবলীলায় বিশ্বের তাবৎ সমস্যার সমাধান পেশ করে থাকেন।
দেশে শরিয়াপন্থীদের শত শত একাগ্র, কর্মতৎপর ও ধনী সংগঠন জাতির চোখের সামনে ধরে রেখেছে শুধুমাত্র ওদেরই ইসলামি-ব্যাখ্যা। ওদের বিপক্ষে সুফী ইসলামী ধর্মতত্বের বইগুলো প্রচার প্রসারের সংগঠন নেই বললেই চলে।
ওদের আছে দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান মসজিদ, প্রতি শুক্রবারে জনতাকে প্রভাবিত করার সুযোগ যা তারা পুরোটাই নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও নেবে।
আলিয়া,কওমি,ফোরকানিয়া,হাফিজিয়া ইত্যাদি মাদ্রাসার সংখ্যা হবে কমপক্ষে তিন লাখ–(জনকন্ঠ ১৫ মে ২০১৩ - মুনতাসীর মামুন)।
প্রতি বছর এরা সমাজে ঢেলে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ শরিয়া-সমর্থক যারা উবে যায় না, সরকারী চাকুরী ও সামরিক বাহিনী সহ সমাজের প্রতি স্তরে তাদের প্রভাব খাটাতে থাকে। প্রাথমিক পরীক্ষায় পাশ করার জন্য তাদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে খবর উঠেছে। ক’বছরে এ সংখ্যা যা দাঁড়াবে তার প্রভাব জাতি এড়িয়ে যেতে পারবে না।
মধ্যপ্রাচ্যে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী দেশে বানিয়েছেন অসংখ্য মাদ্রাসা। মাদ্রাসা আসলে শারিয়াপন্থীদের সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। সে পরিকল্পনা এখন বেশ সফল, এক নিমেষে বহু হাজার যুদ্ধংদেহী তরুণকে রাস্তায় নামানোর প্রচণ্ড ষ্ট্রীট পাওয়ারের অধিকারী ওরা। গত ৫ই এপ্রিল ২০১৩ ঢাকাত শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের লক্ষ লোকের সমাবেশ তার প্রমাণ। এ বাহিনী আগামীতে অনেক বাড়বে এবং সর্বত্র এর চাপ অনুভুত হবে। এ চাপ ঠেকানোর পদ্ধতি এখনও বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
ওদের আছে নিজস্ব দলীয় পত্রিকা এবং সেগুলোতে ইসলামের নামে গোয়েবল্‌সীয় পদ্ধতিতে প্রচারিত হচ্ছে শারিয়া-প্রচার। পক্ষান্তরে ইসলামি দলিলের ভিত্তিতে ওদের প্রচারণার ভিত্তিহীনতা, কোরাণ-বিরোধীতা, ইসলাম-বিরোধীতা ও অসততাকে তুলে ধরার তেমন কোন পত্রিকা নেই। চেষ্টা করে দেখা গেছে অনেক সেকুলার পত্রিকাও এসব দলিল জাতির সামনে তুলে ধরতে ভয় পায়।
এটাও শারিয়াপন্থীদের আর একটা বিরাট সাফল্য।এরা জনগণ, সরকার, মিডিয়া, টিভি-রেডিয়ো-সংবাদপত্র প্রকাশনা সহ সারা জাতিকে ভয় পাওয়াতে সক্ষম হয়েছে। এটা আরো বাড়বে বৈ কমবে না।
২০০৬ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনষ্টিটিউট-এ জামাত ঘোষণা দিয়েছে দেশ জুড়ে মহাশারিয়া কোর্টের জটাজাল বানানো হবে। গ্রাম উপজেলার নিয়ন্ত্রনে, উপজেলা জেলার নিয়ন্ত্রনে, এভাবে আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকবে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাতে। অর্থাৎ আটষট্টি হাজার শারিয়া-কোর্টের জালে মাছের মত আটকে যাবে দেশের ভবিষ্যৎ।
সমান্তরাল বিচার ব্যবস্থা রাষ্ট্রদ্রোহীতার পর্যায়ে পড়ে কিন্তু সম্ভবতঃ এর নাম দেয়া হবে ইসলাম পরামর্শ ব্যবস্থা, মানুষ ইচ্ছে হলে নিক ইচ্ছে না হলে না নিক্‌! ওদিকে টহল দিয়ে বেড়াবে বেসরকারী শারিয়া-পুলিশ, ‘‘স্বেচ্ছাসেবক’’ নাম নিয়ে। গালগল্প নয়, অন্যান্য শারিয়া-দেশে নামাজ-রোজা-দাঁড়ী-বোরখা নিয়ে ভয়াবহ দোজখ সৃষ্টি করেছে এই হিংস্র শারিয়া-বাহিনী। কেউ শারিয়া কোর্টে না গিয়ে দেশের কোর্টে গেলেই ছুটে আসবে মুরতাদ-ফতোয়ার চাবুক। স্বাধীন-চিন্তা ও ভিন্নমতের ওপরে নেমে আসবে ব্ল্যাসফেমি আইনের খড়্গ, জনগণের সাধ্য হবেনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। বন্ধু তো দুরের কথা ভাই ভাইয়ের কাছেও মন খুলে কথা বলতে ভয় পাবে মানুষ। গল্প নয়, এরকম হয়েছে অন্যান্য দেশে।
এর মধ্যেই বিভিন্ন ব্যাপারে সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বায়তুল মুকাররমে গিয়ে গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যা তাঁরা ইমাম-খতিবদের ডেকে সেক্রেটারিয়েটেই নিতে পারতেন। এভাবে সুযোগ দিতে থাকলে ইরাণের শুরায়ে নিগাহ্‌বান-এর মত বায়তুল মুকাররমকে ছায়া-সংসদ করে তোলা হবে, সরকার সেটা ঠেকাতে চাইবে না, চাইলেও পারবে না।
আমাদের বুদ্ধিজীবি ও সুশীল সমাজও সুশীল বালকের মত ইসলামকে ব্যাখ্যা অধিকার ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁরা বিশ হাজার পৃষ্ঠার বই পড়ে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-অর্থনীতিবিদ হবেন কিন্তু দশ হাজার পৃষ্ঠার ইসলামি দলিল পড়ার সময় নেই। তাঁরা ভোগেন ভয়ংকর অহংরোগ, গর্ব, একগুঁয়েমী, ‘‘একলা চলো’’ নীতি ও সাংগঠনিক ব্যর্থতায়। টাকার জোর বা আন্তর্জাতিক সমন্নয়ও তাঁদের নেই।
ইসলামী টিভি চ্যানেল তো আছেই, অন্যান্য প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে এক একেকটা করে ইসলামী প্রোগ্রাম চলে, প্রায় প্রতিটি সংবাদপত্রে ইসলামী অংশ থাকে। এদের প্রত্যেকটিই শারিয়া-পন্থী। তাঁরা কোরানের অপব্যাখ্যা করে ও নারী-বিরোধী হাদিসগুলো উদ্ধৃতি দিয়ে নারী-বিরোধী শরিয়া আইনগুলোকে ইসলামের নামে বৈধতা দেন। গ্রাম গঞ্জের অশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত জনগনের ওপরে এসবের প্রভাব প্রচণ্ড ।
আ-লীগ সরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে - দৈনিক ইনকিলাব ২০শে আগষ্ট ২০১১)।
যে বাংলাদেশে একটা বাংলা বিশ্ববিদ্যালয় নেই, যে বাংলাদেশে কয়েকটা বেসরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, প্রতিষ্ঠিত ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শারিয়াবাজদের নিয়ন্ত্রনে, সেগুলোতে আমাদের সুফি ইসলামকে পরাজিত করে নির্ভেজাল মওদুদিবাদ পড়ানো হয়। সরকারী ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টাও ওদের হাতেই যাবে। অজস্র মাদ্রাসার সাথে ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়টাও পরের প্রজন্মের একটা বড় অংশকে পথভ্রষ্ট করবে যারা সমাজে প্রবেশ করবে ও সমাজকে প্রবলভাবে প্রভাবাম্বিত করবে।
হাইকোর্টে ফতোয়ার বিরুদ্ধে রায় বাতিল করে সুপ্রীম কোর্টের রায় - ফতোয়া বৈধ, "শুধুমাত্র বিজ্ঞ মুফতিরাই ফতোয়া দিতে পারবেন" ইনকিলাব ১৪ মে ২০১১।
এটা যে জাতির বিরুদ্ধে কতবড় বিশ্বাসঘাতকতা তা সময়ই বলবে। "বিজ্ঞ মুফতি" কাকে বলে সেটা কে ঠিক করবে?
আলেমরা নাকি "সরাসরি আল্লাহ'র দ্বারা সরাসরি ফতোয়া দিবার অধিকার প্রাপ্ত" (ইনকিলাব ২০শে আগষ্ট ২০১১)।"আলেম" কাহাকে বলে সেটাই ঠিক করা গেলনা গত ১৪০০ বছরে, - লাখো "আলেম"রা পরস্পরের সাথে শুধু গালাগালি হানাহানি কামড়া-কামড়ি করে বিশ্ব-মুসলিমকে শুধু বিভক্তই করেন নি বরং অজস্র হত্যা গণহত্যা ঘটিয়েছেন ওই ফতোয়ার অস্ত্রে, এসব জাতিকে জানানো দরকার।
ওই রায়ে বসতে পারার প্রথম সুযোগেই শোবার দাবী এসেছে ন্যাশন্যাল ফতোয়া বোর্ড গঠনের।
বায়তুল মুকাররমের খতিবকে প্রধান বিচারপতির সাংগঠনিক মর্যাদা দিতে হবে এ দাবী বহু আগে থেকেই ছিল।


সব মিলিয়ে আমরা দেখছি সরকারে থাকলে তো কথাই নেই, না থাকলেও বা আংশিকভাবে থাকলেও তাঁরা গ্রাম গঞ্জে এক অদৃশ্য "ইসলামী সরকার" চালাবার কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। উনাদের দাবীতে অনেক কিছুই আছে, নেই শুধু নারীর কন্ঠ। গত ১৪০০ বছরে একজনও নারী শরিয়া-ইমাম নেই, নারীর ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রতিফলন নেই, নেই নারীর জীবনে এসব আইনের প্রভাবের ওপর কোনো সমীক্ষা। হাতীর দুই দাঁত - একপাটি দেখা যায় যা তাকে সুন্দর করে তোলে। আর একপাটি দাঁত আছে লুকোনো, চিবিয়ে হাড় ভাঙ্গার জন্য। শারিয়াপন্থীদেরও ঠিক তাই;চোখের সামনে ধরা আছে মুখমিষ্টি "মায়ের পায়ের নীচে বেহেশত" আর লুকোনো আছে ভয়াবহ নারী বিরোধী আইন। জাতির সুশীল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমাজের এখনই উচিত নারীনীতি কেন ইসলাম-সমর্থিত, এর বিরোধীতা কেন ইসলাম-বিরোধী, অন্যান্য মুসলিম দেশে মওলানাদের সমর্থনে কি ইসলামি পদ্ধতিতে সাংবিধানিকভাবে নারীনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে ব্যাপারে কিছু পড়াশুনা করা এবং বিভিন্ন মাধ্যমে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া।



কিছুটা দেরী হয়েছে কিন্তু এটা এখনও সম্ভব এবং এর বিকল্প নেই।

হাসান মাহমুদ

১৫ই মে, ৪৩ মুক্তিসন (২০১৩)

- See more at: http://www.hasanmahmud.com/2012/index.php/all-articles/articles-in-bangla/islamic/90-pew-%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%AA-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A3-%E0%A7%A7%E0%A7%A6%E0%A6%A8%E0%A6%82-%E0%A6%AE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AA%E0%A6%A6-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A4#sthash.2DG9NcB8.dpuf

Monday, July 22, 2013

আসুন, বীরাঙ্গনা হীরামনির পাশে দাঁড়াই- কেয়া চৌধুরী


মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গনারীর অংশগ্রহণ, তার ত্যাগ ও বলিদানের ইতিহাস আজও এক অনুদ্ঘাটিত অধ্যায়। এ ইতিহাস সবার জানা, কিন্তু প্রয়োজনের বাইরে বিষয়টি আলোচিত না হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের অন্তর্জগতেই বন্দী অবস্থায় রয়েছে বীরাঙ্গনার ত্যাগের ইতিহাস। তাই বীরাঙ্গনারা চার দেয়ালের মধ্যে আটকা পড়ে আছেন এখনও। বীরাঙ্গনাদের মূল্যায়ন সমাজে দেখা যায় না। অনেকে বলেন, বীরাঙ্গনারা নাকি ঘরের বাইরে আসতে চান না। পরিচয় গোপন করেন। কথাটা ঠিক নয়। বরং তারা বের হতে পারেন না। সমাজ-রাষ্ট্র তাদের বের হতে দেয় না। চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জের সাংগঠনিক কাজের সুবাদে আমি এ বিষয়ে কাজ করছি ৮ বছর। চেতনায় ’৭১ এ পর্যন্ত সন্ধান পেয়েছে মোট ১০ জন বীরাঙ্গনার। তাঁরা কেউই আমাদের কাছে ছুটে আসেননি। বরং আমরা ছুটে গেছি তাঁদের দুয়ারে। মোটা দাগে বলা যায়, তাদের প্রত্যেকের জীবনে একটি বিষয় সত্য, তা হলো, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পরও বীরাঙ্গনারা ভাল নেই। সেটা কেবল আর্থিক দিক দিয়ে নয়, শারীরিক, মানসিক এমন কি পারিবারিক পরিম-লেও তাঁরা ভাল নেই। আত্মসম্মান নিয়ে জীবন চালানো তাঁদের জন্য বড় দায়। নিজ পরিবারের সদস্য দ্বারা তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতিত। কর্কশ বাক্য-সন্ত্রাসে তারা আহত, জর্জরিত।
’৭১-এর দুঃসহ স্মৃতি তাঁদের এখনও তাড়িয়ে বেড়ায়। তারা এখনও অতঙ্কগ্রস্ত এ কথা ভেবে যে, পাছে না আবার এ নিয়ে কষ্ট পেতে হয়। খুব কাছ থেকে দেখা অভিজ্ঞতা থেকে অন্তত এটুকু বলতে পারি: আমার, আপনার একটুখানি সম্মান একটু খানি নির্ভরতা তাদের জীবনযাপনে উৎসাহিত করতে পারে। তাতে নিজের প্রতি ফিরে আসতে পারে তাদের আত্মবিশ্বাস।
বীরাঙ্গনারা যখন কথা বলেন, তখন লজ্জায় নত হই। সেই ৭১ থেকে আজ পর্যন্ত কত যে অসহায়, বঞ্চিত বীরঙ্গনা! অথচ আমরা ইতিহাস হতে জানতে পাই, ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাবনার এক জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পাকসেনা দ্বারা নির্যাতিত বঙ্গনারীদের বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করে বলেছিলেন, “বীরাঙ্গনারা দেশের জন্য ইজ্জত দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয়, বরং কয়েক ধাপ ওপরে। তাই জাতিকে তাদের বীরাঙ্গনা মর্যাদা দিতে হবে, যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে বীরাঙ্গনাদের।” কিন্তুু আজকে দুঃখ নিয়ে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নে তৎপর, শহীদ, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করা হলেও বীরাঙ্গনাদের নিয়ে নেই কোন তালিকা। তাদের ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই কোন উদ্যোগ। আমরা বিদেশী বন্ধুর ত্যাগের কথা স্মরণ করি, কিন্তুু বীরাঙ্গনাদের সম্মান জানাই না !
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ২০০৯ সাল হতে হবিগঞ্জের ৮ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আবেদন করা হয়, কিন্তুু বাস্তবতা হলো,আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই!
মনে হচ্ছে, সময় আর হাতে নেই। বীরাঙ্গনারা জীবনের শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছেন। এবার সবাইকে জানাতে হবে তাঁদের দূরবস্থার কথা। বীরাঙ্গনাদের কষ্টের কথা জেনে যদি আমরা অন্তত ভাবি নিজেদের দায়িত্বহীনতার কথা । যদি মনে তাগিদ জাগে এদের জন্য কিছু করার। তবে শেষমেশ কিছু একটা হয়ত হবে।
আজ এক বীরাঙ্গনার কথা বলতে চাই। নাম তাঁর হীরামনি সাঁওতাল। বয়স প্রায় ৬৭। তিনি থাকেন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানার চানপুর চা-বাগানের লোহারপুল বস্তিতে। স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল আর নেই। দুটি কন্যা সন্তান তাঁর। কিন্তু রোজগেরে নয়। আছে দৈন্য। অভাব-অনটন। দীর্ঘ মেয়াদে অনাহার, শ্বাসকষ্ট তাঁকে আর মানুষ রাখেনি, করেছে জীবন্ত কংকাল।
চানপুর চা-বাগানের বস্তিতে হীরামনি এখন কেবলই মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। হীরামনি জীবনবোধের জটিল হিসাব না বুঝলেও জটিল এক বাস্তবতা তাঁকে গ্রাস করে রেখেছে তার মনের অজান্তেই। অথচ তাঁর জীবনে চাওয়া- পাওয়া বলতে কখনই তেমন কিছু ছিল না। দুবেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত, বছরে দুটি মোটা কাপড় নিয়মিত চা-শ্রমিক হিসেবে চা-বাগানের একটা চাকরি, কোম্পানির দেয়া কিছু রেশন । এই তো! কিন্তুু ভাগ্যের কি পরিহাস, তার কোনটিই জোঠেনি। অভাবে, শরীরের উপর দীর্ঘদিনের এ অনিয়ম-অনাহার আর যেন সইছে না। সকালে খালি পেটে এক গ্লাস জল তার সঙ্গে এক মুঠো শুকনা চালের গুঁড়া এ দিয়ে দিন পার। দিনের সময় যত বাড়ে মুখের তেতো ভাব তত যেন বাড়তে থাকে। পাখির মতো ছটফট করতে থাকে হীরামনির বুকের ভিতরটা। শ্বাসকষ্ট বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে দেয়। প্রাণটা যেন যায়-আসে করে। বেলা যত গড়ায়, সূর্যটা আকাশে যত চমকায়, জানালাহীন অন্ধ কুঁড়েঘরটা তত যেন গুমট হয়ে যায়। মনে হয় কোন গুহার বাসিন্দা হীরামনি। মাথার পাশে মাটির চুলা। নেই রান্না-বান্নার সামান্যতম আয়োজন। কালিযুক্ত দু’চারটি হাঁড়ি দেখলে বোঝা যায় কত দৈন্য এখানটায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার বাতাসহীন ঘরে এভাবেই কাটছে বীরাঙ্গনা হীরামনির কষ্টের জীবন।
জানুয়ারিতে হীরামনির কিছু চিকিৎসা করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলাম আমরা হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালে। পরীক্ষায় ধরা পড়ল নানা রোগ। ডাক্তার বলেন, হীরামনির শরীর খুব দুর্বল। তার উপর শ্বাসকষ্ট। সিভিল সার্জন নিজে তদারকি করে বিনামূল্যে কিছু ওষুধ দিলেন হাসপাতাল থেকে। ওষুধগুলো কাপড়ের পুটলায় ভরে বাসে চড়ে, চা-বাগানের আঁকাবাঁকা পথে বাড়ি ফিরলেন হীরামনি। ওষুধ খাওয়া শুরু হলো। একটু শ্বাসকষ্ট কমলেও রক্ষা হলো না। ওষুধের সঙ্গে খাবারটা ঠিকঠাক মতো চাই। কিন্তু হীরামনির সে সঙ্গতি কি আছে? ব্যক্তিগতভাবে কারও ৫০০/১০০০ টাকার সাহায্যে কি হয়! ক’দিনই চলে?
হীরামনির স্বামী মারা গেছে অনেক দিন হলো। দুটি মেয়ে, সহরমনি ও সজনি। সহরমনি ও সজনীর বিয়ে হয়ে গেছে। তারাও চা-শ্রমিক। তবে স্থায়ী চাকরি নেই তাদের। সন্তানাদি নিয়ে তারাও কষ্টে আছে। বৃদ্ধ চা-শ্রমিক হয়েও হীরামনি বাগান থেকে বাড়তি কোন রেশন পান না! ঠিক কত দিন আগে হীরামনি দু’বেলা পেট পুরে ভাত খেয়েছে তা যেন স্মৃৃতিতে ঝাপসা হয়ে আসে । বিচিত্র এ জগত সংসারে এ মানুষটি এমন অসহনীয় জীবন যেন আর বইতে পারছেন না। স্থির দুটি চোখ অনেক কষ্টে কেবলই চেয়ে থাকে। দুর্বলতায় সবই ঝাপসা দেখায়। হীরামনির মুখের শব্দ বেশ ভারি। কথা জড়িয়ে যায়, ঠিক বোঝা যায়না।
ভ্যাপসা গরমে মুখভর্তি ঘাম। তাতেও যেন চেতনা নেই তার। গত শনিবার লোহারপুল বস্তিতে সকালে গিয়েছিলাম, পাশে বসেছিলাম দুপুর পর্যন্ত। সাড়া নেই তাঁর। মাঝে, মাঝে একটু মাথা তোলেন, তারপর আবারও টান করা পায়ের ওপর শরীরটা হেলিয়ে দেয়া।
হীরামনি আমাকে দেখেছেন, তবুও কথা নেই। অনেকক্ষণ পর ঠোঁটের কোন হতে বের হয়ে এলো দুর্বলকণ্ঠে একবাক্য: ‘হামার অনেক কষ্ট, কথা কইতে ভ্যালা লাগে না।’ আমি নির্বাক।
হীরামনির মাথায় ময়লা। এলোমেলো চুলগুলোতে অনেক উকুন, তাতে বিরামহীন চুলকানি। মনে হয় চুলকানি দিতে, দিতে হীরামনি ক্ষণে, ক্ষণে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। পরক্ষণে দু’পায়ের উপরে শরীরটা তুলে ধরলেন; বোধ করছি আবার ঘুমাচ্ছেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হীরামনির জীবনকে কেবল তছনছ করে দেয়নি, তাঁকে সবকিছু থেকে বিছিন্ন করে দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে পাকিস্তানীরা যখন চানপুর চা-বাগানের অফিস ঘরে ক্যাম্প করল তার দুদিনের মাথায় হীরামনি নিজ ঘরে সম্ভ্রম হারালেন পাষ- পাক সেনাদের হাতে। হীরামনি আজও জানেন না কি দোষ ছিল তার? সেদিন ৭/৮ জনের পালাক্রমে ধর্ষণে চেতন হারিয়ে ফেলেছিলেন হীরামনি। যখন চেতন ফিরল যন্ত্রণায় শরীর যেন নড়াতে পারছিলেন না। হীরামনির দুঃসময়ে তখন তার পাশে ছিলেন স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল। দরিদ্র লক্ষণ সাঁওতালের মনটা ছিল উদার। তিনি চা-শ্রমিক হয়েও তাঁর স্ত্রীকে সবচেয়ে ভাল চিকিৎসার দেবার চেষ্টা করেছেন । মনেপ্রাণে মৃতপ্রায় হীরামনিকে তিনি সারিয়ে তুলেছিলেন পরম ভালবাসায়। হীরামনির জীবনে একাত্তরের বিভীষিকাময় অধ্যায় স্বামী হিসেবে মুছে ফেলতে সাহায্য করেছিলেন লক্ষণ; কিন্তুু পারেননি। সেদিনের পাশবিক নির্যাতন হীরামনিকে চিরতরে অসুস্থ করে দিয়েছে।
স্বামী লক্ষণ সাঁওতাল না ফেরার দেশে চলে গেছেন তা তো অনেক দিনের কথা। তারপর হতে হীরামনি নিঃসঙ্গ। নিরুত্তাপ জীবন তাঁকে এলোমেলো করে দিলেও সেইদিনের দুঃসহ স্মৃতি চোখের পানিতে এতটুকু ঝাপসা হতে দেয়নি বীরাঙ্গনা হীরামনিকে। আজ-কাল প্রায়ই অভিমান গ্রাস করে হীরামনিকে। পছন্দ না হলে কথা বলতে চান না কারও সঙ্গে।
একাত্তরের জ্যৈষ্ঠ মাসের সেই নির্যাতনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত হীরামনির জীবনে আর শান্তি আসেনি। দীর্ঘ ৬৭ বছর জীবনের শেষটা হীরামনির বড় কষ্টÑ খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসাহীন চরম এক মানবেতর জীবন। হীরামনি বার বার কেবলই মৃত্যুকে কামনা করেন। মাথাটা পায়ের ওপর রেখে ভগবানকে কী তিনি এ কথাই জানান ? কে জানে !
বর্তমানে হীরামনি অসুস্থ। চেতনায় ’৭১ হবিগঞ্জের ডাকে হীরামনির পাশে এগিয়ে এসেছেন ডাক্তার ফৌজিয়া, বারডেম হাসপাতালের ডিজি প্রফেসর নাজমুন নাহার, ডক্টর সারোয়ার আলী। চাইলে আপনিও আমাদের সহযোগী হতে পারেন।
দুদিন হলো রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ১৩৬০ নম্বর ওয়ার্ডে হীরামনির চিকিৎসা চলছে। কে জানে তিনি সুস্থ হবেন কবে?
বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, বাজেটের আকার বছরে বছরে বাড়ছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত কত গবেষণা, হচ্ছে, প্রকল্প হচ্ছে, তালিকা হচ্ছে, বরাদ্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। কিন্তু, মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবয় ক্ষতিগ্রস্ত হীরামনির মতো বীরাঙ্গনাদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন হচ্ছে না! এর কারণ রহস্যজনক।
বীরাঙ্গনারা অযতœ আর অবহেলায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন আমাদের চোখের সামনেই। আমরা কি পারি না হীরামনির জীবনের শেষ দিনগুলোকে একটু শান্তিময় করতে। আসুন না, যার যার অবস্থান থেকে ঝণ শোধবার কাজে হাত বাড়াই। তাদের ন্যায্য সম্মান প্রতিষ্ঠায় কাজ করি। তা না হলে আগামী ইতিহাস কখনও ক্ষমা করবে না আমাদের।

Sunday, July 21, 2013

বিকৃত নপুংসক আহমদ শফিদের আর সুযোগ দেয়া যায় না! - সুমি খান

বিকৃত নপুংসক আহমদ শফিদের আর সুযোগ দেয়া যায় না! - সুমি খান
আমার জন্ম একটি ধর্ম নিরপেক্ষ বা সেক্যুলার পরিবারে। যেখানে ধর্ম অথবা প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা কিছু নিয়েই কখনো কোন বাড়াবাড়ি বা শোষণ নিপীড়ন ছিল না। মনের আনন্দে পড়েছি আর ফাঁকিবাজি করেছি। এর কারণ ছিল, আমার মা-বাবা দু’জনের পরিবার ই সেক্যুলার ছিল। চার-পাঁচ প্রজন্ম আগেও ধর্ম নিয়ে কোন ধরণের বাড়াবাড়ি কাউকে পোহাতে হয় নি। মুক্তচিন্তা আর মুক্ত আনন্দে বেড়ে উঠেছে ভাই বোন সবাই। তবে এও সত্যি, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সেক্যুলারিজমের পাশাপাশি ধর্মান্ধতা গেড়ে বসেছে এই প্রজন্মের জীবনাচরণে !পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব যাবে কোথায় আর!
আমাদের শৈশব এবং কৈশোরে যাদের কাছে আরবী শিক্ষা গ্রহণ করেছি, তাদের আচরণ ছিল প্রকৃত শিক্ষাগুরুর মতো অত্যন্ত স্নেহশীল এবং মায়াময় । এখনো সেই শিক্ষাগুরু আমাদের পারিবারিক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এলে মায়ের কাছে আমার খোঁজ নেন । পথে ঘাটে তার সাথে দেখা হলে বিনম্র শ্রদ্ধায় তার পা ছুঁয়ে সালাম করতে ছুটে যাই। আমি এবং আমার দু’ভাই যখন হুজুরের কাছে পড়তে বসতাম, কখনো তার আচরণে অথবা কথায় কোন বৈষম্য পাইনি। আমার মনে পড়ে না- কখনো বেত হাতে তিনি আমাদের পড়তে বসিয়েছেন। আমার পোষাক, জীবনাচরণ নিয়ে কোন রকমের মন্তব্য করেন নি কখনো। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন ইসলাম ধর্মের মূল বাণী শান্তি এবং মানব সভ্যতার বিকাশ এবং প্রগতি । তার চোখে ছিল পিতৃসুলভ অপত্য স্নেহ, যা এখনো অমলিন। এই শিক্ষাগুরু এবং ইসলামের পবিত্রতা কে কলঙ্কিত করছেন জামায়াত –হেফাজতি আহমদ শফি, সাঈদী গোলাম আযম নিজামী , সাকাচৌধুরী এবং তাদের অনুসারীরা । যারা বিপন্ন করে তুলেছেন মুক্তচিন্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তিকে। সংকটময় করে তুলেছেন এদেশের স্বাভাবিক জনজীবন কে।

বড়ো হয়ে দেখেছি আমাদের শিক্ষাগুরু একেবারেই ব্যাতিক্রম । ধর্মশিক্ষা যারা দেন, তারা অধিকাংশই অশিক্ষিত বিকৃত চরিত্রের ; লোভী এবং প্রবঞ্চক। এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ আহমদ শফী। যার বিকৃত বাণী এখন বিশ্বজুড়ে নিন্দিত। মুক্তচিন্তা আর সভ্যসমাজ প্রতিষ্ঠায় যারা জীবন উৎসর্গ করেছে বা এখনো করছে- তারাই এদের টার্গেট।
বেগম রোকেয়া বলেছিলেন; আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সু-দর্শন পাথর কুড়াইয়াছি উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনে ২৫ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠ মোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি।’
বেগম রোকেয়া থেকে জাহানারা ইমাম এদের টার্গেট। এরাই তো একাত্তরে ইসলামের নামে ঘরে ঘরে নারীদের বর্বরোচিত ভাবে ধর্ষণ , নির্যাতন এবং তিরিশ লক্ষ নিরীহ বাঙ্গালী কে হত্যা করেছিলো । দুই কোটি মানুষকে দেশছাড়া করেছিলো ইসলাম রক্ষার নামে। বিজয়ের দু’দিন আগে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করে এ দেশ কে মেধাশূণ্য করার সুপরিকল্পিত নীল নক্সার বাস্তবায়ন করেছিলো ‘ইসলাম রক্ষা’র নামে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত,ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবাল, ফেরদৌসী মজুমদার , মুনতাসীর মামুন , শাহরিয়ার কবির , ডা. ইমরান এইচ সরকার তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক, ‘মুরতাদ’ । কারণ, এরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সৈনিক । যাদের নিরলস প্রচেষ্টা এখনো এ জাতিকে শেকড়চ্যুত হতে দেয় নি। এদের বিরুদ্ধে নিরীহ ধর্মভীরু মানুষদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ,আফগানিস্তান অথবা সোমালিয়ার মতো অন্ধকার দেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে মত্ত শফি এবং তার বাহিনী।
আমার মতো ক্ষুদ্র একজন সংবাদকর্মী ও বার বার এই অন্ধকারের শক্তির অন্যায় মিথ্যাচার ,মৃত্যু পরোয়ানা, হুমকি আর আক্রমনের শিকার হয়েছি। কেন? ইসলামের যাবতীয় শুদ্ধতার ক্ষমতা কি এদের হাতে? আমাদের অতি সাধারণ জীবনটি এভাবে বিপন্ন করে তোলার অধিকার এদের কে দিয়েছে?
নেপোলিয়ান বলেছিলেন, “ আমায় একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো”। আর এই স্বঘোষিত ‘আলেম’ সমাজ দেশের উদীয়মান সুপ্রতিষ্ঠিত নারীসমাজকে চারদেয়ালে বন্দী রাখলেই যেন এদের সব খায়েশ পূর্ণ হয়ে যায় !
বেগম রোকেয়া আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘স্বামী যখন পৃথিবী হইতে সূর্য ও নক্ষত্রের দূরত্ব মাপেন, স্ত্রী তখন একটা বালিশের ওয়াড়ের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সেলাই করিবার জন্য মাপেন। স্বামী যখন কল্পনার সাহায্যে সুদূর আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রমালা বেষ্টিত সৌরজগতে বিচরণ করেন, সূর্য মন্ডলের ঘনফল তুলাদন্ডে ওজন করেন এবং ধুমকেতুর গতি নির্ণয় করেন, স্ত্রী তখন রন্ধনশালায় বিচরণ করেন, চাউল ডাল ওজন করেন এবং রাঁধুনীর গতি নির্ণয় করেন। সুশিক্ষার অভাবে নারীরা যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না”।
আহমেদ শফী নারীকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে চান। দেখতে চান তার যৌনতা আর শয্যার আজ্ঞাবাহী ক্রীতদাসী হিসেবে মাত্র। অথর্ব মূর্খ এই মিথ্যুকের অশ্লীল বাক্যের বক্তৃতা শুনে তার প্রতি ঘেন্নায় থুথু ছিটাতে ইচ্ছে হয়। এদেশে অন্যায়ের বিচার নেই বলেই এখনো মুক্ত হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতে পারে এই হিংস্র নপুংসকের দল!!
হেফাজতে ইসলামের আমির আহমদ শফী নারীদের পোষ্য , নির্জীব বস্তু হিসেবে গণ্য করেন। যা তার বক্তব্যে সুস্পষ্ট। তিনি সকল পুরুষ কে আহ্বান জানিয়েছেন তার মতো কুৎসিত আর অশ্লীল ভাবে নারীদের দিকে তাকাতে। কলঙ্কিত করলেন এ সমাজের পুরুষ দের যারা কারো বাবা, ভাই ,স্বামী অথবা সন্তান। যারা নিষ্পাপ দৃষ্টিতে তাদের মা, বোন, স্ত্রী ,কন্যা অথবা বন্ধু কে শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় পাশে রেখেছেন সুখ-দু:খের সাথী করে। যাদের সহযোগিতায় এই সমাজ এগিয়েছে এতোটা পথ!
ভাবতে করুণা হয়,৯৩ বছর আগে কী কু-সন্তান জন্ম দিয়েছেন শফীর মা! স্বাধীনতা, শিক্ষা ও চাকরি সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ, সভ্যতা ও উন্নয়ন বিরোধী মন্তব্য করেছেন। ইন্টারনেটে প্রকাশিত একটি ওয়াজ মাহফিলে ভিডিওচিত্রে তার এ বক্তব্য এখন দেশে বিদেশে চরম নিন্দিত-সমালোচিত !
উল্লেখ না করলেই নয়, শফীর সহযোদ্ধা একাত্তরের ঘাতক দের কথা। এদের অন্যতম পালের গোদা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী খালেদা জিয়া এবং তারেক জিয়াকে উদ্দেশ্য করে অনেক তির্যক , অশ্লীল মন্তব্য করেছেন বারবার । ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে সাকা চৌধুরী বিএনপি তে যোগ দেয়া নিয়ে অনেক অশ্লীল কথা বলেছিলেন, যার সবটাই ছিল খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে। বলেছিলেন, “তালাক দেয়া বিবি কে আমি ঘরে তুলি না।- কুকুরে লেজ নাড়ে, না লেজে কুকুর নাড়ে ” বেগম খালেদা জিয়া জানেন, রাজনীতিতে শেষ কথা নেই । তাই নিজেকে ‘কুকুর’ বলে মেনে নিয়েই কাছে টেনে নেন।সেই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পরবর্তীতে তার সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা বানান ! রাজাকার, চরিত্রহীন, সমকামী সাকা চৌধুরীকে ওআইসি এর মহাসচিব হিসাবে দাঁড় করানোর মধ্য দিয়ে ইসলাম ধর্মকে ব্যঙ্গ করার ধৃষ্টতা দেখান বেগম জিয়া। আর এখন তিনি আবার শফী কে সাথে নিয়ে ধর্মের নামে নতুন করে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু করেছেন। এর পরিণতি থেকে তিনি নিজেও কি রক্ষা পাবেন? তাকে দেখে ও যে ৯৩ বছরের শফির তেঁতুলের মতো লোভনীয় মনে হয়- সেটা কি তিনি বুঝতে পারছেন না?
দেশের পোষাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিক নারী । এদের উপার্জনে দেশ আজ স্বনির্ভর। সেই টাকায় মূর্খ মিথ্যাচারী শফী সাহেব হেলিকপ্টারে করে সারা দেশ ঘুরে বেড়ান আর ভুড়িভোজন করেন। সেই বিবেক বোধ তার নেই বলেই বলে বেড়ান , “মেয়েরা আসবাবপত্রের মতো । গার্মেন্টসের মেয়েদের ‘জেনা’ থেকে রক্ষা করতে” নারীদের চার দেয়ালের ভেতর বন্দী করে রাখতে বললেন! ধিক্ শত ধিক্ !!
হাটহাজারী আলজমিয়াতুল আহলিয়া উলুম মাদ্রাসার পরিচালক, কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ও হেফাজত-এ ইসলাম বাংলাদেশের আমীর কী করে হলেন আহমদ শফি ? কারা তাকে এই পদ পেতে হেদায়েত করছেন? কী উদ্দেশ্যে?
সবাই জানেন, এই শফি জাতিকে উপদেশ দিয়েছেন মেয়েদের ৪/৫ ক্লাসের বেশী না পড়াতে, সর্বদা ঘরে থাকতে, এমনকি জিনিসপত্র কিনতেও বাইরে না যেতে। বলেছেন গার্মেন্ট-নারীরা জ্বেনা করে উপার্জন করে, নারীরা তেঁতুলের মত যা দেখলেই পুরুষের মুখে লালা পড়ে। বলেছেন স্ত্রীদের আল্লাহ "বাদশা" বানিয়েছেন, তারা শুধু স্বামী-পুত্রকে "অর্ডার" করবে আর তারা তা করবে। নারীদের নাকি ২২ তাল। যে কারো রুচিতে বাধবে এসব বলতে।
জানেন তো, হিংস্র পশুদের খাঁচায় বন্দী করে রাখতে হয়? আপনাকে অনেক আগেই খাঁচায় বন্দী করে রাখা উচিত ছিলো। এখনই আপনি আর আপনার অনুসারী দের খাঁচায় বন্দী না করলে আমাদের দেশের নারী দের যে কী পরিণতি হবে – সেই ভয়াবহতা আপনার কথাতেই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে আপনাদের তান্ডবের কারণে বাংলাদেশে এমন সৎসাহস নিয়ে কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় এখনো আসে নি।
যে কারণে এখনো সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা হয়নি এ সমাজে। আমরা নিজেরাই কি তবে অন্ধকার কে ভালোবাসি?
নিজের গায়ের উপর না এলে আপনার মতো বিষাক্ত সাপ দের দুধকলা দিয়ে পুষতেই ভালোবাসেন আমাদের রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা! যে কারণে আওয়ামী লীগের কওমীপন্থী প্রভাবশালী নেতাদের প্ররোচণায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতোদিন মৌন সমর্থন দিয়েছেন শফী বাহিনীর নষ্টামী আর দুরাচারে। তার ওয়াজ সরাসরি শোনার পর এদেশে নারীর ক্ষমতায়নে বৈপ্লবিক নেতৃত্ব দানকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠিন বক্তব্য দিলেন শফীর বিরুদ্ধে । তবে কঠোর ভূমিকা নিতে পারলেন না এখনো।
এতোদিন শুনে এলাম , ইসলাম শান্তির ধর্ম, নারী-বান্ধব ধর্ম! আপনি এবং আপনার মতো মুসলিম ব্রাদার হুড নেতারা ইসলামের এই শান্তির বাণী মিথ্যা প্রমাণ করে দিলেন শফি সাহেব! আপনার মতো মোল্লারা অস্ত্র তুলে দিলেন ইসলাম বিরোধী দের হাতে।আহমদ শফি এতো নোংরা, হিংস্র কথা বলেছেন- যা ইসলাম , মানব-সভ্যতা এবং মানবাধিকারের বিরুদ্ধে চরম হুমকি ।
এই যে ,দুর্মর, দুরাচার শফী- তবু আপনাকে বলি, অন্যান্য শিক্ষায় বড় সার্টিফিকেট হাসিল করলেই তাকে সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বলা যায়। কিন্তু ইসলামে বা কোন ধর্মেই তা নয়। ডিগ্রী থাকুক বা না থাকুক, যিনি কোরান-রসুল বা অন্য ধর্ম কে মানুষের মঙ্গল কামনায় সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন-তিনিই প্রকৃত আলেম, প্রকৃত মাওলানা অথবা ধর্মযাজক!
অতীত বর্তমানে বিশ্ব-মুসলিমের অনেক ক্ষতি করেছেন অনেক ডিগ্রীধারী তথাকথিত মাওলানা। বড়পীরের মতো দরবেশকে ও ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়ে স্বাক্ষর করেছিল ইমাম হৌজ-এর নেতৃত্বে এক হাজার মাওলানা (মুখবন্ধ –ফতহুল.গযব,-তাঁর.বক্তৃতার.সংকলন)।
এজন্যই রসুল বলেছিলেন-উম্মতের জন্য তাঁর "সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ পথভ্রষ্টকারী আলেমদের নিয়া"-সহি ইবনে মাজাহ” ৫ম খণ্ড ৩৯৫২। এটাও দেখুন:-"এ সম্পর্কে হযরত মুজাদ্দেদ আলফে সানী মাকতুবাত গ্রন্থে লিখেছেন যে, জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি একবার অভিশপ্ত ইবলিসকে দেখতে পায় যে, সে একেবারে খোশ মেজাজে ও বেকার বসে আছে। ঐ বুযুর্গ ব্যক্তি ইবলিসকে তার এহেন বেকার বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলে প্রত্যুত্তরে সে বলে যে, বর্তমান সময়ের আলেম সমাজ আমাদের কাজ সমাধা করছে, জনগণকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তারাই যথেষ্ট "। এখন বিচার করুন আপনি কি ইবলিশের হয়ে কাজ করছেন না? রসুলের সর্বাপেক্ষা গভীর উদ্বেগ আপনার মতো ভ্রষ্ট পথপ্রদর্শকদের নিয়ে নয়কি?
শফির মতো বর্বর অপরাধীদের ইসলাম-বিরোধী নিষ্ঠুরতার কয়েকশ' উদাহরণ তুলে ধরেছেন শারীয়া গবেষক হাসান মাহমুদ। যিনি দশ বছর একনিষ্ঠ ভাবে শারিয়া নিয়ে গবেষণা করে "শরিয়া কী বলে, আমরা কী করি" বইটি প্রকাশ করেছেন।
এই গবেষণা গ্রন্থটি যারা মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন, তারা অনুধাবন করতে পারবেন- আহমদ শফি, দেলোয়ার হোসেন সাঈদী , মতিউর রহমান নিজামী , গোলাম আজমের র মতো ধর্মব্যবসায়ীরা পবিত্র কোরান হাদিস নিয়ে কতোটা মিথ্যাচার করেন।
কোরান-রসুল থেকে মানুষের মঙ্গল যারা তুলে আনতে পারেন, তাঁরাই সত্যিকার আলেম, মাওলানা ও ইসলামের পতাকাবাহী। আর যাঁরা কোরান-রসুল থেকে তুলে আনেন মানুষের অমঙ্গল ও নারীর ওপরে অত্যাচার তাঁরা আলেমের ছদ্মবেশে ভয়ংকর রাক্ষস।
নারীর ওপরে অত্যাচারের মধ্যে তাঁরা দেখেন সওয়াব, খোঁজেন বেহেশত। ‘কোরাণ’ ‘কোরাণ’ বলে মুখে ফ্যানা তুলে কাজে তাঁরা প্রয়োগ করেন হাদিস। তাও, কোরান-বান্ধব হাদিস প্রয়োগ করেন না, - করেন কোরান বিরোধী নারী-বিরোধী হাদিস। বৌ-পেটানোর মত অমানবিক সন্ত্রাসকে তাঁরা হালাল করেছেন কোরানের (নিসা ৩৪) বিকৃত অর্থ করে আর এই ধরণের নারী-বিরোধী হাদিস দিয়ে - রোজ হাশরে কোনো স্বামীকে নাকি জিজ্ঞাসা করা হবে না কেন সে এই দুনিয়ায় বৌকে পিটিয়েছিল - সুনান আবু দাউদ, ২১৪২। নবীজী নাকি বলেছেন, “যত ইচ্ছে বৌ পেটাও, কোনো সমস্যা নেই”। এটাই তাঁদের ইসলাম। শারীয়া বলে , ইসলাম সম্পূর্ণ আলাদা ও নারী-বান্ধব।সহি মুসলিমে নবীজীর সুস্পষ্ট ও কঠিন নির্দেশ দেয়া আছে, "বৌকে পেটাবে না"।
বই ১১. নং ২১৩৮ বর্ণিত আছে,মুআ’হি বিন হাইদাহ: আমি আল্লাহর প্রেরিত পুরুষকে বলেছি, “আমরা আমাদের স্ত্রীদের কী করে উপস্থাপন করবো –তাদের ছেড়ে দেবো কী করে? –তিনি বলেছেন, তুমি যেভাবে চলবে , ঠিক সেভাবেই তার (তোমার স্ত্রীর) ভরণ পোষণ করবে, কখনো তাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার , গালাগাল অথবা সমালোচনা করবে না। কখনো তাকে প্রহার করবে না।
এ বাণী গুলো আহমদ শফীর জানা নেই । কারণ , তিনি বিবেক বর্জিত এবং ইসলামের শান্তির বাণীর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছেন। তিনি এবং তার নষ্ট ভ্রষ্ট মস্তিষ্কের অনুসারী রা মানবতা, মানবসভ্যতা এবং ইসলাম ধর্ম ধ্বংসের হোলিখেলায় নেমেছেন।
এ ব্যাপারে বিদায় হজ্বের বক্তৃতায় নবীজী কি হুকুম করেছেন সেটাও তাঁরা কখনোই জাতিকে জানতে দেন না - "তাহাদের (স্ত্রীদের) উচিত নয় -তোমরা যাহাকে পছন্দ করোনা তাহাকে নিজের বিছানায় বসাও - তাহা করিলে প্রহার করিতে পারো, কিন্তু মৃদুভাবে" - সহি মুসলিম ৭ম খণ্ড ২৮০৩, সহি ইবনে মাজাহ ৪র্থ খণ্ড ৩০৭৮ ইত্যাদি। অনেক ইসলামী বিশেষজ্ঞ এই শব্দ টি "বিছানায় বসা"-র অর্থ করেছেন পরকীয়া। অর্থাৎ তারা ব্যাখ্যা করেন, নবীজী হুকুম করেছেন – “পরকীয়া- ব্যভিচার না করা পর্য্যন্ত বৌয়ের গায়ে হাত তুলবে না”।
এখানে আমি বিস্মিত হই, একজন নারী বিছানায় শোবে কি শোবে না- তা নির্ধারণ করবে পুরুষ অথবা নারী , অথবা অন্য কেউ ? বলতে হয়, যাহা বাহান্ন, তাহা ই তেপ্পান্ন। নারীর ইচ্ছে- অনিচ্ছে বন্দী থাকবে পুরুষ বা অন্য কারো মুঠোয়? তাহলে আর নারী কে মানুষের কী মর্যাদা দিলো শারিয়া? এই প্রশ্নের একমাত্র জবাব- কোন মানবিক অনুভূতি সম্পন্ন মানুষ- অন্য একজন মানুষকে তার ইচ্ছে –অনিচ্ছের দাস ভাবতে পারেন না কখনো। আমার বলতেই হয়, শারীয়া প্রবর্তন কালীন পিছিয়ে তাকা সমাজের প্রতিচ্ছবি আমরা পাই। এই স্ববিরোধী এবং নারীর প্রতি অবমাননামূলক নির্দেশনা গুলোর সুযোগ নিয়েছে শফীর মতো কাঠমোল্লারা ।
উল্লেখ করতে হয়, শারীয়া গবেষক হাসান মাহমুদের বক্তব্য।“পরকীয়াই হোক্, বা "বিছানায় বসা"-ই হোক ওটা ছাড়া অন্য কোনো কারণে বৌযের গায়ে হাত তোলা নাজায়েয। নানা রকম কুযুক্তি কূটতর্কে সেটা জায়েয করে রসুলের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেন তাঁরা”।
এই কাঠমোল্লাদের কথার সূত্র ধরে প্রশ্ন ওঠে, পুরুষকে কেন তারা নারীর কর্তা দাবি করেন ? আল্লাহ পুরুষকে নারীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছেন কখনো? তারা এই দাবি করেন , কারণ তারা মনে করেন পুরুষের গায়ে শক্তি বেশী, তাই না ? একজন রেসলার নারীর সাথে শারীরিক শক্তিতে সাধারণ পুরুষ পারবেন তো? তাহলে তো ‘ আশরাফুল মাখলুকাত’ বা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ নয়, পুরুষ রূপী পশু বা ডায়নোসর!
শফীর মতো কাঠমোল্লারা বলেন , “নবীজী দোজখে বেশীর ভাগ ই নারী দেখেছেন”। কী করে একথা বলেন তারা ? শারীয়া মতে , বেহেশত-দোজখে তো আমরা যাবো কেয়ামতের পরে- হাশরের বিচারের পরে। ঐ মেয়েগুলো দোজখে চলে গেলো- মানে কেয়ামত হয়ে গেছে? কবে হলো? রোজ হাশরের বিচার ও হয়ে গেলো বুঝি? কবে হলো?
গবেষক হাসান মাহমুদ এ প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা আপনাদের নারী-বিরোধী হাদিসকে পরাজিত করি ওই কোরান, ওই রসুল থেকেই”।
কিছু ব্যতিক্রম সব সমাজেই আছে, আপনাদের অনেক মাদ্রাসাতেও ব্যাতিক্রম আছে। সাধারণভাবে আমাদের নারীরা অত্যন্ত মেধাবী, সক্ষম, কর্মঠ, দক্ষ । তাদের চলাফেরা যথেষ্ট শালীন। অর্থনীতি সহ দেশের সর্বক্ষেত্রে তাঁরা অসামান্য অবদান রাখছেন, তাঁরা আপনাদের মতো যাকাতের টাকায় চলেন না বরং তাঁদের উপার্জনের ট্যাক্স ও যাকাত দিয়ে আপনাদের চলতে হয়। তাঁরা আপনার চেয়ে কম ধার্মিক নন। কেবল আপনি ই মুসলমান অন্য কে মুসলমান আর কে নন- তা নিশ্চয়ই আপনারা নির্ধার করবেন না?
আল্লাহ ও নারী সমাজের মধ্যে কোনো দালালের দরকার নেই ইসলামে সে সুযোগও নেই। শফী কাঠ মোল্লা কে বলি, আপনি নারী সমাজকে যথেষ্ট অপমান করেছেন । আপনি অপমান করেছেন পুরুষদেরও।
এ প্রসঙ্গে আবার ও গবেষক হাসান মাহমুদের বক্তব্য তুলে ধরতে হয়, “ আপনি সব পুরুষদের কামুক জন্তু বানিয়ে ছেড়েছেন। এতো সাহস, এতো স্পর্ধা আপনার কি করে হলো? আপনার ইসলাম আপনাকে এই শিখিয়েছে? আপনি দুনিয়া দেখেন নি, আপনি কিছুই জানেন না। আমরা নারী-পুরুষ একসাথে পড়াশুনা করেছি, একসাথে চাকরী করছি -আপনার মাথায় সবসময় যে নোংরা পোকাগুলো নড়াচড়া করে সেগুলো আমাদের মাথায় নেই। আমাদের কাছে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের দেয়া কোরানের- রসুলের নারী-বান্ধব ব্যাখ্যা ও হাদিস আছে”।
শারীয়া গবেষক শ্রদ্ধেয় হাসান মাহমুদ বিদগ্ধ জন। শফীকে তিনি ধন্যবাদ জানিয়েছেন। বলেছেন, ইসলামের যে ব্যাখ্যা শফী এবং তার অনুসারীরা বয়ে বেড়ান সেটা যে কতো নোংরা ও নিষ্ঠুর তা দলিল ধরে ধরে দশ পনেরো বছর ধরে জাতিকে জানাতে চেষ্টা করছি। কাজটা কঠিন, সাফল্য বেশী নয় কিন্তু কাজ এগোচ্ছে। শফী এক লহমায় সেই সাফল্য এনে দিলেন। ইসলামের নামে শফী গংদের ভেতর লুকিয়ে রাখা রাক্ষসের চেহারাটা দেখে আতংকে আঁৎকে উঠছে জাতি। সমাজের এই রাক্ষস দের মুখোশ খুলে গেলো। মানুষকে সচেতন করার কাজ সহজ হয়ে গেল কিছুটা হলেও।


হেফাজতের এই ধর্মান্ধ নেতা বলেন, ‘ তোমরা নারীরা শুন, বাড়ির বাইরে যেয়ো না। রাস্তায়, স্টেশনে, বাজারে, মাঠে নগ্ন হয়ে ঘোরাফেরা করো না। সাবধান! কেনাকাটা করতে যাবে না। তোমার স্বামী বা ছেলেকে বলো বাজার করার জন্য। তোমাকে কেন যেতে হবে? তুমি শুধু বসে থাকো এবং ছেলেকে হুকুম করো। তোমাকে কেন এই ঝামেলা পোহাতে হবে?’ শফীর মতে, নারীদের কাজ হলো আসবাবপত্রের যত্ন নেওয়া, সন্তান লালন-পালন করা, ঘরের মধ্যে থাকা। চট্টগ্রামভিত্তিক হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ৯৩ বছর বয়সী শফী বলেন, ‘শোনো নারীরা, চার দেয়ালের ভেতরই তোমাদের থাকতে হবে। স্বামীর বাড়িতে বসে তোমরা আসবাবপত্র দেখভাল করবা, শিশু লালন-পালন, পুরুষ দের যত্ন করবা। এই হলো তোমাদের কাজ।’এ যেন পাকিস্তান আর আফগানিস্তান এর অন্ধকারে ঠেলে দেয়া।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যা ব্যুরোর ২০১০ সালের হিসাব মতে, দেশের চাকরিজীবী নারীর সংখ্যা এক কোটি ৭০ লাখ। ২০০২-০৩ সালে এটা ছিল এক কোটি। তবু পুরুষের তুলনায় তা অর্ধেক।
ওয়াজে নারীদের তিনি তুলনা করেছেন তেঁতুলের সঙ্গে। তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে ‘দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়’ -বলে অশ্লীল , ঘৃণ্য মন্তব্য করেছেন তিনি। যাদের তা হয় না, তাদের পুরুষত্বহীন বলে তিরস্কার করেছেন শফি! শফির ওই বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক আর ব্লগে সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ এ ধরণের নোংরা বক্তব্যের নিন্দা জানাচ্ছেন।
সম্প্রতি শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করেই উগ্রপন্থী ইসলামিক গোষ্ঠী হেফাজত আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। সংগঠনটির ১৩ দফা দাবি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে। এসব দাবির মধ্যে ছিল নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা নিষিদ্ধ করা, বিদেশি সংস্কৃতি নিষিদ্ধ করা, মোমবাতি প্রজ্বলন নিষিদ্ধ করা। ঢাকায় গত ৬ এপ্রিলের সমাবেশে এই দাবিগুলো পেশ করে হেফাজত।সমাবেশের দিন নারী সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয় হেফাজতের লোকজন। হেফাজতের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন গেলো ? তাদের মাথায় কাপড় নেই কেন? এ ধরনের অযাচিত প্রশ্ন তুলে নারী সাংবাদিকদের হেনস্থা করা হয়। সমাবেশের পাশ দিয়ে কোন কর্মজীবি নারী বাড়ি ফেরার পথে হেনস্থার শিকার হয়েছেন। চট্টগ্রামে অনেক দম্পতিকে রিক্সায় করে যাবার সময়ে অপমান করে রিক্সা থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। নারী-পুরুষ একসাথে রিক্সায় বসতে পারবে না বলে। পুরুষ টি যতোই দৃঢ়তার সাথে বলছেন, “ ইনি আমার বিবাহিত স্ত্রী”- ততোই উগ্র আক্রমনাত্মক ভঙ্গীতে হুংকার দিয়ে বলা হয়েছে- তারা যেন হেঁটে যান।
একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক নাদিয়া শারমিনকে দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধোর করা হয়েছে। একই সময়ে কয়েকজন টিভি সাংবাদিক এবং ক্যামেরাপরসন কে বেধড়ক পিটিয়েছে হেফাজতি কর্মীরা। তাদের কে ‘নাস্তিক’ বলা হয়েছে।
নাদিয়া সহ সাংবাদিকেরা পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের খবর সংগ্রহ করছিলেন। এ সময় সমাবেশ থেকে প্রশ্ন তুলে বলা হয়, ‘পুরুষের সমাবেশে নারী সাংবাদিক কেন?’ একপর্যায়ে নাদিয়াকে মারতে মারতে সমাবেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়। সমাবেশ থেকে হেফাজতি রা প্রতিটি নারী সাংবাদিককেই হেনস্থা করেছে । সেদিন আমি চট্টগ্রামে ছিলাম । ওয়াসার সামনে মূল সমাবেশের একপাশে ফুটপাতে ল্যাম্প পোষ্টের সাথে হেলান দিয়ে ছবি আর নোট নিচ্ছিলাম। সাদায় হাল্কা ছাপা আড়ং য়ের ফুল হাতা কামিজ পায়জামা পরেও হেফাজতী জঙ্গীদের রোষানল থেকে রক্ষা পাওয়া যায় নি। আমাকে মারবার জন্যে তেড়ে এসেছিলো যারা ,তাদের ছবি তুলে রেখেছি আমি। আমার ক্যামেরা মোবাইল কেড়ে রাখতে চেয়েছিলো। আমি দৌড়িয়ে ও আসিনি -পালাই ও নি। ক্যামেরা আর মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বলেছিলাম- নিতে পারেন, সমস্যা নেই । হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলো এই জঙ্গীরা তখন। আমি এ একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম – কী করে তারা আমার দিকে আঘাত করতে আসে তা দেখবার অপেক্ষায়। এ সময়ে আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক,বাচনে আধুনিক- সুষ্পষ্ট বাংলা এবং ইংরেজী উচ্চারণে উচ্চশিক্ষিত তরুণের একটি দল আল-জাজিরার প্রতি ‘ইসলামিক ভালোবাসা’ থেকেই হয়তো তাদের সংবাদকর্মী হিসেবে আমাকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে রাখে। পেছন ফিরে নারী দেখে উত্তেজিত জঙ্গীদের ধমকে বলে ,” সরে যান আপনারা!” আমাকে বিনয়ের সাথে বেরিয়ে আসতে বলে সমাবেশ থেকে। বলে, “ এরা খুব খারাপ, আপনি প্লীজ চলে যান!” আমি তাদের প্রশ্ন করেছিলাম, “খারাপ ই যদি বোঝেন ,আপনাদের মতো উদ্যমী তরুণেরা কেন এদের সমাবেশে এসে এদের মিথ্যাচার আর উগ্র ধর্মান্ধতার আফিমে নিজেদের আকন্ঠ ডুবিয়ে দিচ্ছেন?” না , এই পথভ্রষ্ট তরুণেরা আমার কথা শুনবার মতো মানসিক সুস্থতায় ছিলেন না। আমাকে নিরাপদে সমাবেশের সীমানার বাইরে মূল সড়কে এনে দিলো যারা- অসহায় করুণ ভাবে তাকিয়ে দেখলাম সেই নিরীহ সুন্দর মুখগুলোর দিকে –যারা তাদের মেধা এবং মনন বিকারগ্রস্থ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর কাছে বিকিয়ে দিয়েছে। যারা তাদের এই বিকারগ্রস্থ দীক্ষাগুরুদের প্ররোচনায় যে কোনদিন অবলীলায় চাপাতি হাতে আমাকে কুপিয়ে যাবে!!
এদের সুপথে ফিরিয়ে আনবার জন্যে সুচিন্তিত, সুপরিকল্পিত এবং সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরী। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সহ ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকদের সমন্বিত উদ্যোগ এবং সিদ্ধান্তের অভাবে জাতি এই ক্রান্তিকালের মুখোমুখি।
নারীর প্রতি এতো ঘৃনা আর অশ্রদ্ধা দিয়ে সাধারণ মানুষের মন বিষিয়ে তুলে কোন্ সমাজ প্রতিষ্ঠা করবেন শফি এবং তার অনুসারী রা?
এর পর ও এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নেয়ার কারণে দেশের সাম্প্রতিক ৫টি নির্বাচনে অবৈধ অর্থ বিলি এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে জয়ী হয়েছে জামাত-বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

বেগম রোকেয়া বলেছিলেন,‘এই বিংশ শতাব্দী কালে যৎকালে অন্যান্য জাতি নিজেদের প্রাচীন প্রথাকে নানা রকমে সংস্কৃত, সংশোধিত ও সুমার্জিত করে আঁকড়ে ধরে আছেন, ... ... ... ... তৎকালে আমরা নিজেদের অতিসুন্দর ধর্ম, অতিসুন্দর সামাজিক আচার-প্রথা বিসর্জন দিয়ে এক অদ্ভুত জানোয়ার সাজতে বসেছি।’
নারীরা পৈত্রিক সম্পত্তিতে ইসলাম প্রদত্ত অধিকার থেকেও অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত। এর প্রতিবাদে বেগম রোকেয়া বলেন, ‘হায় পিতা মোহাম্মদ (দ. )! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্তে পিতৃসম্পত্তির অধিকারিনী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যগণ নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করিতেছে। আহা! মহম্মদীয় আইন পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নীরব অবলাদের নহে।’ [গৃহ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:৭২]
বেগম রোকেয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘এখন আমাদের আর ধর্মের নামে নত মস্তকে নরের অযথা প্রভুত্ব সহ্য করা উচিত নহে। যেখানে ধর্মের বন্ধন অতিশয় দৃঢ়, সেইখানে নারীর প্রতি অত্যাচার অধিক। প্রমাণ-সতীদাহ। যেখানে ধর্মবন্ধন শিথিল, সেখানে রমণী প্রায় পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থায় আছেন। এস্থলে ধর্ম অর্থে ধর্মের সামাজিক বিধান বুঝিতে হইবে।’এ-প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘কেহ বলিতে পারেন যে, ‘তুমি সামাজিক কথা বলিতে গিয়া ধর্ম লইয়া টানাটানি কর কেন?’ তদুত্তরে বলিতে হইবে, ‘ধর্ম’ শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন। তাই ‘ধর্ম’ লইয়া টানাটানি করিতে বাধ্য হইলাম। এ জন্য ধার্মিকগণ আমায় ক্ষমা করিতে পারেন।’ [নবনূর, ২য় বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, পৃঃ ২১৮]। ‘পর্দার দোহাই দিয়ে, অনেক ভালো জিনিসে আমাদের বঞ্চিত করে রেখেছে, আর তা আমরা থাকবোনা ... ... আমরা চাই আমাদের ইসলাম দত্ত স্বাধীনতা, চাই ইসলাম দত্ত অধিকার ... ... কে আমাদের পথ রোধ করবে? সমাজরূপী শয়তান? কখনই পারবেনা।’ [পর্দা বনাম প্রবঞ্চনা, সওগাত, ভাদ্র ১৩১৬, পৃ. ৬৯-৭১]
আবার ও রোকেয়ার কাছে ফিরে আসি। তিনি বলেছিলেন, ‘”প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি, সমাজ মহাগোলযোগ বাধাইবে জানিঃ ভারতবাসী মুসলমান আমাদের জন্য ‘কতল’ [অর্থাৎ প্রাণদন্ডের] বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি। [এবং ভাগ্নীদিগের ও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি।] কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তে জাগিতে হইবেই। বলিয়াছিতো, কোন ভাল কাজ অনায়াসে করা যায় না। কারা মুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হোক পৃথিবী ঘুরিতেছে ।আমাদিগকে ও এইরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে”।
তিনি পুরুষ দের সাথে নিয়ে সমাজকে এগিয়ে নেবার জন্যে নারী স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন! তিনি লিখেছেন, ‘পরস্পরের একতা থাকাও একান্ত আবশ্যক। কিন্তু এই ঐক্য যেন সত্যের উপর স্থাপিত হয়। একতার মূলে একটা মহৎ গুণ থাকা আবশ্যক’ [সৌরজগৎ, রোকেয়া রচনাবলী, পৃ:১৩১-১৩২]
শুধু কি নারী বিদ্বেষী? অধিকাংশ মাদ্রাসার শিশু কিশোরেরা শিক্ষকদের নিয়মিত বলাৎকারের শিকার হয়। এর কতোটাই বা সংবাদে আসে?
এ সংক্রান্ত কিছু সংবাদ তুলে ধরছি। কুষ্টিয়ায় হেফাজত-নিয়ন্ত্রিত কওমি মাদ্রাসায় ৯ বছর বয়সী ছাত্র আবদুল্লাহকে বলাত্কারের চেষ্টা করেছেন সমকামী কওমি-শিক্ষক মোহাম্মদ তানভীর। ( তারিখ টা এই মুহুর্তে পাওয়া যায়নি।) পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারী উপজেলার গোয়ালদিঘী নেছারিয়া ছালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসার ২য় শ্রেণীর ছাত্র সেলিমকে মাদ্রাসার কৃষি বিভাগের শিক্ষক ও বোর্ডিং সুপার মো. মুক্তারুল আলম বলাত্কার করেন চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি। চলতি বছর জুন মাসে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার নুরুল উলুম কওমি হাফিজিয়া মাদ্রাসার সুপার আবুল হাসেম ছাত্র ওমর ফারুককে বলাত্কার করে। গত বছরের জুন মাসে ঝিনাইদহের আল ফারুক একাডেমি মাদ্রাসার এক ছাত্রকে বলাত্কারের ঘটনায় মাদ্রাসাটির শিক্ষক হাফেজ মো. হাসানুজ্জামানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। বছর দশেক আগে চট্টগ্রামের হালিশহর থানার কাছে একটি মাদ্রাসায় কয়েকজন কিশোর বলাৎকারের শিকার হবার পর বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদিকা নূরজাহান খানের সহযোগিতা চায় অভিভাবকেরা। সে সময় আমি নিজে দেখেছি সেই মাদ্রাসার শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার অবোধ কিশোর এবং তাদের অভিভাবক দের কান্না এবং ক্ষোভ। সেখানকার ইমামের স্ত্রী ক্ষুব্ধ কন্ঠে নির্যাতক শিক্ষকের বিচার চেয়েছিলেন।
বাঁশখালীর বৈলছড়ি মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুস সাত্তার ২০০৪ সালের ১৮ মে ধর্ষণ করে ছোট্ট শিশু ইকরা কে । তখন ইকরার বয়স ছিল তিন বছর । মাদ্রাসার পাশেই তারা থাকতো। অলস দুপুরে সবাই ঘুম । অন্যন্য শিশুদের সাথে ইকরা খেলছিলো উঠোনে । ওখান থেকেই ফুসলে ডেকে নিয়ে ধর্ষন করে সাত্তার ।এ মামলার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম আমি। একনিষ্ঠভাবে চার বছর এ মামলা পরিচালনা করেন নূর জাহান খান, এডভোকেট রানা দাশগুপ্ত । ধর্ষক সাত্তারের বিরুদ্ধে জঙ্গী তৎপরতার অভিযোগ ছিল। নিয়মিত পাকিস্তান,আফগানিস্তান,ব্যাংকক সফর করতো । তার পাসপোর্ট জব্দ করে নি পুলিশ । কারণ, তার চরিত্র ‘ফুলের মতো পবিত্র’ দাবি করে চারিত্রিক সনদ পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সহ বিএনপির প্রভাবশালী নেতারা। চারটি বছর এ মামলার জন্যে আমরা লড়াই করেছি। এখনো ইকরা কে দেখলে আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারি না। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে এ মামলার রায় হয় সাত বছর কারাদন্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা। আদালতে ঢুকবার পথে সাত্তার আমার আর নূরজাহান খানের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে দোয়া পড়ে ফু-ফু করে অভিসম্পাত করতো আমাদের। যেন তার মতো ধর্ষকের ‘অভিসম্পাতে’ আমি এবং নূরজাহান খান ধ্বংস হয়ে যাই। আমার ইচ্ছে করতো ছোট্ট শিশুর সাথে বর্বরতা করে এতো দাপট যার- তাকে যদি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা যেতো! ঘেন্নায় থুথু ছিটাতে ইচ্ছে হতো তাকে। এই চারটি বছর ছোট্ট ইকরাকে বার বার আদালতে বলতে হয়েছে তাকে তার শরীরের কোথায় কোথায় কী কী করেছে ধর্ষক সাত্তার ! কখনো মায়ের কোলে , কখনো বিচারকের পাশে চেয়ার নিয়ে ইকরা কে দাঁড় করানো হয়েছে। বার বারই সাত্তার কে ছোট্ট আঙ্গুলটি দেখিয়ে ইকরা বলেছে , “ ঐ সাত্তার মলই (মৌলভী) আাঁরে ( আমাকে) দুক্খু (ব্যথা ) দিয়ে (দিয়েছে) ।’’ ধর্ষক সাত্তারের আইনজীবিদের জেরার মুখে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে ছোট্ট ইকরা। একুশে টেলিভিশন থেকে আমি রিপোর্ট করতে ঐ মাদ্রাসায় গিয়েছিলাম –দু:খজনক ভাবে শফীর মতো সাত্তারের পক্ষে ও সাফাই গেয়ে উগ্রমূর্তি ধারণ করেছে মাদ্রাসার অন্যন্য শিক্ষক এবং ছাত্ররা। এই যদি হয় ধর্মপ্রচারক এবং মাদ্রাসার চিত্র- এদের কাছে কী শিখবে আমাদের দেশের মানুষ?এই শিশুটির ট্রমা এখনো কাটে নি। শারীরিক ভাবে ও তেমন বেড়ে উঠে নি এখনো। এর জন্যে কি আমাদের এই সমাজব্যবস্থা দায়ী নয়? আমাদের দায়িত্ব থেকে সরে থাকা, বিচ্ছিন্নতা এবং উদাসীনতা দায়ী নয়? এভাবে চলতে পারে না। এই বিকৃত চরিত্রের ধর্মব্যবসায়ীদের আর সুযোগ দেয়া যায় না। আমাদের দেশের সকল শুভশক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে ।
শফির বক্তব্য সমর্থন করে হেফাজতে ইসলামী, চট্টগ্রামের সংগঠক মুফতি হারুণ বলেছেন, গ্রামের লোকেদের জন্যে এই ওয়াজ দিয়েছেন তাদের হুজুর আহমদ শফী । কী চমৎকার ব্যাখ্যা! গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো কে বিকৃত রুচির মানসিকতার মানুষে পরিণত করার হীন উদ্দেশ্যে এই অপপ্রচারে নেমেছে তারা।
সমাজ সভ্যতা এগিয়ে নিচ্ছেন যারা , তারা শিক্ষা দেন কী করে নারী-পুরুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করা যায়। আর এই বিকৃত রুচির অশিক্ষিত কাঠমোল্লা শফি শিক্ষা দেন অনিয়ন্ত্রিত বিকৃত জীবন যাপনের । এখন আবার এরা অস্বীকার করছে এই বক্তব্য শফীর নয় বলে। অবাক হইনা। এরা তো মিথ্যার বেসাতি করেই চলে। এদের সাথে তাল মিলিয়েছে বিএনপির মুখপাত্র মানবজমিন। শফির কণ্ঠ নাকি ‘ডিজিটালি নকল’ করা হয়েছে। চমৎকার! অন্যায় মিথ্যাচার করলে নিজেদের সম্পর্কে সত্য বলার সৎসাহস থাকবে কী করে?
শান্তির ধর্ম ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা করে তরুণদের হাতে চাপাতি তুলে দিয়ে ‘মুরতাদ’ ‘নাস্তিক’ বলে যে মানুষগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছেন-তারা কারা? কী করেন তারা? তারা কেউ একাত্তরের , কেউ এ প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধা । মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস , ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করেন তারা। প্রজন্মান্তরে এদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরছেন। যাতে এই প্রজন্ম শেকড়ের কাছে ছুটে যেতে পারেন।
প্রশ্ন উঠে তরুণ সমাজকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে কারা? বোনের বিরুদ্ধে ভাইকে ক্ষেপিয়ে দিচ্ছেন – নারী পুরুষ একে অপরের পরিপুরক – এ শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে পুরুষের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিচ্ছেন নারীকে। এ নারীর গর্ভে ই তো আপনাদের সবার জন্ম। মায়ের প্রতি ও এমন ঘৃণা আর বিতৃষ্ঞার জন্ম দিচ্ছেন শফী , মস্তিষ্কের শুভশক্তিকেই নির্মূল করে দিচ্ছেন? উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর জেন্ডার বৈষম্যের বীজ বপন করে দিচ্ছেন নিরীহ মানুষের মধ্যে? এটা তো হতে দেয়া যায়না। আপনাদের মতো অশুভ অন্ধকারের শক্তিকে ঠেকাতেই হবে। বারবার বলছি , হাজার বছরের বাঙ্গালী ঐতিহ্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে সবাই কে। এই অপরাধীর সহযোগী শক্তিরা বুঝতে পারছেন না তারা কতোটা আত্মঘাতী কাজ করছেন!এর ভয়াবহ পরিণতি থেকে কেউ মুক্তি পাবে না।
স্পষ্টভাবে বলতে চাই , বাঙ্গালী ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সেক্যুলারিজমের সাথে ইসলামের কোন বিরোধ নেই। আমাদের নবীজী হযরত মোহাম্মদ(স:) তার জীবন চর্চায় যে উদারতা দেখিয়েছেন তা সেক্যুলারিজমের অনন্য দৃষ্টান্ত। কাঠমোল্লারা ইসলাম ধর্মকে ব্যবসায় পরিণত করেছেন। অমানবিক অসভ্য অশালীন জীবনাচরণের অভ্যস্ত এই কাঠমোল্লারা ধর্ম বেচে মানুষকে আফিং য়ের মতো নেশা ধরিয়ে দিয়ে এদেশের মেধাবী প্রজন্ম কে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে মত্ত। এই ষড়যন্ত্র কোনভাবেই সফল হতে দেয়া যাবে না।
সম্মিলিত শক্তিতে প্রতিরোধ করতে হবে এই অন্ধকারের শক্তিকে। তাই আহ্বান জানাই এসো ভাই, এসো বোন, এসো বন্ধু – এসো স্বজন আমাদের এ দেশ এবং সমাজ রক্ষায় মিলিত হাতে প্রতিরোধ করি এই অন্ধকারের শক্তি- এখনি রুখে দাঁড়াতে হবে এই অপশক্তিদের।
২২ জুলাই ২০১৩ //১৯, ২০ এবং ২১ জুলাই দৈনিক জনকন্ঠে প্রকাশিত ধারাবাহিক কলাম থেকে সংকলিত এবং সম্পাদিত । Sumikhan29bdj@gmail.com